শেষ বিদায়
পৃথিবীতে মানুষের থাকার সময় নির্দিষ্ট নয়। হাতে গোনা কয়েকজন ১০০ বছর দিব্যি কাটিয়ে দেন। বেশির ভাগই চলে যান ষাট থেকে আশির মধ্যে। কিন্তু ষাট পার করে যাঁরা বিভিন্ন অসুস্থতায় আক্রান্ত হন, তাঁরা হাসপাতালে না গিয়েও মৃত্যুভয় পেতে শুরু করেন। তবে কারও হঠাৎ মৃত্যু অনেক বেশি ভয়ংকর। যেমনটা এখন খুব বেশি হয়ে থাকে আমাদের চারপাশে।
খুব কাছের কারও মৃত্যু হলে খুব কাছ থেকে অনুভব করা যায়, মৃত্যু কত বেশি কষ্টের। কিছু দিন আগে আমার মামাতো বোন মৃত্যুবরণ করে, যে বয়সে আমার চেয়ে মাত্র ১৪ দিনের ছোট। কোনোভাবেই মানতে পারছি না ‘অনন্যা’ আর আমাদের মধ্যে নেই। আত্মীয়স্বজন সবার সঙ্গে কী ভালো ব্যবহারই না ছিল তার!
কয়েক দিন পরপরই আমার সঙ্গে কথা হতো। আমার কোনো লেখা এলে সব সময় উৎসাহ দিয়ে বলত, ‘ভাইয়া লেখাটা ভালো হয়েছে, তোমার জন্য দোয়া করি, তুমি অনেক বড় হবে একদিন।’ এই সব, সবকিছু আমার চোখের সামনে ভাসছে। একমুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করতে পারছি না, অনন্যাকে নিয়ে এভাবে লিখতে হবে আমার।
মৃত্যু কী সহজ, কী নিঃশব্দে আসে যে আমরা দেখতেই পাই না।
জীবন ও মৃত্যুর ভেতর খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুটিই সমান সুন্দর, সমান ভয়ংকর।
মৃত্যু জীবজগতের একটি নিয়তি নির্ধারিত অনিবার্য ঘটনা। এর থেকে নিস্তার নেই কারও। এ সত্য সবাইকে একদিন গ্রহণ করতেই হবে। কার মৃত্যু কখন, কোথায় হবে, তা কেউ জানে না। এটা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। হতে পারে তা আজই কিংবা আগামীর যেকোনো দিন।
মৃত্যুভয় মানুষের মধ্যে দূরদৃষ্টি তৈরি করে। মানুষ তখন জীবনকে আর একভাবে চিন্তা করে না। যেকোনো বিষয়ের গভীরে ঢুকে সে জেনে নিতে চায় এর সবটা। তার দেখার চোখ বদলে যায়, ভাবার গতি বদলে যায়। সমাজ সম্পর্কে তার ভাবনা, দেশ সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ হয় একেবারেই ভিন্ন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মৃত্যুর চিন্তাকে ভয় পেয়ে এড়িয়ে যাওয়া মানুষের চেয়ে, মৃত্যুর সম্ভাবনাকে মেনে নেওয়া মানুষেরা বেশি জ্ঞানী এবং তাঁদের জীবনবোধ অনেক উন্নত।
জীবনকে তো আমরা সবাই ভালোবাসি। কিন্তু এই জীবন যে আর চিরকালের নয়, আত্মার ভেতর থেকে এ বোধ যখন মানুষের ভেতর তৈরি হয়, তখন সে জীবনের মূল্য বুঝতে পারে। খেয়াল করে দেখবেন, একজন তরুণ কীভাবে রাস্তা পার হন! আর একজন সংসারী মানুষ কীভাবে সেই একই রাস্তা পেরিয়ে যান।
সংসারী মানুষ হন দায়িত্বশীল। মৃত্যুর ভয় আছে তাঁর। জীবন তাঁর কাছে অনেক দামি। তাই তিনি সাবধানী। আর তরুণ যুবকের ভেতর এসব ভাবনা নেই, পিছুটান নেই। তিনি হন অসাবধানী। মৃত্যুর ভাবনা এমনই। তা জীবনকে আরও অর্থবহ করে। মানুষকে আরও কর্মঠ করে।
এন্ড্রু স্যাক্সের একটা উক্তি আছে, ‘মৃত্যু জীবনের চেয়ে অনেক বেশি সর্বজনীন। কারণ, সবাই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন, কিন্তু জীবনকে অনেকেই কখনোই খুঁজে পান না।’
আজ অনন্যার মৃত্যু নিয়ে ভাবতে গিয়ে এত সব কথা মাথায় এল। আর লিখতে পারছি না। ওপাড়ে ভালো থেকো বোন। আল্লাহ তোমায় জান্নাত নসিব করুন।
লেখক: মো. হাসিবুর রহমান, শিক্ষার্থী এমবিএ, ইউনিভার্সিটি অব মাইসুর, ভারত।