রাসু নামের ছেলেটি

শাহরিয়ারের বয়স তখন সাত। প্রায়ই মায়ের সঙ্গে নানা বাড়ি বেড়াতে যেতেন। একদিন নানার মুখে শুনেছিলেন, তিনি নাকি আক্ষরিক অর্থে নানার আত্মীয় নন। আত্মার সঙ্গে যোগ না থাকলে সঠিক অর্থে সে আত্মীয় হয় না। নানা জানিয়েছেন, তোমার মায়ের বিয়ে হওয়ার পরেই সে অন্য বংশের পদবি গ্রহণ করে আলাদা হয়ে যায়। সে হিসেবে দেখলে নানাভাই তোমাকে আত্মীয় বলা যাবে না।

যদিও কথাটা নানা মজা করে বলেছিলেন, নাকি সিরিয়াসলি সেটা বোঝার মতো মনের বিকাশ তখনো শাহরিয়ারের হয়নি। তবে ছোট্ট শাহরিয়ারের মাথায় সেদিন থেকে জেদ চেপেছিল। মেয়ে হলে বিয়ের পর বাবার সঙ্গে সম্পর্ক বদলে যায় কী করে, এটা তিনি বড় হয়ে প্রমাণ করে দেখাবেন।

বিয়ের পর কদিন যেতে না যেতেই বউকে বললেন, আমার প্রথম সন্তান কিন্তু মেয়ে হতে হবে। মেয়েকে তিনি বুকে করে মানুষ করবেন। তিনি গর্ব করে বলেন, যেমনি আমার শরীরের হৃৎপিণ্ড, কিডনি, লিভার, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, তেমনি আমার মেয়ে হবে আরেক অর্গান। বিয়ের আগে থেকেই তিনি নাম ঠিক করে রেখেছেন। মেয়ের নাম হবে তানজিনা।

স্বামীর কথা শুনে স্ত্রী বিলকিস হেসে বললেন, ‘আচ্ছা ধরো, তোমার মেয়ে না হয়ে যদি ছেলে হয়’। জবাবে একটু রেগে বললেন, হলে, হলো। তবে মেয়ে আমার চাই।

ঘটনাটা ঘটার পরে তিন রাত ঘুমাতে পারেননি শাহরিয়ার। গত মাসেই তানজিনা মাত্র ষোলোতে পা রাখল। মেয়েটির গায়ে এখনো বাচ্চা বাচ্চা গন্ধ লেগে আছে। এতটুকু মেয়েকে কিনা এই ছেলেটা...

সেদিন পার্কের ঘটনাটা নিয়ে ভাবতেও ভীষণ মন খারাপ হয় শাহরিয়ারের। শাহরিয়ার মনে মনে শপথ নিয়ে ফেললেন, যে করেই হোক ওই ছেলেটার একটা বিহিত করতেই হবে।

কিন্তু কী করে, তিনি জীবনে কারও গায়ে হাত তোলা তো দূরের কথা পায়ে পাড়াও দেননি। ভাবতে ভাবতে হন্তদন্ত হয়ে অফিসের দিকে যাচ্ছেন শাহরিয়ার। পথে রাজু সাহেবের সঙ্গে দেখা। রাজু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন শাহরিয়ারের দিকে। কিছুক্ষণ দুজনই বাকরুদ্ধ।

রাজু প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে বলেন, কী ব্যাপার দোস্ত, এত বিধ্বস্ত চেহারা কেন তোর? ভাবির সঙ্গে কোনো সমস্যা?

শাহরিয়ার রাজুর প্রশ্নে এমনভাবে রিঅ্যাক্ট করলেন, রাজু রীতিমতো অবাক হয়ে গেলেন।

রাজু আর শাহরিয়ার ছোটবেলার বন্ধু। এক সঙ্গে লেখাপড়া।। পড়া শেষ করে শাহরিয়ার গেলেন ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অফিস সেক্রেটারির চাকরি নিয়ে। আর রাজু হলেন সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী আর সেক্রেটারি পদমর্যাদায় দুই বন্ধুর মধ্যে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। দেখা হলেই একে অন্যকে তুই তোকারি করে সম্বোধন করেন।

রাজু অনুমান করেন শাহরিয়ারের একটা কিছু হয়েছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন, আমি জানি তোর কিছু একটা হয়েছে, না হলে তুই এমন তেতো মুখে কথা বলতি না। কী হয়েছে, এইডস?

শাহরিয়ার চিৎকার করে উঠলেন, ধুর শালা সব সময় ইয়ার্কি ভাল্লাগে না। গালিটা ছুড়ে দিয়ে চারদিকে তাকালেন শাহরিয়ার, নাহ, কেউ শোনেনি। ছেলেপুলেরা শুনলে কেলেঙ্কারি ব্যাপার হয়ে যেত।

শাহরিয়ারের এমন আচরণে রাজু ঘাবড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্যাক্সি ডেকে শাহরিয়ারকে নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলেন। সবকিছু শুনে রাজুর মুখটাও থম হয়ে গেল।

কত বয়স যেন তোর মেয়ের, ষোলো। থানা-পুলিশ করে লাভ নেই। অযথা সাংবাদিকেরা এসে তিল থেকে তাল বানাবে। ছেলেটাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে। এমন শিক্ষা দেব যাতে এটা দেখে পাড়ার অন্য ছেলেরাও এমন কাজ জীবনে করতে সাহস না করে।

একটা পিস্তল জোগাড় করলেন রাজু। কলেজে পড়ার সময় থেকেই রাজু এসব কাজে দক্ষ ছিলেন। এক সময় নকশাল পার্টিতেও নাম ছিল রাজুর। পিস্তলটার ব্যবহার শিখিয়ে দিলেন শাহরিয়ারকে। অপর পক্ষকে কোনো মতেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। শুধু রেঞ্জের ভেতর এলেই কপালে পিস্তলটা ধরতে হবে। বাকি কাজটা এমনি হয়ে যাবে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করা যাবে না।

অন্ধকার গলিতে ঢুকে শাহরিয়ার ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়ে দেখলেন মালটা ঠিক আছে কিনা। আঙুলে একটু ঠান্ডা লাগতেই বুঝলেন সব ঠিক আছে। ডিসেম্বরের কনকনে শীতেও ঘামছেন শাহরিয়ার।

হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখছেন আর মাত্র পাঁচ মিনিট। ঝোলা ব্যাগে হাত দিয়ে পিস্তলটা হাতে নিলেন। কেমন যেন একটা উষ্ণ অনুভূতি তার মনে। হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকটা ভীষণ রকম বেড়েছে। ভেতরে কেউ যেন হাতুড়ি পেটা করছে। এমনি এক সময় পকেটের মোবাইল ফোনটা বিকট আওয়াজ করে বেজে উঠল। মোবাইল ফোনের রিং টোনটা যে এত ভয়ংকর তা এর আগে শাহরিয়ার কোনো দিনই টের পাননি। স্ত্রী বিলকিস প্রায়ই বলতেন, মোবাইলটা রেখে কী লাভ, নদীতে ফেলে দাও। কারণ কেউ কল করলেও তুমি শুনতে পাও না।

আসলেও তাই, মোবাইলটা এমন আস্তে করে বাজে যে শোনাই যায় না। আর আজ এই হতচ্ছাড়া ফোনটা এমন ভাবে ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠল যে, শাহরিয়ার রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন।

রাজু অবশ্য বলেছিলেন, ‘এসব কাজ তোর দ্বারা হবে না শারু (শাহরিয়ার)। কাজটা তুই আমাকে করতে দে। কিন্তু শাহরিয়ারের সাফ কথা, ‘মেয়েটা যে আমার, তাই কাজটা আমাকেই করতে হবে।’

মেয়ে ওনার বড্ড প্রিয়। স্ত্রীর প্রেগন্যান্টের প্রথম দিন থেকেই একটা মেয়ের জন্য প্রার্থনা করে আসছেন শাহরিয়ার। আজ ওই মেয়ের বিড়ম্বনা নিজ চোখে দেখতে হলো। তাই আজ এক হাত দেখে নেবেন ছেলেটাকে।

রাজু এ-ও বলেছিলেন, কাজটা ঠান্ডা মাথায় করতে হবে। খুব উত্তেজিত হয়ে খটাস করে ট্রিগার টিপে দিস নে। মনে রাখিস, এটা আসল পিস্তলের মতো দেখালেও আসল না। এমন নোংরা ভাষায় গালি দিবি যাতে ছেলেটা ঘাবড়ে যায়। তারপর পিস্তলটি মাথায় ঠেকাবি। দেখবি ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে বলবে আমাকে মাফ করে দিন, আমার কোনো দোষ নেই।

এভাবেই তিন দিন চলে গেল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। তবে আজ পিছপা হওয়া যাবে না। মোবাইলটাও বাসায় রেখে এসেছেন। আজ ছেলেটার রক্ষা নেই। দুর্বল নার্ভগুলোকে শক্ত করে টাইট দিতে হবে। মেয়ে ওনার বড্ড প্রিয়। স্ত্রীর প্রেগন্যান্টের প্রথম দিন থেকেই একটা মেয়ের জন্য প্রার্থনা করে আসছেন শাহরিয়ার। আজ ওই মেয়ের বিড়ম্বনা নিজ চোখে দেখতে হলো। তাই আজ এক হাত দেখে নেবেন ছেলেটাকে।

এবার শিরদাঁড়া সোজা করে, চোয়াল শক্ত করে ডান হাতে পিস্তলটা শক্ত করে ধরে শিমুল তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আজই তিনি প্রমাণ করবেন, তিনি একজন আদর্শ বাবা।

এই তো দেখা যাচ্ছে ছেলেটা সাইকেল চালিয়ে এদিকে আসছে। সাইকেলটা যখন প্রায় এক হাত দূরে অমনি অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে শাহরিয়ার রাস্তায় দাঁড়ালেন। ডান হাত দিয়ে ব্যাগের ভেতর পিস্তলটা শক্ত করে ধরা। ছেলেটা কোনো রকমে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। শাহরিয়ার পিস্তলটা বের করবেন, তখনই ছেলেটা বলে ওঠে, স্যার আপনি এখানে?

শাহরিয়ার কিছু বোঝার আগেই ছেলেটা তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে বলে, আপনি আমাকে চিনবেন না স্যার। আমি তানজিনার বন্ধু রাসু (রাসেল)। এদিকে কোনো কাজ ছিল স্যার? থাকলে বলতে পারেন। আমি তো এদিকেই থাকি।

শাহরিয়ার বিড়বিড় করে বলেন, তুমি যে এদিকে থাকো তা আমি ভালো করেই জানি। সেদিন পার্কে ঠিকই তোমাকে দেখেছি তানজিনার হাত ধরে পার্কে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছ। কিন্তু এই রাসু নামটি মনে হচ্ছে মেয়ে তানজিনার মুখে কত দিন শুনেছেন শাহরিয়ার। এত দিন ভেবেছেন রাসু কোনো মেয়ে বন্ধুর নাম হবে। রাসু আবার ছেলেদের নাম হয় নাকি!

শাহরিয়ারের হাত ব্যাগের বাইরে। হাত খালি, তার মানে পিস্তল ব্যাগের ভেতরে। একটু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তা তুমি কি আমার মেয়ের বয়সী, তানজিনাকে তুমি চিনলে কী করে?’

‘তানজিনা থেকে বয়সে বেশি বড় না স্যার। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্স্ট ইয়ার। তানজিনার সঙ্গে আমার অনেক দিনের বন্ধুত্ব।’

শাহরিয়ার মনে মনে হিসাব কষেন, তার মানে তানজিনার থেকে পাঁচ বছরের বড়। কথা শুনে তো মনে হয় ভদ্র ঘরের ছেলে।

শাহরিয়ার বেমালুম ভুলে গেলেন নকল পিস্তলটা এখনো ব্যাগের ভেতরে। এতক্ষণে পিস্তল ঠেকিয়ে আচ্ছা করে ছেলেটাকে শাসন করার কথা ছিল।

—তা রাসু, তুমি তানজিনার বন্ধু, কিন্তু আমাকে স্যার বলছ কেন? বন্ধুর বাবাকে কেউ স্যার বলে নাকি?

—না স্যার, স্যরি মানে আংকেল।

ছাতিম গাছের নিচে দারুণ উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে রাজু আড়াল থেকে মনে মনে ভাবছেন, সামান্য ঘটনা ঘটাতে এতক্ষণ লাগার তো কথা নয়। শাহরিয়ারের চিৎকার শুনলেই ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর কথা ছিল রাজুর। উঁকি দিয়ে দেখেন, ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করে করে শাহরিয়ার এদিকেই আসছে। রাজু হন হন করে উল্টো দিকে হাঁটা দিলেন।

শাহরিয়ার চিৎকার করে ডাকলেন, রাজু দাঁড়াও। তারপর রাসুকে বললেন, আমার বন্ধু রাজু, ওর জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। রাজু কিছু বলতে চাইছিলেন, শাহরিয়ার বাধা দিয়ে রাসুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ঠিক আছে বাবা দেখা হবে, সাবধানে যাও।

একমাত্র মেয়ে তানজিনার বন্ধু রাসুকে একান্ত সজ্জন বলে মেনে নিলেন শাহরিয়ার। নকল পিস্তলটার কথা ভেবে নিজেই লজ্জিত হলেন। বন্ধু রাজুর ওপর ছুড়ে মারলেন তীব্র ক্ষোভ।