শহীদ কাদরী ও একটি কবিতা খোঁজার গল্প

পত্রিকার পাতা খুলেই চক্ষু স্থির হয়ে যায়। একটি ছোট্ট বিজ্ঞাপন। ‘একটি কবিতা খুঁজছি’। চমকে উঠি। বিজ্ঞাপন দিয়ে কবিতা খুঁজতে হয় ! হ্যাঁ, কবি শহীদ কাদরী তাঁর একটি কবিতা হারিয়ে ফেলেছেন! সেটি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিজ্ঞাপনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘তোমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ শিরোনামে একটি কবিতা হারিয়ে ফেলেছেন কবি শহীদ কাদরী। তাঁর কাছে পাণ্ডুলিপি নেই। যদি কারও কাছে কবিতাটি থেকে থাকে তাহলে দয়া করে নিচের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করুন।
আমি অপেক্ষা করার মানুষ নই। অফিস থেকে ফিরেছি। নিউইয়র্ক সময় তখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ফোন তুলে কল করি। একজন ভদ্রমহিলা ফোন ধরেন। আমার কণ্ঠস্বর তাঁর খুব অপরিচিত নয়। তাই নিজের স্বর ও কণ্ঠ বদল করে কথা শুরু করি। বলি, আপনার পোস্টাল অ্যাড্রেস দিন। কবিতাটি পাঠিয়ে দেব। তিনি চমকে ওঠেন। ওই সাপ্তাহিক খবরের কাগজটি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই বেরিয়েছে। এত চটজলদি তিনি রেসপন্স পাবেন ভাবেননি। তিনি বলে ওঠেন, ‘আপনি কে ভাই !’ আমি বলি, ‘তা দিয়ে কী দরকার ! কবিতাটি আগে পাঠাই।’ তিনি অ্যাড্রেস দেন। আমি পরের দিনই কবিতাটি মেইল করে দিই।
দু দিন পর আবার ফোন করি। বলি, ‘কবিতাটি কি পেয়েছেন? তিনি এবার বসেছিলেন খুব তৈরি হয়ে। বলেন, ‘ইলিয়াস ভাই, আর কত লুকাবেন নিজেকে?’
এবার আমিও বুঝে যাই তিনি কলার আইডিতে আমার নাম দেখেই ফোনটি ধরে আমাকে তাক লাগিয়ে দিলেন!
‘ধরুন-আপনার শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলুন’, বলেই কবির হাতে ফোন তুলে দেন
নীরা কাদরী। শহীদ ভাই হো হো করে হেসে ওঠেন। ‘আরে মিয়া, নিজেরে আর কত লুকাবা? বিদেশে তো লুকিয়েই আছ।’
‘আমি জানতাম ইলিয়াস। তোমার কাছে এই কবিতাটি থাকবে’, বলেন শহীদ কাদরী।
আমি বলি, ‘জি শহীদ ভাই, এটি তো আপনি আমাদের বিয়ের স্মারকে দিয়েছিলেন, মনে আছে ?’
‘না, অতশত মনে থাকে আর ইলিয়াস! আর কত রে ভাই!’
আমি বলি, ‘ডোন্ট ওয়ারি, লং ওয়ে টু গো।’
তিনি হাসেন।
॥ দুই ॥
তিনি তখন বোস্টনে থাকেন। আমি বোহিমিয়ান মানুষ। শহীদ ভাই সব সময় চাইতেন, আমার একটা জীবন হোক। যে জীবন কবির, যে জীবন মানবতার।
১৯৯২ সালের শেষদিক। বললাম, ‘শহীদ ভাই দেশে যাচ্ছি। বিয়ে করব।’ বলেন, ‘ইয়ে তো বড়ি খুশি কি বাত ভাইসাহাব!’ তিনি মাঝে মাঝে এভাবেই মশকরা করতেন। বললাম, ‘কবিতা দিতে হবে’। বললেন, ‘জরুর দেঙ্গে’।
এই কবিতাটি দিয়েছিলেন আমাকে, যা ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ আমাদের বিয়ের স্মারক ‘মোহনা’য় ছাপা হয়। কী লিখেছিলেন তিনি তাঁর ওই কবিতায়? পাঠক আসুন, কবিতাটি আরেকবার পড়ি।
হে নবীনা, এই মধ্য-ম্যানহাটনে বাতাসের ঝাপটায়
তোমার হঠাৎ খুলে যাওয়া উদ্দাম চুল
আমার বুকের ’পর আছড়ে পড়ল
চিরকালের বাংলার বৈশাখের ঝঞ্ঝার মতন।
তোমার জবার মতো চোখে রাঙা শ্রাবণের জল
পালতোলা নৌকার মতন বাঁকাচোরা ঢেউয়ে ঢেউয়ে কম্পমান
তোমার বিপদগ্রস্ত স্তন।
আমি ভাবতে পারিনি কোনো দিন এত অসাধারণ আগুন
প্রলয় এবং ধ্বংস রয়েছে তোমার চুম্বনগুলিতে।
হে নবীনা,
আমার তামাটে তিক্ত ওষ্ঠের ও অবয়বের জন্যে
যেসব চুম্বন জমে উঠবে সংগোপনে,
তাদের ওপর থেকে আমার স্বত্বাধিকার আমি ফিরিয়ে নিলাম
আমাকে শীতের হাওয়ার হাতে ছেড়ে দাও,
স্বনির্বাচিত এই নির্বাসনে
নেকড়ের দঙ্গলের মতো আমাকে ছিঁড়ে খাক বরফে জ্বলতে থাকা ঋতু
শুধু তুমি,
আমার সংরক্ত চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে
পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান
বিব্রত বাংলায়,
বজ্রে, বজ্রে, বেজে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার।
[‘আমার চুম্বন গুলো পৌঁছে দাও’ , শহীদ কাদরী ]
কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বন গুলো পৌঁছে দাও’ বের হয় ২০০৯ সালে। কবি, কবিতাটির নাম পরিবর্তন করে বইয়ের নামকরণ করেন। ওই কাব্যগ্রন্থটিতে শহীদ কাদরী আমার নাম উল্লেখ করে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। বইটি প্রকাশে প্রচুর শ্রম দিয়েছিলেন বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত।
শহীদ কাদরী ছিলেন আজন্ম দেশপ্রেমিক কবি। এই কবিতাটিও তারই সাক্ষ্য বহন করছে। তিনি বলছেন,
‘আমাকে শীতের হাওয়ার হাতে ছেড়ে দাও,
স্বনির্বাচিত এই নির্বাসনে
নেকড়ের দঙ্গলের মতো আমাকে ছিঁড়ে খাক বরফে জ্বলতে থাকা ঋতু’
হ্যাঁ, স্বনির্বাচিত নির্বাসনই নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে দেশ ছেড়ে আসেন। না, দেশ তাঁকে আর ডাকেনি। কিন্তু তা'তে কি ! তারপরও তিনি বলেছেন,
আমার সংরক্ত চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে
পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান
বিব্রত বাংলায়,
বজ্রে, বজ্রে, বেজে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার।
কবি শহীদ কাদরী বারবার স্বদেশের তাবেদারি করেছেন বিদেশে থেকেও। তাঁর ভালোবাসায়, তাঁর দ্রোহে তিনি জিইয়ে রেখেছেন বাংলার পলিমাটি। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ঘুরে ফিরেই কথা হতো কবিতা নিয়ে। তিনি বলতেন, কবিতায় আমি আমার সাম্রাজ্য খুঁজে পাই। ইটস মাই কিংডম। তিনি বলতেন, আধুনিক কবিতা শুধু অন্তর্মুখী নয়, বহির্মুখী। জাগতিক অনেক পাওয়া-না পাওয়ার হিসেবে আমরা কাব্যজগত ও ভাবনার সঙ্গে মেলাতে পারি।
তাঁর বক্তব্য ছিল খুবই স্পষ্ট। তিনি বলতেন, রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে চাই, ‘কবিতা লিখে কিছুই হয় না। কবিতা মননকে শাণিত করে। কবিতা নান্দনিক শিল্পবোধকে জাগ্রত করে। আর মানুষ বেঁচে থাকে সেই শিল্পসত্তার সঙ্গী হয়ে।’
শহীদ কাদরী বলতেন, কেউ যদি কবি হতে চায় তাকে দশ বছর শিল্প-সাহিত্য পড়েই পাঠে আসা উচিত। তাঁর বক্তব্য ছিল, কবিকে অবশ্যই শব্দ ভালোবাসতে হবে। কারণ নতুন শব্দের ব্যবহার কবির নিজের চিত্রকল্প নির্মাণে সাহায্য করে। ওই কবিকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে সহায়ক হয়। একটি প্রশ্নের জবাবে কবি জানিয়েছিলেন, বাংলা কবিতার চক্র এখনো শেষ হয়ে যায়নি। ভাব ও ভাবনার দিক থেকে ১৪০০ শতকে ইতালিতে কাব্যশিল্পের যে বিকাশ হয়, তা আমরা এখনো দেখে যাচ্ছি। এখনো নব নব দিক উন্মোচিত হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। নতুন কিছু নির্মাণের আগে পুরোনোকে ভালোভাবে ধারণের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
মনে পড়ছে, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ আমার উপস্থাপনায় ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠানের আড্ডা পর্ব হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে নিজের একগুচ্ছ কবিতা পড়েছিলেন কবি শহীদ কাদরী। তাঁর ভরাট কণ্ঠ আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি আসলেই কবিতার বরপুত্র। প্রমাণ করেছিলেন তিনি কবিতার মহানায়ক। কবিতা তাঁর বশ্য আকাশ। দর্শক-শ্রোতারা দেখেছিলেন সেদিন তাঁর কণ্ঠে কবিতার কারুকাজ। শুনেছিলেন তন্ময় হয়ে। কবিতার প্রতি এই দরদ প্রমাণ করেছিল, কবিতা এখনো মানুষে মানুষে ভালোবাসার অমর সেতু।
একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি শহীদ কাদরী বলেছিলেন, ‘আমি আমার সময়কে ধারণ করেছি আমার সকল সাধ্য দিয়ে। আমি কবিতাকে আরাধনা মনে করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমরা অনেক হত্যাকাণ্ড দেখেও না দেখার ভান করেছি। কবিতায় বলেছি, আইখম্যান আমার ইমাম। যা ছিল একান্তই প্রতীকী।’ তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘আপনি কি জানতেন আপনি উড়াল জীবন কাটাবেন?’ জবাবে কবি বলেছিলেন, ‘না তা ভাবিনি। তবে জীবন বহমান। এখন ভাবি উড়াল দিয়েই তো জীবন কাটিয়ে দিলাম।’ ‘কবিও কি বৈরাগী কিংবা চির বিরহকামী?’ এই প্রশ্নের উত্তরে কবি শহীদ কাদরী বলেছিলেন, ‘কবি কখনো বিরহকামী, কখনো মিলনকামী। এটাতো প্রাণেরই চাওয়া-পাওয়া।’
তাঁর সমসাময়িক কবিদের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই উদার। তাঁর আয়োজিত ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’য় তিনি বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবিদের কবিতা পড়াতেন। পড়াতেন অনুজ কবিদের কবিতাও। একটি অনুষ্ঠানে তিনি কয়েকজন আবৃত্তিকার দিয়ে পড়িয়েছিলেন আল মাহমুদের কবিতা। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘কবি আল মাহমুদের কবিতা, বাংলা কবিতার শত শত বছরের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তৈরি করেছে নতুন বাঁক। তাঁর কবিতার গীতল ধারা আমাদের সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।’
কবিতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে শহীদ কাদরী বলেছিলেন, ‘আবিদ আজাদ তাঁর কর্মের তুলনায় বেশি আলোচিত হননি। অকালপ্রয়াত এই কবির “খেলনা যুগ” কবিতাটি শহীদ কাদরী নিজেই পাঠ করে বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্য কেন গোটা বিশ্ব সাহিত্যে এমন চমৎকার কবিতা লিখিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তিনি আবিদের কবিতা আরও পঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
শহীদ কাদরী আবুল হাসানের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, আবুল হাসান জানত সে বেশি দিন বাঁচবে না। তারপরও কবিতার প্রতি তাঁর বোহিমিয়ান প্রেম আমাদের সে সময়ে আপ্লুত করত। তাঁর কবিতার মেজাজ ও তেজ আমাদের চিরকাল শাণিত করে যাবে।
কবির চিরবিদায়ের এক বছর হয়ে গেল। তিনি শান্তিতে ঘুমিয়েছেন। অন্য কবিদের নিয়ে এমন কথাগুলো কে বলবে?