
চঞ্চলতাই শিশুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। শিশুরা যখন-তখন হাসবে, খেলবে, দুষ্টুমি করবে, হইচই করবে, সমবয়সী ও সহোদরদের সঙ্গে ঝগড়া করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ভাবনার বিষয় হলো যদি শিশুর এই চঞ্চলতা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছায় এবং তার কারণে শিশুর দৈনন্দিন জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
স্কুলে বারবার সমস্যায় পড়ছে ম্যাথিউ। ক্লাসে মনোযোগ নেই, কোনো টাস্ক সম্পন্ন করে না, অসমাপ্ত রেখেই ছেড়ে দেয়। ক্লাস নিয়ম মেনে চলে না। সারাক্ষণ অস্থির থাকে। অতি অস্থিরতার কারণে প্রায়ই চেয়ার থেকে পড়ে যায়, এটা-সেটা হাত থেকে ফেলে দেয়। পরীক্ষায় রেজাল্ট তেমন ভালো না। ম্যাথিউ সব সময় যেন স্বপ্নের জগতে বাস করে। উত্তেজনাপূর্ণ সবকিছুতেই তার আকর্ষণ। শিক্ষকেরা সব সময় তার অমনোযোগ ও লাফালাফির কারণে বিরক্ত। প্রায়ই শিক্ষকেরা ম্যাথিউর মা-বাবাকে অভিযোগ লেখেন। ম্যাথিউর মা-বাবা সন্তানের এমন আচরণে চিন্তিত।
ওপরে বর্ণিত ম্যাথিউর সমস্যাটিকে বলা হয় এডিএইচডি (অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার)। এডিএইচডি সাধারণ মানসিক ব্যাধিগুলোর একটি। এটি মস্তিষ্কের মনোযোগ-সংক্রান্ত এক অসুস্থতা। Attention Deficit মানে মনোযোগের অভাব, আর hyperactivity মানে অতি চাঞ্চল্য। এডিএইচডি মূলত শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়, তবে শিশুদের ছাড়াও অনেক প্রাপ্তবয়স্কের এই ব্যাধি প্রভাবিত করে। এডিএইচডির মূল তিনটি উপসর্গ হলো ইন-অ্যাটেনশন (মনযোগ রাখতে সক্ষম নয় এমন), হাইপারঅ্যাকটিভিটি (প্রয়োজনের তুলনায় অতি-সক্রিয়) এবং ইম্পালসিভিটি (চিন্তা ছাড়াই দ্রুত ঘটে এমন কাজ)। এই রোগে সাধারণত শিশুদের মধ্যে অন্যমনস্কতা, অতিরিক্ত চঞ্চলতা, অস্থিরতা, দস্যিপনা ও অতি আবেগের সমস্যা দেখা দেয়৷ এতে শিশুরা অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অনিদ্রা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা ইত্যাদি সমস্যায় ভোগে। মনোযোগের অভাব ও প্রয়োজনের চেয়ে অতি-সক্রিয় হওয়ার দরুন শিশুরা তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও কেতাবি শিক্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হ্যাম্বার্গ ইউনিভার্সিটির শিশু ও কিশোর মনোবিজ্ঞানী এবং সাইকোথেরাপিস্ট অধ্যাপক মিশেল শুলটে-মার্কউর্ট বলেন, ‘এডিএইচডি রোগীদের মনের ভেতরটা উত্তেজনায় ভরা থাকে৷ তারা বেশ মনোযোগী হয়৷ তবে একটা কাজ পুরোপুরি শেষ করতে পারে না৷ কারণ হঠাৎ করে নতুন কিছুর আবির্ভাব হলে তারা আবার সেই কাজটায় লেগে যায়৷’
হাইপার অ্যাকটিভ শিশুদের কিছু কমন আচরণ হলো তারা একাধিক কাজ একসঙ্গে করতে চায়, সারাক্ষণ অস্থির-ছটফট করে, নির্দিষ্ট স্থানে এক মিনিট বসে থাকা তাদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। বসলেও অনবরত পা নাড়াতে থাকে, টেবিল চাপড়াতে থাকে, খুব দ্রুত কথা বলে এবং দ্রুত রেগে যায়। ইন-অ্যাটেনশন শিশুদের আচরণে অমনোযোগ বিশেষ লক্ষণীয়। তারা একটা কাজ অসম্পূর্ণ রেখে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাজে খুব দ্রুত জাম্প করে। চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে হেঁয়ালিপনা থাকে, যেকোনো কাজে অমনোযোগী হয়। অসাবধানতার কারণে বারবার ভুল করে, নিয়মকানুন অনুসরণ করতে পারে না, অন্যমনস্ক থাকে এবং কোনো তথ্য মনে রাখতে পারে না। ইম্পালসিভ শিশুদের ক্ষেত্রে কমন আচরণ হলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা। ওরা অধৈর্য হয় এবং কোনো কিছু করার আগে ফলাফল সম্পর্কে ভেবে নেয় না। অন্যের কথার মাঝখানে বিঘ্ন ঘটানো ওদের আচরণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
অতীতে এডিএইচডির সঙ্গে জিনগত সম্পর্কের কথা বলা হলেও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ‘মলিকিউলার সাইকিয়াট্রি’ বিভাগের অধ্যাপক রয় পেরলিসের গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় মানসিক রোগের ওষুধ সেবন বাচ্চার এডিএইচডি হওয়ার পেছনে বহুলাংশে দায়ী। এডিএইচডির কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এর নির্দিষ্ট কারণ নির্ণয় এখনো সম্ভব হয়নি। তবে আপাতদৃষ্টিতে গবেষকেরা মনে করছেন, শরীরে জিংকের ঘাটতি ও শিশু খাদ্যের সঙ্গে মেশানো কৃত্রিম রং এডিএইচডি জন্ম দিতে পারে। অপুষ্টিজনিত কারণে এবং বংশগত কারণে শিশুর মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে। আবার গর্ভাবস্থায় ধূমপান, কোনো প্রকার মাদক সেবন বা অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবন থেকেও শিশুর মধ্যে এডিএইচডি দেখা দিতে পারে।
মনে রাখতে হবে যে এডিএইচডিতে আক্রান্ত শিশুদের জন্য নিজের আবেগ ও আচরণ দমন করা বেশ কঠিন। অর্থাৎ, কোনো কাজ করার আগে তারা পরিস্থিতি বা কাজের ফলাফল বিবেচনা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুকে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করতে হলে, পারিবারিক সহযোগিতা একান্ত জরুরি। কোনো শিশুর মধ্যে এমন আচরণগত সমস্যা যদি ছয় মাসের বেশি স্থায়ী হয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বয়স অনুযায়ী শিশুর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুর যথাযথ পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। দিনের পরিকল্পনা করা বিশেষ জরুরি; যেন শিশু বুঝতে পারে তার কাছে কী আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কী ধরনের আচরণ আশা করা হচ্ছে তা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ইতিবাচক আচরণকে তাৎক্ষণিক পুরস্কার বা প্রশংসার মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে হবে। বিভ্রান্ত না করে সুস্পষ্টভাবে শিশুকে নির্দেশনা দিতে হবে। শিশুকে পরিবারের বাইরেও মেলামেশার সুযোগ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশু আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলে। সে ক্ষেত্রে শিশুর খেলা বা মেশার সময়কে সংক্ষিপ্ত রাখতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য শিশুকে শারীরিক ব্যায়ামে অভ্যস্ত করতে হবে।
এডিএইচডি নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে আমাদের মনে। অনেকেই ভাবেন এডিএইচডির সঙ্গে অন্য কোনো মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার সম্পর্ক নেই। কিন্তু সত্যটা হলো, এডিএইচডিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের যদি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হয়, তবে পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য সমস্যাগুলো হলো কনডাক্ট ডিসঅর্ডার (আচরণগত সমস্যা), মুড ডিসঅর্ডার (মেজাজ-মর্জিগত সমস্যা), অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার(মানসিক উদ্বিগ্নতা) এবং (লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি) শেখার অক্ষমতা। হাইপার অ্যাকটিভ বাচ্চা মানেই সে এডিএইচডিতে আক্রান্ত, এমন ধারণা সঠিক নয়। বাচ্চারা চঞ্চল হবেই। তবে সেটা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তবে এডিএইচডি নিশ্চিত করতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। এডিএইচডি দূর করতে ওষুধই একমাত্র সমাধান বলে মনে করেন অনেকে। এটা ভুল। সাধারণত এডিএইচডির ওষুধগুলোর প্রভাব ছয় ঘণ্টা থেকে আট ঘণ্টা স্থায়ী হয়। কাজেই ওষুধের পাশাপাশি সমস্যার কার্যকরী চিকিৎসা হিসেবে আচরণগত ও জীবনযাত্রাগত নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে।
আপনার শিশু আপনার ভবিষ্যৎ। তাকে সময় দিন, পাশে থাকুন, তার আচরণ সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করুন। যদি তার আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেন, ডাক্তারের পরামর্শ নিন। তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিবর্তন করতে সহায়ক হিসেবে আপনি প্রধান ভূমিকা পালন করুন। ডাক্তার ও স্কুল মাস্টারদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আপনার শিশুকে সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বা চেষ্টা করতে সাহায্য করুন। প্রায় সব শিশুর মধ্যেই কমবেশি এডিএইচডির প্রভাব রয়েছে। শিশু মানেই দুরন্তপনা; শিশু মানেই চঞ্চল, উৎফুল্ল। এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে আপনার শিশুটি যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়।
এডুকেটর, ফ্লাশিং, নিউইয়র্ক