লোভের ফাঁদে পা নয়

আমাদের চারপাশেই ফাঁদ পাতা। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে কেউ ফাঁদ পাতে। কেউ বা ব্যবসার নাম করে। আমাদের দেখানো হয় রঙিন স্বপ্ন। স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে আমরা কখন যে ফাঁদে পরে যাই, বুঝতে পারি না। যখন বুঝি, তখন দেখি নিঃস্ব হয়ে গেছি। প্রতারণার এক অভিনব কৌশলে আমরা আটকে যাই। আমাদের স্বপ্ন চুরি হয়, বিশ্বাস মরে যায়।

বর্তমানে অনলাইনে অনেকে ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত। অনেক রকম ব্যবসা আছে। ই-কমার্সও খারাপ না। বরং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের সেদিকেই ঝুঁকতে হবে। সমস্যা হলো সবাই ব্যবসা করে না, কেউ কেউ প্রতারণাও করে। আর আমরা সেই প্রতারণার শিকার হই।

ডেসটিনি থেকে শুরু করে ই-অরেঞ্জ, ইভ্যালি, এহসান গ্রুপ সবখানেই মানুষ প্রতারিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ফাঁদ কি নতুন কিছু? মোটেই না। অতীতে দেখেছি, এমএলএম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ডেসটিনির অভিনব আকর্ষণীয় ব্যবসা। বৃক্ষরোপণের নামে অল্প সময়ে মানুষকে ধনী বানিয়ে দেওয়ার লোভনীয় অফার। সেই লোভে আমরা পা দিই আর আটকে যাই ফাঁদে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা হয় না। এই কিছুদিন আগেও এহসান গ্রুপ রীতিমতো মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এহসান গ্রুপ সুদহীন ব্যবসার নামে হালাল ব্যবসার প্রচারণা চালিয়েছিল। আর বোকা, লোভী মানুষ সেই ফাঁদে পা দেয়। আলোচনায় আসে যখন, তখন তারা টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়।

অনেকে বলবে, ইভ্যালি হয়তো সে রকম নয় কিংবা ই-অরেঞ্জ। কিন্তু পার্থক্য শুধু কৌশলে। লক্ষ্য একই। সরকার আগে থেকে ইভ্যালিকে নজরে রাখায় তাঁরা বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে যারা ছিল, তাঁরা সবাই চুপে চুপে আগে সরে গেছে। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, যার যাই হোক এর নাম বিজনেস নয়। যমুনা গ্রুপও প্রথমে ইভ্যালির পাশে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়ে সেখান থেকে সরে আসে। কেউ তাদের পাশে দাঁড়ায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইভ্যালির গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার। এ সময় তাদের দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি টাকা।

আর চলতি সম্পদ ছিল মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া পণ্য মূল্য বাবদ গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম ২১৪ কোটি টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহ করেনি। আবার অন্যদিকে যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইভ্যালি পণ্য কিনেছে সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের বকেয়া রয়েছে ১৯০ কোটি টাকা।

ই-কমার্সের বিজনেস অনেকেই করছে। কিন্তু আপনার মূল উদ্দেশ্য যদি থাকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, তাহলে সাময়িকভাবে সফল হলেও টিকে থাকা কঠিন। কিছু দূর গিয়ে দেউলিয়ার খাতায় নাম লেখাতে হয়।

আমাজনের ব্যবসা সারা বিশ্বে চলমান। গ্রাহকদের সঙ্গে কমিটমেন্ট তাদের মূল পুঁজি বলা যায়। অর্থ সব বিজনেসে থাকে, থাকে লাভ-ক্ষতির হিসাব। কিন্তু অনেক দূর যেতে হলে, টিকে থাকতে হলে গ্রাহকের সঙ্গে বিশ্বাসের সিঁড়িটা থাকতে হয়। আমাজন তাই করেছে। এমন নয় যে আমাজন অল্প দিনেই দাঁড়িয়ে গেছে। বরং বহু ধাক্কা খাওয়ার পরও টিকে আছে এবং এখন তাদের বিশ্বব্যাপী পদচারণা। এই করোনাকালেও তারা চালিয়ে গেছে সাবলীলভাবে।

রাষ্ট্রের বা সরকারের কি কোনো দায় দায়িত্ব নেই? অবশ্যই আছে। তারা দেখবে আইন মানা হচ্ছে কিনা। সরকার ট্যাক্স পাচ্ছে কিনা, তাদের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা। আবার গ্রাহকের দেখা উচিত, যাচাই করা উচিত সে পণ্য কিনবে কিনা।

করোনাকালে লকডাউনে থাকার কারণে মানুষ অনলাইনে ঝুঁকে পড়েছিল। কিন্তু আমাদের সমস্যা অনলাইন বা অফলাইন নয়, সমস্যা হলো প্রতারণা করা। রাষ্ট্রের বা সরকারের কি কোনো দায় দায়িত্ব নেই? অবশ্যই আছে। তারা দেখবে আইন মানা হচ্ছে কিনা। সরকার ট্যাক্স পাচ্ছে কিনা, তাদের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা। আবার গ্রাহকের দেখা উচিত, যাচাই করা উচিত সে পণ্য কিনবে কিনা। আসলে পণ্য কিনেও তেমন ঠকে না। ঠকে যখন আমাদের মাঝে অতিরিক্ত লোভ কাজ করে। আপনাকে লোভনীয় অফার দেয় আর আপনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। ৫০ টাকার পণ্য ১৫ টাকায় অফার দেয়, আপনি কিছু না ভেবেই লুফে নেন। লাখো টাকার পণ্য কেনেন একবারও না ভেবে। একবারও ভাবেন না, তারা আপনাকে এত এত কম দামে দিচ্ছে তা কী করে সম্ভব? আপনি প্রতারণার শিকার হচ্ছেন, এর দায় আপনার নিজেরও কিন্তু কম নয়। আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানকে হয়তো শাস্তি দেওয়া যায়। কিন্তু সরকার আপনার লোভী মনকে, আপনার বোকামিকে কীভাবে ঠেকাবে? এমন তো নয় যে, এই প্রথম প্রতারিত হয়েছেন। আপনার চারপাশে বহু মানুষ আগে থেকে প্রতারিত হচ্ছে দেখে আসছেন তারপরও আপনি সতর্ক হননি। এই সতর্ক না হওয়া হলো আপনার বোকামি।

প্রত্যেক ব্যবসার একটা পলিসি থাকে। সেই পলিসি ঠিক রেখেও অনেকে ক্ষতির খাতায় নাম লেখায়। দেখা যায় তার উদ্দেশ্য খারাপ না কিংবা গ্রাহকের সঙ্গে তার কমিটমেন্ট ঠিক, তারপরও দাঁড়াতে পারে না। এর কারণ হলো, অনেক সময় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা তাদের দাঁড়াতে দেয় না। ভাবে, তাঁদের ব্যবসায় ধস নামবে। তখন তাঁরা নতুন ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় ধস নামিয়ে দেয় খুব কৌশলে। ব্যবসা মানে প্রতারণা নয়, বরং ব্যবসায়ীরা আছে বলেই অর্থ থাকে, কর্মসংস্থান হয়, সরকার ট্যাক্স পায়। এখন আপনাকে বুঝতে হবে কোথায় আপনি পা রাখবেন।

বর্তমানে ই-কমার্স অনেকে ঝুঁকছে। প্রযুক্তি যত উন্নত হবে আমরা সেদিকে তত বেশি যাব। সবকিছুতেই ভালো মন্দ আছে আপনাকেই আপনার অতিরিক্ত লোভী মনকে সংযত করে নিজের তাগিদে খুঁজে নিতে হবে ভালো কোনটা।

শুধু ই-কমার্স না, লটারির কথা বলেও প্রতারক চক্র লাখো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শিক্ষিত মানুষকে ইমেইল করে বলেছে, আপনি এত টাকা লটারিতে পেয়েছেন-অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন টাকা পাঠাই। লোভী মানুষ অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে দেয় সেই লটারির টাকা পাওয়ার আশায়। একবারও যাচাই করে না এটা কী করে সম্ভব! যখন দেখে সেই অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়া দূরে থাক, উল্টো তার যে টাকা ছিল অ্যাকাউন্টে সেটা প্রতারক হ্যাক করে নিয়ে গেছে তখন হায় হায় করে। জিনের বাদশা থেকে শুরু করে পাত্রী দেখা কোথায় নেই প্রতারক চক্র। জীবন প্রবহমান। এর মধ্য দিয়েই আমাদের চলতে হবে। এই চলার পথে আমাদের খুঁজে নিতে হবে ভালো-মন্দ। আমাদের অতিরিক্ত লোভ যেন সর্বনাশ ডেকে না আনে তা আমাদেরই খেয়াল রাখতে হবে।