
চন্দ্রমুখী। চন্দ্রলোকের তালুক তার মায়ের হাতে। মা বৃদ্ধ। এখন এই তালুকের দেখভালের দায়িত্ব কন্যারই। তাইতো তার সতর্ক পর্যবেক্ষণ।
চন্দ্রমুখী তার চোখ দুটি একবার জয়িতার দিকে আরেকবার মহাশ্বেতার দিকে ঘুরায়। তার চোখ ঝিকমিক করে।
চাঁদ একটি পবিত্র স্থান। মানুষ এই পবিত্রতা ধারণ করার যোগ্যতা রাখে না। কাজেই এখানে প্রবেশের অধিকারও তাদের নেই।
কিশোরীরা একজন আরেকজনের দিতে তাকায়।
জয়িতা বলে, না মানে...।
কথা শেষ করতে না করতেই চন্দ্রমুখী বলে, মানে—তারা চাঁদে আসতেও চায় না। এক নাগাড়ে ও দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলে যায় তরুণী। এ তার আফসোসও।
তরুণী প্রশ্ন করে, তোমরা কি নিজেদের বিবেকবান মনে কর?
জয়িতা চেয়ে থাকে রাজকন্যার দিকে। মহাশ্বেতার মুখ শুকিয়ে যায়।
—বলো! পুনর্বার আহ্বান করে তরুণী তার প্রশ্নের উত্তর দিতে।
ওরা চুপ। তরুণী তার কাঁধের আঁচলটি সামনে টেনে নেয়।
—হ্যাঁ, অবশ্যই!
মহাশ্বেতা বলে। কোমল কণ্ঠ তার।
—না।
তরুণী যেন একটা আঘাত হানে। কাঠের ঘর হলে এর শব্দ বাইরে আসত। তার মুখে হাসি। কিন্তু এ যে অন্যরকম।
জয়িতা বলে, রাজকন্যা তোমাকে বলতে হবে কোন বিবেচনায় আমরা বিবেকবান নই। কিশোরী রাজকন্যা বলে সম্বোধন করে তরুণীকে।
—হ্যাঁ, তোমাকে বলতে হবে। মহাশ্বেতা আরও একটু জোর দেয় বিষয়টিতে।
—তনুকে তোমরা হত্যা করেছ।
তরুণী কথাটি শেষ করতে না করতে জয়িতা বলে, তনু—হ্যাঁ, তাকে হত্যা করা হয়েছে।
—বল, তোমরাই এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছ।
তরুণী তার ডান কানের পাশ দিয়ে ঝোলা চুলগুলো পেছনে নেয়।
—এটা তোমার ধারণা, আমরা তনুকে ভালোবাসি। সে ছিল আমাদের প্রিয় বোন।
জয়িতা এর ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করে।
—সে ছিল মেধাবী। নাটকের মধ্য দিয়ে সে বিশুদ্ধ একটি চর্চা চালিয়ে যেত—এ তার শখ। উচ্চতর একটি কাজ। সেটা তোমরা করতে দিলে না। রাজকন্যা বলতে থাকে। সে কী পোশাক পরতো সেটা বড় কথা নয়, সে কী করতে চাইতো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। তোমরা কী করলে! তার দুর্নাম দিলে সে যথেচ্ছ পোশাক পরত। তোমরা হত্যাকাণ্ড পছন্দ কর।
রাজকন্যা অন্য দিকে মুখ ঘোরায়। তার দাঁতগুলো আলোয় চিকচিক করে। তাকে দেখতে যতটা কোমল, স্নিগ্ধ মনে হয় ততটাই তার কথাগুলো কঠিন। জয়িতা চন্দ্রমুখীর সামনে আসল চিত্রটা তুলে ধরতে চায়। কিন্তু সেটা কীভাবে, সেই পথই খুঁজতে থাকে সে। মহাশ্বেতাও তাই।
—সে আমাদেরই একজন, বলে জয়িতা।
—সেই অর্থেই তোমরা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছ। তনু তোমাদের আপন মনে করত।
চন্দ্রমুখী ‘বিশ্বাসঘাতক’ শব্দটি ব্যবহার করে না কেবল। তবে মানুষ সম্পর্কে তার শক্ত কথাটি অবলা থাকে না।
—আমরা সমগোত্রীয়। সে আমাদের সুহৃদ। আমরা তাকে ধরে নাটকের মাধ্যমে সুন্দরের ললিত কলার জন্য লড়েছি।
জয়িতা কথাটি বলা চলে একদমে বলে যায়।
মহাশ্বেতা বিষয়টি জোরালো করার আরও চেষ্টা নেয়। চন্দ্রমুখীর চোখের দৃষ্টি আগের মতোই দেখায়। কিন্তু তারপরও কিশোরী তার চেষ্টা থেকে সরে না। সে বলে, আমরা ওই পরিবারের সহমর্মী। আমরা লড়ছি এখনো তনু হত্যার প্রতিবাদে।
—কী করে হয়! এই পরিবারটির সবচেয়ে অগ্রসরমাণ এবং সম্ভাবনাময় সদস্য তনু। সেই লক্ষণটি ছাত্রজীবনে তার মধ্যে স্পষ্ট। সে ছাত্র পড়িয়ে নিজের লেখাপড়া চালিয়েছে। অথচ তোমরা তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করোনি। রুপার ব্যাপারটিও একই ধরনের। চন্দ্রমুখীর জলে ছলছল করা চোখ থেকে আলো ছোটে।
জয়িতা কথা বলার ফাঁক খোঁজে। কিন্তু চন্দ্রমুখীর রোষ দৃষ্টির সামনে কীভাবে সে সুযোগটি নেয়। তারপর এল আবার রুপার প্রসঙ্গ।
—রুপাও ছাত্র পড়াত। পরিবারের জন্য গরিব বাবা যেটা করতে পারেনি সেটাই করতে চেয়েছিল সে। আইন বিদ্যা পড়ছিল ভালো একটা চাকরির লক্ষ্যে I শিক্ষকতার জন্য একফাঁকে নিবন্ধন পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। চলন্ত বাসে তার ওপর পরিবহন কর্মীদের অত্যাচার চলল। ঘাড় মটকে মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলে দেওয়া হলো বনের মধ্যে। এটা আমাদের ক্ষত।
একটার মধ্যে আরেকটা। এত কিছু সামাল দেয় কী করে! জয়িতা এক হাতে আরেক হাতের আঙুল মটকায়।
বিরুদ্ধ পক্ষের বিপরীতে নিজের অবস্থানকে চিহ্নিত করা যত সহজ নিজের কারও কাছ থেকে সেই জায়গা নেওয়া ততটাই কঠিন। রাজকন্যা সাহায্য করতে চেয়েছে। তার কথায় ও চেহারায় অন্তত এমনটিই মনে হওয়ার কথা। যদিও এই মুহূর্তে সেটা পরিষ্কার নয়। তাহলে এটা কী কোনো পরীক্ষা?
কখনো সত্যের মুখোমুখি হওয়াটা অনিবার্য হয়ে পড়ে। জয়িতা মহাশ্বেতার দিকে তাকায়।
পৃথিবীর কন্যা জয়িতা। ধরনীর দৈন্যদশা তার কাছে জলের মতো স্বচ্ছ। কোনো ঘটনা তার চোখ এড়ায় না।
একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। অথচ বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া নেই। কোনো মৃত্যুই অবহেলার নয়। কোনো অপরাধী বিনা বিচারে পার পেতে পারে না। কিন্তু এই অছিলায় জাতিগত হিংসা ও বিদ্বেষের বশবর্তী হওয়া যায় না। গণহারে ও নির্বিচারে একটি গ্রামের মানুষের বসতবাড়িতে আগুন দেওয়া কি সভ্যতা? চলৎ শক্তিহীন বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে মারা কি চরম ঘৃণ্য কাজ নয়?

কি অন্যায় করেছিল আদিবাসীরা!
জয়িতা নিজেকেই এই প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
রাজকন্যা তাহলে কীভাবে সাহায্য করবে! শঙ্কার পাশাপাশি আশ্রয়ও জোটে। সেটাই বোধ হয় তার আনুকূল্য পাওয়ার জন্য সহায়ক।
জয়িতা দেখে চায় না পাটওয়ারীকে।
প্রগতিশীল সমাজকর্মীর ভেতরকার আগুন ধরে রাখা যায় না। জেলে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রী চর্চা করেন জীবনের জয়গান।
ওইদিকে রাজকন্যাকে দৃষ্টির সীমানায় রাখতে চায় জয়িতা। মহাশ্বেতা এতক্ষণ নীরব ছিল।
এবার সে ধীর অথচ বিনীতভাবে বলল, হত্যাযজ্ঞের শিকার প্রত্যেকের মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়। তাদের সবার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
চেহারা বা বেশভূষায় তরুণী এক বাঙালি কন্যা। এই গুণের জন্য সে সমস্যাতেও পড়েছে। জয়িতা রাজকন্যার বাগিচার গল্প শুনেছে। সেখানে চুপ করে থাকার জন্য কিংবা উদাসীনতার কারণে সে বড় এক ঝাপটার মুখোমুখি হয়।
ওদিন যথারীতি রাজকন্যার আসর বসে। সখীদের নিয়ে দেখে, আগের মতো বাগানে আর ফুল ফোটেনি। মৃদুমন্দ যে বাতাস পবিত্রতা আনে সেটা নেই। এক ধরনের থেমে থাকা। মনটি তার খারাপ হয়ে পড়ে। নিজেকে তার অসুস্থ মনে হয়। পা চলে না।
রাজকন্যা বাগিচার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চলত ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে। সে আজ নিশ্চল। মনটা থাকত ফুরফুরে। গান করত মনে মনে।
আজ পূর্ণিমাতে মন গেছে ভরে
কী যে শান্তি এই চরাচরে!
রাজকন্যার দুঃখে রাজা ও রানিরও ঘুম নেই। তাদের ডাকে সৌন্দর্যের দেবতা মদন আসেন। তারও উদ্বেগ রাজকন্যাকে নিয়ে। দেবতা জানেন, বড় সরল সোজা এই মেয়েটি।
মদন বলেন, এমনটি হওয়া উচিত হয়নি। এ বড় অন্যায়।
রাজকন্যা দেবতার সামনে দাঁড়ানো তখন। মন তার ভীষণ খারাপ। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারে না সে।
ওরা বড় জেদি। এই ফাঁকেই মদনকে কথাটি পাড়ে সূত্র কন্যা।
জেদি কথাটা কোথায় পেল! এই উত্তরটুকুও জানার সুযোগ হয় না রাজকন্যার। তর তর করে বলতে থাকে সূত্র কন্যা, ওরা বড় নাছোড়বান্দা। প্রকৃতি আরেকবার হোঁচট খায়।
রাজকন্যা সুরঞ্জনা হনহন করে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। সোজা অন্দর মহলে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে বালিশের ওপর। চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। সেই রাজকন্যা আজ তাদের সামনে। তারা বিস্মিত হয়। বলতেও পারে না, তুমি!
রাজকন্যা আসলেই নিষ্পাপ। সেই কথাট মদন বোঝেন। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন পরিদের। শেষ পর্যন্ত বিবাদটির মীমাংসা হয়। পরিরা সেই থেকে রাজকন্যার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছেন। সবাই জানে পরিরা এখন চাঁদে বসবাস করছে।
এখন ওরা দেখে রাজকন্যাও চাঁদে।
সেদিন তার বাগানের এই বিপর্যয় নিজের ত্রুটিতে হয়নি। সেখানে ছিল সূত্র কন্যার বাড়াবাড়ি। রাজকন্যা তখন বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। অতিরিক্ত কোমলতাই তার বৈশিষ্ট্য। এটাই তার অপরাধ! জয়িতা মহাশ্বেতার দিকে তাকায়।
চুন খেয়ে গাল পুড়েছে, এখন দই দেখলে ভয় পায়। এটাই সত্যি। আজ আবার এদের প্রবেশের সুযোগ দিয়ে সে আবার কোন ঝামেলায় পড়বে! কিশোরী নিজের জায়গায় ঠিক হয়ে বসে।
মহাশ্বেতাও অতি সূক্ষ্মভাবে বিষয়টি আয়ত্তে নেওয়ার জন্য মনেপ্রাণে কাজ করে যাচ্ছে। তার এ কাজ চোখে পড়ে না। এখানেই কথা, কোনো কোনো প্রচেষ্টা চলে সরবে—ঝড়ের বেগে। সেটা মানুষ দেখে। আবার কোনো কোনো কাজ চলে নীরবে নিভৃতে, একেবারে অলক্ষ্যে। কেবল এর বাস্তবায়ন হলেই টের পাওয়া যায়।
এদিকে মাটির পৃথিবীতে আন্দোলন চলছে। ছাত্র-নাট্যকর্মী তনু হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার। সেই ছবি ভাসছে পর্দায়। পেছনের চিত্রও আসছে। এখানে জয়িতার ছবিও আছে। ওই যে দৃঢ় হাতে অঙ্গীকার অন্য কর্মীদের সঙ্গে! প্রতিবাদ করে গণজাগরণ মঞ্চ। রুপা হত্যার প্রতিবাদে আলোর মিছিল করে স্বর্ণ কিশোরীরা।
ভাসে জেল থেকে বেরিয়ে আসার দৃশ্য। সে রাস্তা ধরে হাঁটছে। পাশেই দেখানো হচ্ছে জেলে তার কষ্টের গান। জয়িতা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। মহাশ্বেতা তার হাত দুটো ধরে।
রাজকন্যা ধীরস্থির তার জায়গায়। মায়াবী এক চেহারা। চোখের মণিটি কেবল এদিক থেকে ওদিক ঘোরে।
জয়িতা বলে, দেখো দেখো, এই আমাদের পৃথিবী। এই আমাদের তারুণ্য।
আমাদের শুভবুদ্ধির চর্চার জন্য চন্দ্রলোক হবে উপযুক্ত স্থান।
মহাশ্বেতা চন্দ্রমুখীর চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে। সে ভেতরের দিকে যায়। কিশোরী তখনো তাকে অনুসরণ করে। (ক্রমশ)
নিমাই সরকার: আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইমেইল: [email protected]
ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: