শ্যামলা মেয়ের গল্প

বৃষ্টি। ছবি সংগৃহীত
বৃষ্টি। ছবি সংগৃহীত

আষাঢ় মাস। এক শ্যামলা মেয়ের আকাশজুড়ে শ্রাবণের ঢল নেমেছে। প্রকৃতি অঝোরে কাঁদছে। প্রকৃতির ছাই রং প্রভাব ফেলছে মেয়েটার রূপে। শ্যামলা মেয়েদের এই এক সমস্যা—বর্ণচোরা ওরা। প্রকৃতিই নির্ধারণ করে আজ ওদের লাগবে কেমন।
সদ্য ১৮ পেরিয়ে ১৯–এ মেয়েটা। তাঁকে আজ ছেলেপক্ষ দেখবে বাইরে কোথাও। মেয়েপক্ষও ছেলেকে দেখবে। শ্যামলা মেয়ের মা কটকটে কমলা রঙের একটা শাড়ি কিনেছেন মেয়ের জন্যে। তাঁর ধারণা, কমলা রঙের শাড়ি পরলে মেয়েদের সোনালি দেখায়! তাতে পছন্দ না করুক, অপছন্দও করতে পারবে না।
এদিকে শ্যামলা মেয়ের বাবা খুবই রাগ করেছেন সেদিন। ছেলের কোনো এক আত্মীয় নাকি বলেছেন, ‘মেয়ে তো কালো!’ এই কথা ফোনে কার কাছ থেকে শুনে তাঁর মেজাজ ভীষণ চড়া। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে কালো বলে, সাহস কত!’ তাই রং চেনানোর আয়োজন আজ বিকেলে।
এসবে মেয়েটার মন নেই। সে উদাসীন। ভাবে, নাহ, বিয়ে তো আর হচ্ছে না। প্রথম দেখায়, প্রথম প্রস্তাবে সেসব হয় নাকি! বিয়ে কি এত সোজা! তা ছাড়া পছন্দ হলেই তো বিয়ে! তেমন হবে না, মেয়েটা তা নিশ্চিত ছিল। কেননা শরৎচন্দ্রের অরক্ষণীয়া উপন্যাস সর্বাধিকবার পঠিত মেয়েটির!

বৃষ্টি। ছবি সংগৃহীত
বৃষ্টি। ছবি সংগৃহীত


শ্যামলা মেয়েটা ১২ হাত শাড়িতে এক ডজন সেফটিপিন গুঁজে মোটামুটি পূর্ণ যুবতী! অদ্ভুত, এই প্রথম সদলবলে কোনো পূর্ণ যুবককে দেখতে এসেছে সে। যেনতেন কোনো দেখা নয়। আট-দশ জন কাঁচা-পাকা ভদ্রলোকের মধ্যে আট- দশটা মতামত আর পরামর্শ নিয়ে এই দেখা। ভাইয়ের পরামর্শে যুবকের অপরিচিত সতীর্থদের সঙ্গে মেকি হেসে কথা বলতে হলো। বোনের পরামর্শে পা ছুঁয়ে সালাম করতে হলো যুবকের নিকট আত্মীয়দের।
এভাবে অনেকটা সময় অমুকতমুক নানা কিছু হলো রেস্তোরাঁয়। অতঃপর কিছু সময় পর দুই পক্ষের আত্মীয়রা এই আয়োজনের বিল দেবার জন্য এক প্রকার প্রতিযোগিতায়ই নামল। রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক কাম ক্যাশিয়ার জানেন, বিলটা মেয়ের আত্মীয়দের কাছ থেকে নেওয়াটাই সৌন্দর্য। সুতরাং তিনি তা–ই করেন। এ সময় রেস্তোরাঁর কর্মীরা মেয়েটার দিকে চেয়ে মিঠা মিঠা হাসেন।
মেয়েটা খেয়াল করে, আরে, সবার মুখই তো দেখি হাসি হাসি! এমনকি তার বাবারও! ঠিক এই ভাবনার জড়াজড়ি কাটিয়ে ওঠার পরমুহূর্তেই মেয়েটা দেখে, তার আশেপাশে কেউ নেই! আছে শুধু একটা ২৮ বছর বয়সের পূর্ণ যুবক। মেয়েটা ভাবে, কী ব্যাপার?
এতগুলো মানুষ কোন দুরভিসন্ধিতে এই যুবকের সঙ্গে একা রেখে গেল তাকে?
হুমম...ব্যাপার না...অতি আধুনিক যুগের ঢালে বসা মেয়ে আর ছেলেটা কথার তরি ভাসিয়ে দেয়। ছেলেটা কথার দোল দেয়। মেয়েটা উত্তর দেয়। শুধু উত্তর নয়, তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে আরেকটা প্রশ্নের লেজও জুড়ে দেয় ছেলেটাকে।
এভাবে কথা বলতে বলতেই হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যায় তারা দুজনেই। সেই মুহূর্তেই কী যেন সমীকরণ মিলে যায় তাদের। একই বিন্দুতে! তারপরের সময় যেন রকেটযাত্রী; চুমুক দিতেই শেষ হয়ে যায়! আবেগের জড়াজড়ি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আত্মীয় আর সতীর্থরা আশপাশ জুড়ে শুরু করল বিচরণ।
সেই আষাঢ়ে এভাবেই যখন সন্ধ্যা নামি নামি জানান দিচ্ছে, তখনি তাড়া দিল ছেলে-মেয়ে দুপক্ষই। দেখাদেখি শেষ। সুতরাং সবার ঘরে ফেরার পালা। মেয়েটা ঘরে ফেরার জন্য গাড়িতে বসে। তখনি জানালায় দেখে, যুবক আষাঢ়ের বৃষ্টিতে অঝোরে ভিজছে। তাঁর আকাশি রঙের শার্ট ভিজে একাকার! যুবক অনেকটা পথ এসে গেছে মেয়েটাকে বিদায় দিতে।
মেয়েটা কীভাবে ফেরায় তাকে? তার ভালো লেগে যায় ছেলেটাকে। মানে পছন্দ করে ফেলে! আর তাতেই রাস্তার সমস্তটা পথ মেয়েটার চোখে শ্রাবণের ঢল! ছেলেটা এভাবে ভিজল? ঠান্ডা লেগে যাবে না পাগলটার!
বিয়ের পর আবার এলো সেই আষাঢ় মাস। সেদিনও বৃষ্টি; তুমুল বৃষ্টি ঝরছে। উহু! মেয়েটার মনে হচ্ছে আষাঢ়ের বৃষ্টি নয়, যেন ভালোবাসার বৃষ্টি! মেয়েটা সেই বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপ!
মেয়েটা সেদিন কটকটে কমলা রঙের শাড়ি পরেছে। আর আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভেজা পাগলটার
শার্টের কলার ধরে বলছে, ‘আমাদের সে দেখায় ভুল ছিল না, নারে পাগলা?’
ছেলেটা বলল, ‘হুমম, ভুল ছিল না।’
তারা দুজন এক সঙ্গে ঘরে ঢোকে। শ্যামলা মেয়ে ছেলেকে বলে, ‘এবার বাতিটা নেভাও, আসো তোমার আলোয় আমায় দেখি।’
জাহান রিমা
ভ্যালেন্সিয়া কলেজ, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র