শখ হতে পারে স্বস্তির একটা জায়গা

ছোটবেলা থেকেই আমার কয়েন সংগ্রহের শখ। আমার দাদার একটা কাঠের ছোট কয়েনের বাক্স ছিল, যেটা কালক্রমে আমার হাতে এসে পড়ে অনেক ছোটবেলায়। তখন সবে স্কুলে পড়ি। সেই বাক্সে কিছু পাকিস্তান আমলের পয়সা ছিল। তেমন আহামরি কিছু না, ৫, ১০, ২৫ ও ৫০ পয়সা, এইরকম অল্প কিছু। সেখান থেকেই বোধ হয় আমার এই শখের শুরু।
আমার চাচা একসময় কর্মসূত্রে দুই বছর জাপান ছিলেন। তিনি চিঠি লিখতেন বাসায়। আমরাও তাকে লিখতাম। সেই চিঠির খাম থেকে স্ট্যাম্প তো পাওয়া যেতই—আমার পাঠানো অল্প কিছু লাইনের চিঠিতে আবার বিশেষভাবে অনুরোধ থাকত কয়েন পাঠানোর। ফিরতি চিঠিতে আসত ১, ৫ ও ১০ ইয়েন। ৫ ইয়েনের কয়েন আবার ফুটোওয়ালা। সেগুলোও প্রথম দিকে বেশ উৎসাহ দিত সংগ্রহ চালিয়ে যেতে।
তখন ছিল পেন ফ্রেন্ডশিপের যুগ—মানে হাতে লেখা চিঠির মাধ্যমে বন্ধুত্ব। এখন ইন্টারনেট আর ইমেইলের সময়ে এটা বিশ্বাস করা বোধ হয় একটু কষ্টকর যে, তখন কিছু ছোট ছোট বই কিনতে পাওয়া যেত বইয়ের দোকানে। যেখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বয়সের অনেকের নাম ঠিকানা থাকত, যারা পেন ফ্রেন্ডশিপ করতে আগ্রহী। সেইরকম একটা বই আমার ফুপাতো বোন নাহিদ আপুর কাছে ছিল। সেই বইয়ের মাধ্যমে সম্ভবত পেরু আর ফিলিপাইনের কোনো ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে তার পেন ফ্রেন্ডশিপও ছিল। একদিন একটা চিঠিতে আপু বাংলাদেশের একটা নোট বা কিছু পয়সা পাঠান। পরবর্তীতে সেই ফিলিপাইনের ফ্রেন্ডও তাকে একটা নোট পাঠায়। মনে আছে দুই পেসোর একটা নীলচে নোট। পরবর্তীতে সেটা আমার হস্তগত হয়। সেটা ছাড়াও সম্ভবত পেরুর দুটি কয়েনও একইভাবে চিঠির মাধ্যমে পেয়েছিলাম। আবার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়েছিল সপরিবারে স্থলপথে ভারত যাই যখন। তখন সেই দেশের কিছু নোট আর কয়েনও সংগ্রহ করা হয়। একসময় ধীরে ধীরে এই শখটা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।

পুরোনো ঢাকার ইমামগঞ্জে বড় ফুপুর বাসা। একবার ফুপাতো বোনের কাছে খরর পেলাম ইমামগঞ্জের ভাঙ্গারি দোকানগুলোতে মাঝে মাঝেই সেই ব্রিটিশ ও সুলতানি আমলের কয়েন পাওয়া যায়। যেই না জানা, সেই থেকে শুরু হয় সেই দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে পয়সা খোঁজার অভিযান। কয়েন সংগ্রহ করবার জন্য কত যে চষে বেরিয়েছি চকবাজার, ইমামগঞ্জের ও মিটফোর্ডের অলিগলি। তখন অল্প বয়স, স্কুলের গণ্ডি পার হচ্ছি বা হয়েছি মাত্র। তার ওপর অত সিরিয়াস কালেক্টরও না। কখনো বের হতাম একা, কখনো সঙ্গে বন্ধু পলাশ। একেকটা দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করি পুরোনো কয়েন পাওয়া যাবে কিনা। কেউ বলেন নাই, কেউ বলেন আছে, তুমি কিনতে পারবে না। কেউ কেউ আবার আগ্রহ ভরে দেখান যা আছে তাদের কাছে। হাতে তখন টিফিনের, না হয় টিউশন করে জমানো টাকা। খুব অল্পই। দুই-একটা ব্রিটিশ পিরিয়ডের এক আনা, আধ আনা, সোয়া আনা, স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের ৫, ১০, ৫০ পয়সা কিনতাম। যত দূর মনে পড়ে ১০-২০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যেই থাকত দাম। আবার চকবাজারের দোকান থেকে কিছু ব্রিটিশ (অবিভক্ত) ভারতের কিছু নকল কয়েন কিনে ঠকিনি এমনও না। তবে সেগুলোও ফেলে দিইনি কিন্তু এখনো। এভাবে আস্তে আস্তে সংগ্রহ বাড়তে থাকে আরও। পরে একসময় কয়েনের পাশাপাশি ব্যাংক নোটের ওপরও বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়।
আমার সব সময়ই obsolete currency, মানে যেগুলো তখন আর বাজারে চলে না; Monetary ভ্যালু নেই, কিন্তু কালেক্টেবল ভ্যালু আছে, সেগুলো বেশ মন কাড়ে। ব্রিটিশ সময় ও স্বাধীনতার আগের সময় থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরপর বের হওয়া যে নোটগুলো কখনো নিজে চলতে দেখিনি, খরচ করিনি, আগ্রহ সেইগুলোর ওপরই সবচে বেশি ছিল আমার সব সময়। ফেসবুক বেইসড এত গ্রুপতো তখন ছিল না। অনলাইন মার্কেটপ্লেস তখনো বাংলাদেশে একাবারেই নতুন। মুদ্রা সংগ্রহ করা তখন এখনকার চেয়ে অনেক কঠিন। seradam.com (এখন বোধ হয় আর নেই) ও পরবর্তীতে clickbd.com,cellbazaar.com-এ মাঝে মাঝেই ঢুঁ মেরে দেখতাম কী পাওয়া যায়। সেই সময় সায়েন্স ল্যাবের কাছে নিউ এলিফ্যান্ট রোডের কোনায় দোতলায় ‘প্যাসিফিক স্ট্যাম্পস’ নামের একটা স্ট্যাম্পের দোকান ছিল—লর্ডস হেয়ার ড্রেসারের ঠিক পাশেই (এখন আর নেই)। সেখানে স্ট্যাম্পের পাশাপাশি কিছু কয়েনও পাওয়া যেত—বেশির ভাগই রুপার।

ছোটবেলায় দাদির মুখে শুনতাম তারা সোনার মোহর, রুপার টাকা (তিনি বলতেন কাঁচা টাকা) দেখেছেন। আর আমার কাছে সেই রুপার টাকা তখন স্বপ্ন। সেই দোকান থেকে তখন থেকে ব্রিটিশ ভারতের ১ রুপি (রানি ভিক্টোরিয়া) কিনে ফেললাম একদিন একটু সাহস করে, ১৮৮৬ সালের। যত দূর মনে পড়ে ৩৫০ টাকা ছিল দাম। সেটা ছিল আমার তখনকার সবচে দামি কয়েন। আমি টিউশনি করতাম ক্লাস এইট বা নাইন থেকে। কখনো হাত খরচের টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি তাই। এরপর এভাবে টুকটাক কিনতে থাকা আর জমানো চলতেই থাকে। একটা সময় সংগ্রহ বাড়তে থাকায় মনে হলো কয়েনগুলো সংরক্ষণ করার জন্য একটা কয়েন অ্যালবাম কেনা জরুরি। সম্ভবত নিউমার্কেট অথবা সায়েন্স ল্যাবের দোকানটা থেকেই একটা অ্যালবাম কিনেছিলাম ৩০০ টাকা দিয়ে। সেই অ্যালবাম ধীরে ধীরে ভরতে থাকে, যত্নে। এরপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে কাজে ঢুকে পড়ি। ঢাকার বাইরে চলে যাওয়া, ক্যারিয়ার ঠিক করার গোলযোগের মধ্যে শখের পেছনে সময় আরে দেওয়া হয় না খুব একটা। কিন্তু যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখা বাক্স আর অ্যালবামটার কথা কখনো ভুলে যাইনি। অবসরে যখনই সুযোগ হতো, বের করে দেখতাম।
২০০৮-০৯ সালের দিকে কাজিন রুমি ও আকিব—এদের দেখে শখটা আবার মাথা চারা দিয়ে ওঠে। ওরা আমার অনেক ছোট—অনেকটা ঠিক যে বয়সে আমি অলিগলি চষে বেড়াতাম, তখন তাদের সেই বয়স। যেহেতু তখন আমার আর ঘুরে বেড়াবার সময় হবে না, তাদের সেই উৎসাহ দেখেই অন্যভাবে টুকটাক সংগ্রহ চালু রাখলাম—আমার কাছে যেগুলো একটার বেশি ছিল তার সঙ্গে ওদের কাছে যা বেশি সেগুলো বিনিময় করে, কলিগের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে, বিদেশ থাকা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, নানাভাবে। ই-বাই থেকেও কিনেছি কিছু, কিন্তু পেমেন্টের ঝামেলা আর পোস্টের কল্যাণে এর বেশ কিছু হাতে পৌঁছায়নি বলে সেই সময় ই-বাই থেকে কেনা ছেড়ে দিই। কয়েন আর ব্যাংক নোট সংগ্রহ সম্পর্কে ধারণাও সেই সময় আরও বাড়ে। ইন্টারনেটে ইনফরমেশন প্রচুর পাওয়া যায়। কী সংগ্রহ করতে হয়, কেন করতে হয়, কীভাবে যত্ন নিতে হয়, কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়—এই ধারণাগুলো আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এখনতো ফেসবুকের কল্যাণে অনেক সংগ্রাহক গ্রুপ হয়েছে, যেখানে আবার বেচাকেনাও হয়। নতুন নতুন অনেক সংগ্রাহকও তৈরি হয়েছে ইদানীং আর এই সংখ্যা আগের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। পাশাপাশি বেড়েছে সংগ্রহমূল্য (collectible value)। এখন কয়েন ও ব্যাংক নোটের প্রদর্শনীও হচ্ছে নিয়মিত জিপিও অডিটোরিয়ামে, সেখানে বেচাকেনাও হচ্ছে প্রচুর। তার ওপর জিপিওসহ আরও কিছু স্থানে নিয়মিত নিলামও হচ্ছে। মজার ব্যাপার এখন অনেকেই এটাকে নেশার পাশাপাশি পার্শ্ব পেশা হিসেবেও দেখতে পারছে।
এখন অস্ট্রেলিয়া অভিবাসী বলে আমার ফোকাসটা পরিবর্তিত হয়ে এখানকার কারেন্সির দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ বেড়েছে একটু ভিন্ন ধরনের, একটু unuslual কয়েনের প্রতি। কিছু কিছু কয়েন আছে অনেকটাই সংগ্রাহকদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়, এদের মধ্যে কিছু অনেক অদ্ভুত। একটা কয়েন আছে যেটা 3D গ্লাস পড়ে দেখতে হয়। আবার আরেকটা আছে যেটা ঠিকভাবে experience করতে (Augmanted reality) অ্যাপ প্রয়োজন হয়—এমন ভিন্নধর্মী কয়েন সংগ্রহ করতে আমার অনেক মজা লাগে। এখানে এসে পড়ার কারণে বাংলাদেশের মুদ্রা সংগ্রহ কিছুটা ধীর হয়ে গেছে, তাই বলে বন্ধও হয়ে যায়নি একেবারে। যখনই দেশে যাই সুযোগ পেলেই সংগ্রহ করার চেষ্টা করে যাই কিছু না কিছু। এইতো কিছু বছর আগেও নানুর কাছ থেকেও তার জমানো পুরোনো নোটগুলো কাড়াকাড়ি করে নিয়েছি কাজিনদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।

সত্যি কথা বলতে এই শখটা থেকে আমার তেমন কোনো আর্থিক লাভ করার উদ্দেশ্য ছিল না। আবার কখনো দাবি করি না, এই শখ থেকে খুব বেশি জ্ঞানলাভ করেছি বা করাটা জরুরিও মনে করিনি। যা পেয়েছি, তা হলো প্রচুর আনন্দ আর মানসিক প্রশান্তি। নিজের সংগ্রহ বাড়তে থাকা দেখা, একটা খুব দুষ্প্রাপ্য কয়েনের অধিকারী হতে পারা, এই আনন্দ পাওয়াটাই ছিল আমার এই শখের মূল চালিকাশক্তি।
যারা এখন ছোট, টিনএজার, প্রত্যেকের কিছু না কিছু এ রকম শখ থাকা উচিত। যার মাধ্যমে তারা এখনকার অমানুষিক পড়াশোনার চাপ থেকে একটু বের হয়ে সময় দিতে পারবে সেই শখের পেছনে। হোক সে কোনো কিছু সংগ্রহ করা, গান করা, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা বা অন্য যেকোনো ধরনের সাহিত্যচর্চা করা; বাগান করা, বই পড়া বা অন্য যেকোনো ধরনের কনস্ট্রাকটিভ অ্যাক্টিভিটি—যেটা তারা প্রাণভরে শুধু উপভোগ করতে পারবে। আমি মনে করি যারা অভিভাবক, তাদেরই উচিত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার পাশাপাশি শখের এই হাতেখড়িটা করিয়ে দেওয়া। আজকাল বইপুস্তকের ভারে জর্জরিত ছেলেমেয়েদের জন্য এটা হতে পারে স্বস্তির একটা জায়গা। শুধুমাত্র তাদের সুযোগটা করে দিয়ে একটু উৎসাহ দেওয়াটা হয়তো যথেষ্ট। বাকিটা কিন্তু তারা নিজেরাই পারবে। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, আমাদের ছোট ভাইবোন, ভাগনে-ভাগনিকে অল্প কিছু কয়েন বা ব্যাংক নোট দিয়ে একটু উৎসাহ দিয়ে দেখিই না! ওদের সারা জীবনের আনন্দের একটা উৎস তৈরি করে দিতে পারাটাও কিন্তু আমাদের অনেক বড় একটা কর্তব্য।
কিছু youTube লিংক দিলাম, যেখানে কিছু ভিন্নধর্মী কয়েন দেখতে পাওয়া যাবে।
<www.youtube.com/watch?v=Xek1FuWiVGM>
<www.youtube.com/watch?v=mK9mcpdkmkE>
<www.youtube.com/watch?v=yrVpnAbnCrI>
...
আহমেদ ফয়সাল হাসান: মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>