হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না—বাংলা এই প্রবাদটি বহুল প্রচলিত। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত এই নীতির বাহবা অনেক সময়ই দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সেই বাহবা পাওয়ারও একটা সীমা আছে। হুকুম যতক্ষণ ন্যায়বিচারের পক্ষে থাকে, ততক্ষণই তা বাহবা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু তা যদি অনাচারের সমার্থক হয়ে ওঠে, তা হলে নিন্দার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই ‘অবৈধ অভিবাসনের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এই চটকদার প্রচার মার্কিন ভোটারদের কাছে আদৃত হয়েছিল, যে কারণে তিনি আজ ওয়াশিংটনের সাদা বাড়িটির বাসিন্দা। কিন্তু এই অবৈধ অভিবাসন সমস্যা বর্তমান বিশ্বে কোন ‘রাজনৈতিক’ রাষ্ট্রের নেই? সবাই কম-বেশি আক্রান্ত। অপেক্ষাকৃত উন্নত রাষ্ট্রে একটু ভালো থাকার আশায় মানুষ অভিবাসী হবে—এটাই স্বাভাবিক। সীমানা ও আইনের বেড়াজালে তাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হতেই পারে। তাই ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই বলে চিল চিৎকার শুরু করতে হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অভিবাসীদের বিরুদ্ধে আইনি স্বীকৃতি না থাকার অভিযোগে নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করেছেন। ওবামার আমলে গৃহীত জনপ্রিয় ডাকা কর্মসূচি বাতিলের সব চেষ্টা করেছেন। এখনো ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’ মেনে নিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের সব নির্মমতাকে ছাপিয়ে গেছে মেক্সিকো সীমান্তে মা-বাবার কাছ থেকে শিশুদের বিচ্ছিন্ন করে খাঁচার ভেতর ‘পশুদের’ মতো আটকে রাখার ঘটনা। আটক এই বিচ্ছিন্ন শিশুদের বিরামহীন কান্নায় এই প্রশ্ন ভেসে এসেছে, ট্রাম্প বা তাঁর পারিষদেরা কি কারও বাবা নন; আমেরিকার নীতিনির্ধারকদের মধ্যে থেকে কি সব ধরনের মানবিক গুণাবলি লোপ পেয়েছে?
এত হতাশার মধ্যে আশার আলো, মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। রিপাবলিকানদের মধ্যে থেকেও প্রতিবাদ উঠে আসছে। বিরোধিতা আসছে প্রেসিডেন্টের নিজের ঘর থেকেও। ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্পও তাঁর স্বামীর প্রশাসনের এই নীতিকে অগ্রহণযোগ্য ও হৃদয়বিদারক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে ঘরে-বাইরে তীব্র বিরোধিতার পরে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা শুরু হয়েছে, এটা ওবামার আমলের গৃহীত নীতি, তারা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র। কিন্তু এই দাবি পাত্তাই পায়নি।
এই চরম অমানবিক নীতির পক্ষে সাফাই গাইতে পবিত্র বাইবেল থেকে মিথ্যা উদ্ধৃতি দিতে বাধেনি তাদের। কিন্তু আমেরিকার খ্রিষ্টান নেতারা অবশ্য সে দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ঈশ্বর কোনো পরিবার বিভক্ত করার পক্ষে নন। ঈশ্বর চান, প্রতিটি পরিবার একত্রে থাকুক। স্বয়ং পোপ ফ্রান্সিস ট্রাম্প প্রশাসনের এই অভিবাসন নীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, বিশ্বব্যাপী অভিবাসন সমস্যার মোকাবিলায় এই সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের পন্থা কোনো কিছু হতে পারে না।
শিশুদের প্রতি এই চরম অনৈতিক ব্যবহারের সমালোচনা সারা বিশ্ব একসুরে করলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা যেন কানে তুলো গুঁজে বসে ছিলেন। শেষমেষ ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিশুদের তাদের বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে না। এখন থেকে তারা একই খাঁচায় বন্দী থাকবে। তার পরেও এই মহামহিমদের আচরণে বিভ্রম জাগে, মানুষের জন্য আইন না আইনের জন্য মানুষ।