শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি ভিজিয়ে দেয় চোখ

আমার স্কুল জীবনের বন্ধু অ্যাডভোকেট আবু তালিব খন্দকার। সে আমার, তার আর বিজয় ভূষণ দাসের একসঙ্গে তোলা একটা ছবি ফেসবুকে দিয়েছে। অনেক পুরোনো ছবি। কতটুকু ভালোবাসা থাকলে ছবি যত্ন করে রাখা যায়। সম্ভবত ১৯৯০ সালের এসএসসি রেজাল্টের আগে তোলা। পরীক্ষার পরের স্মৃতি। কমেন্টসে আবু লিখেছে ছবিটি পেয়ে সে আবেগ আপ্লুত হয়েছে। আর আমি হয়েছি অশ্রুসিক্ত।
কালীগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলে চারটি বছর পড়াকালে আবুর সঙ্গে কিংবা কারও সঙ্গেও এক দিনের জন্য আমার মনোমালিন্য হয়নি। একসঙ্গে কত স্মৃতি। স্কুল বিতর্কে হঠাৎ সিদ্ধান্ত। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দুজন দুই পক্ষ। কালীগঞ্জ থেকে ঘোড়াশালে সাইকেল চালিয়ে ‘অপরাধী’ ছবি দেখতে যাওয়া। স্কুল ফাঁকি দিয়ে আলোঘরে সিনেমা দেখতে যাওয়া। এ জন্য আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় স্বর্গবাসী বিনয় স্যারের মার খাওয়া। প্রতিদিন ভোরে বিনয় স্যারের বাড়িতে পড়তে যাওয়া। ফেরার পথে আবুদের বাড়ির পাশে কোন্দায় চড়ে শালুক কিংবা পানি ফল তুলতে যাওয়া। আমার কৌতুক পরিবেশনা। একই মঞ্চে দুজনের কবিতা আবৃতি। কত স্মৃতি।
আমি পলিটেকনিকে ভর্তি হব। ফরম নিয়ে এসেছি। এক সকালে আব্বা আবুকে বললেন, আবু তুমি বাবুর সঙ্গে যাও দেখ কোথা থেকে ফরম এনেছে। আবু তখন ঢাকা কলেজে। আমি যেখান থেকে ফরম এনেছি সেখানে আবুকে নিয়ে গেলাম। আবু সেখানকার পরিবেশ দেখে বলল, ভালোই, তবে এখানে এত কম ছাত্র কেন। দাঁড়া এখানে এক স্যারের ভাই লতিফ ছাত্রাবাসে থাকে। খুঁজে দেখি। এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করল, লতিফ ছাত্রাবাস কোথায়। ছাত্রটি বলল, লতিফ ছাত্রাবাসতো পলিটেকনিকের। আবু বলল তাহলে এটা কোন টেকনিক্যাল। এবার বাইরে রাস্তায় গিয়ে বিল্ডিংয়ের ওপরের দিকে লেখা ভালো করে পড়লাম। লেখা কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
সেটা ছিল সিরামিকস টেকনোলজি। আবু হাসতে হাসতে লাগল। আর আমি একদম চুপ। তারপর সামনে এগিয়ে গেলাম। হলুদ বিল্ডিং। সেখানে দেখতে পেলাম অনেক ছাত্রছাত্রী। সবাই স্মার্ট। আসলে সেটাই ছিল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। পরে বাসায় গেলাম। বাবাকে ভয়ে কিছু বললাম না। কিন্তু পরদিন পলিটেকনিকের ফরম বিক্রির শেষ দিন। মাকে বললাম। রাতে বাবা অনেক রাগ ও বকাবকি করলেন। আর টাকা দেবেন না। ভোরে দেখি মা ডাকছেন। টাকা দিয়ে বললেন, আবুকে ছাড়া যাবি না।
সেদিন তেজগাঁওয়ের কলমিলতা বাজারের পেছনে একটি মেসে সকালে গেলাম আবুর কাছে। আগের দিন আমাকে সে নিয়ে গিয়েছিল। আবু তখন টিউশনিতে যাবে। তার মেসের এক মাস্টার্স পাস করা ভাইকে সে আমার সঙ্গে দিল। সেই ভাইকে নিয়ে ফরম পূরণ করলাম। ফরমে এক নম্বর চয়েস দিলাম সিভিল। না বুঝে। সেই ভাই বললেন, সিভিল মনে হয় সব ধরনের। পরে জানলাম সিভিল মানে পুরকৌশল বা ইমারত নির্মাণ। এখন মাঝে মাঝে ভাবি সেদিন আবু সঙ্গে থাকলে প্রথম চয়েস হতো ইলেকট্রনিকস, ইলেকট্রিক্যাল বা কেমিক্যাল।

তারপর অনেকবার আবু আমাকে দেখতে গিয়েছে। আমার চাচাতো ভাইবোনদের পড়িয়েছে। সে হয়ে গিয়েছিল আবু স্যার। ছাত্রজীবনে তার চাচার কাছে ইংরেজি শিখেছি। আবুর কাছেও শিখেছি। তার রোল দুই আর আমার ছিল তিন। আবুর পড়াশোনা আরেকটা ইতিহাস। এতটুকু বলি, এখন এই জীবনে যতটা সংগ্রাম করছি, সে তার চেয়ে কয়েক শ গুন সংগ্রাম করছে ছাত্রজীবনে। আবু শুধু বন্ধু নয়, আমার গুরু, শিক্ষক, ফিলোসফার বললেও কম হবে।
একটা ছবি একটা ইতিহাস, হাজারো স্মৃতির ভিড়ে নিয়ে গেল। অদম্য আপসহীন জীবনসংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি বন্ধু আবু তালিব খন্দকার।
এই লেখাটা যখন লিখছি তখন বাসে বাসায় ফিরছিলাম। ৬৭ নম্বর বাসে। এক সময় মাথা উঁচু করে দেখি আমার স্টেশন ছেড়ে চলে এসেছি বহু দূর। বাসায় ফিরতে ঘণ্টা দেড়েক ঘুরে আসতে হবে বাসে। তখন বিরক্তি নয়, ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি আবুর সঙ্গে যাচ্ছি সাইকেল চালিয়ে কালীগঞ্জ থেকে জামালপুর-ঘোড়াশাল। ফিরব অন্ধকার রাতে সাইকেলে আমার অপরিচিত কোনো পথে। বাবা হারিকেন নিয়ে খুঁজবেন আমাকে আড়িখোলা থেকে কালীগঞ্জের পথে। বকবেন আমাকে। আমি বলব, বাবা আমি আবুদের বাড়িতে ছিলাম। সেখানে পড়েছি। বাবা হেসে বলবে আগে বলবিতো!
আবুকে আমার বাবা-মা বিশ্বাস করতেন। কারণ আবু সৎ ও ভালো ছাত্র। ছবিতে মাঝে আবু তালিব। আবুর পড়ার ছোট্ট ঘরে কত ঘুমিয়েছি। তাদের বাড়ি ছিল মুনসেফপুর। রেল লাইনের পাশে। আমার মেয়েদের নিয়ে গিয়েছিলাম ২০১৩ সালে। বন্ধু পারভেজ জাহান গাড়ি দিয়েছিল। কালীগঞ্জ পাইলট স্কুল। শ্রমিক কলেজ। আমাদের বাসা আড়িখোলা রেলওয়ে স্টেশন কোয়ার্টার। শীতলক্ষ্যা নদী। যেখানে একটা বিশাল বটগাছ ছিল। সেই সব দেখাতে নিয়ে যাই।
আবু খবর পেয়ে তুমুলিয়ার ওই দিকে রেল ক্রসিংয়ের কাছে মোটরসাইকেল নিয়ে এসে দেখা করে আমার পরিবারের সঙ্গে। এর আগে ২০০৩ সালে একবার এসএসসি সার্টিফিকেট তুলতে গিয়েছিলাম। আবু সাহায্য করেছিল। ২০১৪ সালে কালীগঞ্জ পাইলট স্কুলের শতবর্ষের পুনর্মিলনীতে শীতের সকালে কুয়াশা ভোরে আমাকে উত্তরা থেকে আবু নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল রাশেদুজ্জামান। অনুষ্ঠানে স্কুলজীবনের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
সময়ের প্রয়োজনে আজ আমরা দূরে। দেখা হলেই মনে হয়, আজও আছি সেই কৈশোরবেলায়। এই লেখা লেখার সময় ফোন পেলাম, পারভেজ জাহান এসেছে সিঙ্গাপুর। সে আমার জন্য নিয়ে এসেছে রান্না করা খাবার। বন্ধু তোদের ঋণ শোধিব কি করে? স্মৃতিরা কাঁদায়। শৈশব–কৈশোরের স্মৃতি বেশি কাঁদায়। ভিজিয়ে দেয় চোখ। বুকে তোলে কাঁপন। কিছু কান্নায় থাকে সুখের আবেশ। কিছু কান্না প্রাপ্তির। কিছু কান্না হারানোর বেদনার। কিছু কান্না ভালোবাসার। হারানো দিনের স্মৃতি করে তোলে নস্টালজিক।