শিষ্টাচারের চর্চা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমি আমার জীবনে কোনো রিকশাওয়ালাকে কখনো সালাম দিয়ে রিকশায় উঠিনি। আবার নামার সময় ছোট্ট করে ধন্যবাদও জানাইনি। ইচ্ছা যে করত না তেমন নয়। তবে বলতে লজ্জা পেতাম। কারণ এই ধরনের প্রবণতা দেশে খুব একটা দেখা যায় না। এবার বাংলাদেশে গিয়ে প্রায় দুই মাস মতো ছিলাম। একজন মধ্যবয়সী রিকশাচালককে দেখে সংকোচ কাটিয়ে তাকে সাহস করে একটা সালাম দিলাম। তিনি প্রথমে থতমত খেয়ে মুখের দিকে চেয়ে থেকে পরমুহূর্তেই সালামের উত্তর দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাচা অমুক জায়গাটাতে যাবেন? তিনি বললেন, জি যাব। তিনি আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে তার ভাড়া মিটিয়ে বললাম, ধন্যবাদ চাচা ভালো থাকবেন। তিনি খুব লজ্জা পেলেন। আমি তাকে বিদায় দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই তিনি আমাকে ডাকলেন—বাপজান শোনেন। আমি ঘুরে তার সামনে দাঁড়াতেই বললেন, আপনি কি করেন? আমি উত্তরে বললাম, চাচা আমি দেশের বাইরে থাকি। ওনার চোখের কোনায় দেখলাম ততক্ষণে অল্প পানি জমে গেছে। বুঝতে পারলাম হয়তো জীবনে এমন করে তার রিকশায় চড়ে কেউ আমার মতো পাগলামি করেননি।
সত্যি বলতে আমাদের সমাজে শিষ্টাচার দেখানো এখন একটা পাগলামির পর্যায়েই চলে গেছে। যখন দেখবেন কেউ সচরাচর এমন আচরণ করবে, সবাই তাকে পাগল সাব্যস্ত করে তাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করবেন। বন্ধু মহলে সে একজন মফিজ বা বলদ নামে পরিচয় লাভ করবেন। যা হোক, রিকশাওয়ালা চাচা শেষ মুহূর্তে তর্জনী আঙুল তুলে আমাকে দেখিয়ে বললেন, আপনি বাজান অনেক ভালো ঘরের সন্তান। দোয়া করি আপনি অনেক বড় হন। এই কথাটা শুনে এবার আমি নিজেই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম। পরিবারের গণ্ডির বাইরের কেউ সম্ভবত আমাকে এভাবে কখনো কোনো দিন নিঃস্বার্থভাবে আশীর্বাদ করেননি।
বাসে করে লম্বা সফর করবেন। বাসের চালক কোনো বিপদআপদ ছাড়াই আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন। বাস থেকে নামার সময় তাকে ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ কি দিয়েছেন? একজন গরিব রিকশাওয়ালার রিকশায় চড়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর রিকশা থেকে নামার পর তাকে কোনো ধন্যবাদ দিয়েছেন? প্রশ্নই আসে না। তাই না? এটা তাদের দায়িত্ব! টাকা নিয়েছে পৌঁছে দিয়েছে। যদি রাস্তার ধারে খালে নিয়ে ফেলে দিত? বেঁচে গেলে লোকজন জড়ো করে পিটিয়ে সোজা করে ফেলতাম! তবুও কৃতজ্ঞতা দেখানো সম্ভব না গিভ অ্যান্ড টেক সম্পর্ক। টাকা দেব জায়গা মতো পৌঁছে দিতে হবে। এর মাঝে কোনো মানবতা, সহমর্মিতা বা কৃতজ্ঞতা থাকতে পারে না!
আসলে আমাদের দেশে এমন সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। অনেকের হয়তো ইচ্ছা করে কিন্তু লজ্জা পান। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন ঠিক আমার মতোই। সংকোচ কাটিয়ে বলতে পারেন না। পাছে লোকে পাগল বলে! শিষ্টাচার জিনিসটি আসলে হঠাৎ করে মানুষ আয়ত্ত করতে পারে না। এর জন্য দরকার হয় দীর্ঘদিনের একটি সুস্থ পরিবেশ ও অভ্যাস। এটা যেমন কেউ মায়ের পেট থেকেও শেখে না আবার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরেও হঠাৎ করে কেউ শিখতে পারেন না। তবে শিষ্টাচারের অভ্যাসগুলো গড়ে তোলার শুরুটা হয় পরিবার থেকে। তারপরে কিন্ডারগার্টেনে। এরই ধারাবাহিকতায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, পরিশেষে কর্মক্ষেত্রে।
জার্মানিতে আমি বাস করছি তিন বছরের ওপরে। শুরু থেকেই দেখে আসছি জার্মানরা প্রতিটা কাজে বা প্রতিটা মুহূর্তে কীভাবে শিষ্টাচারের চর্চা করছেন৷ আমাদের দেশে এমন আচরণ করলে লোকে নির্ঘাত পাগল বলবে নয়তো মফিজ বলবে।
একটি স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষ, সবার মধ্যেই ব্যবহারগত আন্তরিকতার একটা সুস্থ চর্চা দেখতে পাই। আমি এদের এই অভ্যাসটা এতটাই উপভোগ করি যে, খুব ইচ্ছা করে নিজের দেশেও যদি এমন একটা শিষ্টাচারের মধ্যে দিয়ে যদি সমাজটা গড়ে উঠত। তাহলে না জানি কী সুন্দর একটা পরিবেশ আমরা পেতাম! দেশে এমন মানুষও অনেক দেখেছি একটা বাক্যের আগে পিছে একটা গালি না বসিয়ে তারা বাক্য সম্পন্ন করতে পারেন না। এভাবে নিজেরা যেমন অকারণে পাপে লিপ্ত হচ্ছেন আশপাশের মানুষগুলো ভুক্তভোগী হচ্ছেন, পরিশেষে সমাজটাই দূষিত হচ্ছে।
একটা ঘটনা বলি, আমি তখন জার্মানিতে নতুন এসেছি, শপিং মলের দরজা দিয়ে ঢুকব। যেহেতু নতুন এসেছি এদিক সেদিক দেখছি আর অল্প অল্প করে এগোচ্ছি। হঠাৎ সামনে দেখি কোনো এক ব্যক্তি আমার জন্য দরজার পাল্লা খুলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ব্যাপারটা দেখে খুব বিব্রত বোধ করলাম। মনে মনে বললাম, ছি, ছি, আমি ঢুকব তার জন্য উনি দরজার পাল্লা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। এটা কেমন কথা! একটু হাসি দিয়ে ছুটে গিয়ে দরজাটা পার হলাম। তিনি একটু মুচকি হেসে এগিয়ে চলে গেলেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তিনি সম্ভবত গেটম্যান হবেন অথবা মার্কেটের কোনো কর্মচারী। আমার ধারণা ভাঙল একটু এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরে যখন দরজার দিকে তাকালাম। আন্তরিকতার পদ্ধতিটা দেখে আমি চমৎকৃত হলাম। ধরা যাক আপনি কোনো শপিং মলের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন। দেখবেন আপনার আগে যিনি দরজা দিয়ে ঢুকবেন তিনি আপনার জন্য দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যতক্ষণ না আপনি দরজা অতিক্রম করবেন। আপনাকে সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে ডাংকেশোন বা ডাংকে বলে। এটাই এখানকার শিষ্টাচার। জবাবে ওই ব্যক্তিটিও আপনাকে বলবেন বিট্টে (ইউ আর ওয়েলকাম) বলে। এটাও শিষ্টাচার। আবার একই কাজটি আপনার করতে হবে আপনার পেছনে যিনি থাকবেন তার জন্য। এটাও শিষ্টাচার। প্রথম প্রথম হাস্যকর মনে হলেও পুরো ব্যাপারটাতে খুব মজা পেয়েছিলাম।

লেখক
লেখক

জার্মানিতে অপরিচিতদেরও আন্তরিকতার সঙ্গে কিছু একটা সম্বোধন করতে হয়। ব্যাপারটি খুব মজার। ধরা যাক আপনি যে বিল্ডিংয়ে থাকেন আশপাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে আপনি তার নাম-ধাম চেহারা-সুরত কিছুই জানেন না। অথচ যখনই সিঁড়ি ঘরে বা লিফটের সামনে দেখতে পাবেন তখন দুজনের সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় করাটা এখানকার শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে। সকালে দেখা হলে দুজনকেই বলতে হয় গুটেন মর্গেন (গুড মর্নিং) বা দিনের যেকোনো সময় দেখা হলে বলতে হয় হ্যালো বা গুটেন টাগ (গুড ডে)। আবার যে যার মতো প্রস্থান করলে বলতে হয় চুজ (বিদায়)।
সকালে দৌড়ে বাস স্টপেজে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাসটি স্টপেজে দাঁড়াল। চালক বাসের দরজা খুলে দিলেন। ওঠার সময়টাতেও চালকের সঙ্গে কুশল বিনিময় করাটা শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে দুজন দুজনকেই হ্যালো, গুটেন মর্গেন বা গুটেন টাগ (গুড ডে) বলে সম্বোধন করতে হয়। বাস থেকে নেমে যাবেন। যদি বাসের চালকের পাশের দরজা দিয়ে নামেন তখনো আপনাকে চালককে ডাংকেশোন বা চুজ (ধন্যবাদ বা বিদায়) বলে নামতে হবে। এটাও এখানকার শিষ্টাচার।
কর্মস্থলে যখন অফিস রুমের বাইরে করিডর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করি যতবার কলিগদের সঙ্গে দেখা হয় এমনিতে কোনো কথা না বললেও সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় করতে হয়। বরাবরের মতো অন্তত হ্যালো বলতে হয় দুজনকেই। তবে সময় ভেদে গুটেন মর্গেন, গুটেন টাগ বা মাল সাইট (খাবারের সময়) বলতে হয়। মাল সাইট বলার সময়টাও নির্দিষ্ট। এটা বলতে হয় দুপুরের খাবারের সময়ের কাছাকাছি সময়টাতে। এটা বলার উদ্দেশ্য হলো দুপুরের আহার যাতে ভালো হয় সেই জন্য শুভ কামনা করা। এতে কোনো লজ্জা নেই। আন্তরিকতায় নেই কোনো সংকোচ।
কাউকে কিছু দিতে যাবেন, তা যেকোনো বস্তুই হোক। সেখানেও ধন্যবাদ জানানোটা শিষ্টাচারের পর্যায়ে পড়ে। যেমন আমি কাউকে কিছু একটা দিতে গেলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন ডাংকে শোন, ডাংকে বা ফিলেন ডাংকে। এর জবাবেও আমাকে বলতে হলো বিট্টে। এটাও শিষ্টাচার।
যখন ট্রেনে চড়ি। টিকিট চেকার আমাদের টিকিট চেক করার জন্য সামনে আসার পরপরই একটু হাসি দিয়ে বলেন, গুটেন টাগ (শুভ দিন)। তারপরে বলেন দয়া করে টিকিটটা দেখান। তার বলার ভঙ্গিতে কোনো আদেশ থাকে না। থাকে অনুরোধ। টিকিট দেখার পর তিনি আবারও একটু হাসি দিয়ে বলেন, ধন্যবাদ। শুধু একবার–দুবার নয় প্রতিবারই এমনভাবেই ব্যাপারটা হয়ে আসছে। এটাই এখানকার শিষ্টাচার।
আমি কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের দেখেছি তারা টেলিফোনে কথা বলার শুরুতে কীভাবে কুশল বিনিময় করেন এবং ফোন রাখার সময় শেষটা কীভাবে করেন। তাদের কথার দৈর্ঘ্য যদি কয়েক সেকেন্ডের জন্যও হয় তাও শুরুতে গুটেন মর্গেন, গুটেন টাগ বা হ্যালো থাকবে আর রাখার সময় শোনেন টাগ (সুন্দর দিনের প্রত্যাশী), যদি সপ্তাহের শেষ দিন হয় তখন বলে শোনেন ভোখেনএন্ডে (সপ্তাহের ছুটির দিনগুলো সুন্দর যাক এই কামনায়)। অবশেষে আউফ ভিদাজেহেন বা চুজ (বিদায়) বলেন৷ এখানে উল্লেখ্য, তিনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, গড়গড় করে হলেও এই কথাগুলো বলবেনই। এমনকি যখন সুপার মার্কেটে বাজার করতে যাই, তখনো দেখেছি ক্যাশের ব্যস্ত কর্মীরাও গড়গড় করে এই কথাগুলো বলছেন। তিনি যতই ব্যস্ত থাকুন বা যতই ক্রেতার ভিড় লেগে থাকুক। প্রতিটা ক্রেতাকেই এভাবে সম্বোধন করবেন। দুই–তিন সেকেন্ড লাগলেও গড়গড় করে পড়া মুখস্থ করার মতো করে হলেও বলবেন। এর বিপরীতে আমাকেও অবশ্য তাকে বিদায় জানাতে হয়। এটাও শিষ্টাচার। আমি যত দুর এখানকার মানুষদের দেখেছি কারও মুখে এখনো গালি জাতীয় শব্দটা শুনিনি। এরা খুব বিরক্ত হলে শুধু বিরক্তিকর মুখ করে শাইছে (ওহ শিট) বলে ওঠেন৷ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বয়স, ধনী-গরিব বা সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই সমান। মুচি, মেথর, ডোম, অফিসের কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেট পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে আপনি শনাক্ত করতে পারবেন না যে, কে কোন পেশাতে আছেন।
একবার ভাবুন তো আমাদের দেশেও যদি মানুষগুলো এভাবেই প্রতিটা মানুষের সঙ্গে এমন আন্তরিক হতেন, সমাজে শিষ্টাচারের যদি চর্চা হতো, কত সুন্দরই না লাগত আমাদের সোনার বাংলাদেশটা।

মাহবুব মানিক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।