শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক

মজুরিবৈষম্য কমছে না নারী শ্রমিকদের

ছোটবেলায় না বুঝে পড়েছি ‘শ্রমের মর্যাদা’ রচনা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর গুরুত্ব বুঝেছি। এই সমাজে কয়জন শ্রমের মর্যাদা নিয়ে ভাবেন বা সঠিক বিচার করেন? আজও যখন দেখি, শ্রমিকেরা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছেন, তখন বুঝি শ্রমিকেরা এখনো তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত।

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। ঘাম ঝরা শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ দিবস। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একজন শ্রমিক যখন পারিশ্রমিক পেয়ে হেসে ওঠেন তখন কত-না মধুর লাগে সে দৃশ্য। কিন্তু সেই হাসি থেকে অনেক শ্রমিকই বঞ্চিত হচ্ছেন।

বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বের শ্রমিকেরা প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস তথা মে দিবস পালন করেন। দিবসটিতে বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শোভাযাত্রা, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচিতে মুখর থাকত রাজপথ। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে গত বছর দিবসটি খুব সাদামাটা পালিত হয়েছে, এবারও হয়তো তাই হবে। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ছুটিও রয়েছে অফিস-আদালতে।

১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ন্যায্য মজুরি আর দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন হে মার্কেটের শ্রমিকেরা। আন্দোলনরত শ্রমিকদের দমাতে মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এতে ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত ও গ্রেপ্তার হন আরও অনেক শ্রমিক। গ্রেপ্তার হওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৬ জনকে পরে ফাঁসিও দেওয়া হয়। এতে বিক্ষোভ আরও প্রকট হয়। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। পরে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এরপর ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক’ দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে। সরকারিভাবে বিশ্বের ৮০টি দেশ ও বেসরকারিভাবে আরও কয়েকটি দেশ এ দিবসটি পালন করে।

শ্রমিকদের সামাজিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে ১৯১৯ সালে জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা আইএলও স্থাপন করা হয়। এর প্রধান কার্যালয় জেনেভায়। শ্রমিকদের সামাজিক ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এর মূল উদ্দেশ্য। শ্রমিকদের দক্ষ করে তুলতে এ সংস্থা সহায়তা করে। বাংলাদেশে সংবিধানেও অনেক নীতি নির্দেশিকার দ্বারা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করার প্রয়াস চালানো হয়েছে। আমাদের দেশে রপ্তানি আয়ের ৮৪ ভাগ আসে পোশাক শিল্প থেকে। এ খাতে কাজ করেন ৪৫ লাখের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে ৮০ ভাগের বেশি নারী শ্রমিক। পোশাক শিল্পের কল্যাণে অনেক নারী আজ স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন, পাশাপাশি বেড়েছে তাঁদের ক্ষমতাও। এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। এই শিল্পে কাজ করতে এসে অনেক নারী তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চাকরি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেক নারী। সরকারি সেক্টরের মতো এই শিল্পে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই বলে মা হওয়ার আগে তাঁদের চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। এমনও শোনা যায়, নারী শ্রমিকদের পিরিয়ডের সময়ও পোহাতে হয় নানা সমস্যা।

বিশ্ব শ্রমবাজারে নারী শ্রমিকের সংখ্যা মোট শ্রমিক সংখ্যার প্রায় অর্ধেক, যা কোনোভাবে কম না। আমাদের দেশে নারী শ্রমিকদের অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন। কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও অনেক সময় সঠিক বিচার পান না। আবার অনেক নারী আছেন মান-সম্মানের ভয়ে নীরবে এসব নির্যাতন মুখ বুজে সয়ে যান।

আমাদের দেশে শ্রমের মর্যাদা অতীতের তুলনায় যতটা এগিয়েছে তার পেছনেও রয়েছে শ্রমিকদের ত্যাগ ও সংগ্রাম। বর্তমানে শ্রমিকেরা আগের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও এখনো তাঁদের কিছু অংশ মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। একজন নারী শ্রমিক ও একজন পুরুষ শ্রমিক সমান কায়িক শ্রম করলেও দেখা যায়, অনেক সময় তাঁদের বেতন সমান না। অথচ দুজন শ্রমিকই সমান কাজ করেন।

গত কয়েক দিন আগে আমাদের দেশে শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি আদায়ের জন্য যখন মাঠে নেমেছেন তখন পুলিশ তাঁদের ওপর গুলি ছুড়েছে। কেন গুলি করা হলো তাঁদের? ওঁরা তো অধিকার বা দাবি আদায়ের কথা মালিক পক্ষকে বলতেই পারেন। এই আধুনিক যুগে এসেও কেন শ্রমিক দাবি আদায়ের কথা বলতে গিয়ে রক্তাক্ত হবে? এটা তো কারও কাম্য ছিল না। যে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের মারধর করালেন, তাঁরাই আবার শ্রমিক দিবসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, শ্রমিকদের বন্ধু বলে মানুষের প্রশংসা বাহবা পান। আসলে তাঁরা মুখোশ পরে থাকেন। আইনের চাপে পড়ে অসাধু শিল্প মালিকেরা মঞ্চে শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলে ফুলঝুড়ি ছড়ায় যা রীতিমতো শ্রমিকদের মনে আঘাত হানে। কিন্তু প্রতিবাদ করতে গেলেই চাকরি নেই।

শ্রমিক তাঁর মজুরি, সুবিধা-অসুবিধা, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে মতামত মালিক পক্ষকে বলার ক্ষমতা রাখেন। এটাই স্বাভাবিক। অথচ শ্রমিক যখনই অধিকার নিয়ে সোচ্চার হন, তখনই তাঁদের চাকরিচ্যুত করা হয়। পেটের দায়ে লাখো লাখো শ্রমিক মুখ বুজে সহ্য করে কাজে করে যান। আর এভাবেই তাঁরা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

আমাদের দেশে আয়ের প্রধান উৎস পোশাক শিল্প। এ শিল্পে লাখো শ্রমিক দেশে করোনাকালীন লকডাউনেও কাজ করে দেশকে আত্মনির্ভরশীল করে যাচ্ছেন। বিনিময়ে তাঁরা শুধু নামমাত্র পারিশ্রমিক পাচ্ছেন, এর বাইরে কিছু না। পোশাক বা জাহাজ শিল্পে শ্রমিকেরা তাঁদের ঘাম ঝরাচ্ছেন, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সঠিক অধিকার থেকে তাঁরা অবশ্যই কিছুটা বঞ্চিত হচ্ছেন।

এদিকে বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকেরও অভাব নেই, যারা পেটের দায়ে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত। অর্থ উপার্জনের আশায় অভিভাবকেরা শিশুদের হোটেল, চায়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, মোটর গ্যারেজ, শিল্প প্রতিষ্ঠান, আতশবাজি তৈরির কারখানা, ইট ভাটা, চাষের কাজ, হিরা কাটা, কাচের চুড়ি তৈরি, বিড়ি তৈরির মতো কাজে নিযুক্ত করেন। যা পুরোপুরি বেআইনি হলেও অহরহ চলছে। অনেক সময় শিশু শ্রমিকেরা কাজে কোনো ভুল করলে দেখা যায় মালিক পক্ষ শিশুদের শারীরিক নির্যাতন করেন। আবার কিছু মালিক ভালো মনেরও আছেন।

প্রতিবছর শ্রমিক দিবস পালনের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। অন্যদিকে এ দিনটি শ্রমিক নেতাদের মতবাদের মূল্যায়ন ও তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরও এক বিশেষ দিন। তাই শ্রমিক দিবস গুরুত্ব নিয়ে পালন করা উচিত। শ্রমিকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার বা তাঁদের কাজের প্রশংসা করলে তাঁরা যেমন আনন্দ পান, তেমনি কাজের প্রতিও উৎসাহ অনুভব করেন। এতে কাজটি আরও সহজ হয়।

তাই আসুন শ্রমিকদের সম্মান করি। শ্রমিক অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হই। শ্রমের পারিশ্রমিক বা অধিকার সঠিকভাবে বিলিয়ে দিয়ে তাঁদের আত্মার আত্মীয় হই। তাঁদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াই।