রবীন্দ্রনাথের যেসব বিষয় নাড়া দেয়
বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যত কিছু লেখা হয়েছে, তার এক ভগ্নাংশও অন্য কোনো কবি-সাহিত্যিকের ভাগ্যে জুটেছে কি না সন্দেহ। লেখা ছাড়াও তাঁর অ্যাডমায়ারার বা গুণগ্রাহীরও শেষ নেই। তাঁদের মধ্যে আছেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ভক্ত, দেশি-বিদেশি অধ্যাপক, গবেষক ও অনুবাদক, ছাত্রছাত্রী, সংগীতজগতের লোক ও আপামর জনসাধারণ। ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে দোলা খাওয়ার কথা উঠলে আমি কয়েকটা দিকের কথা ভাবতে পারি। তবে তাঁর বিভিন্ন কাব্য ও কবিতার অনেক লাইন, তাঁর গীতিনাট্য, পূজা, প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের অনেক গান, তাঁর কিছু প্রবন্ধের লাইন, শেষের কবিতার কিছু লাইন ও কয়েকটি নাটক আমার ভেতরে অহরহ খেলে যায়। এ ছাড়া যখন তাঁর পুরো জীবনটা লক্ষ করি, সুখ-দুঃখের টানাপোড়েন থাকলে তা-ও আমাকে চমকিত করে। এগুলোকে কয়েক ভাগে ভাগ করতে আমার ভালো লাগে। যেমন ১. তাঁর শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার দিনগুলো, ২. তাঁর লেখাপড়ার অবস্থা-ব্যবস্থা, ৩. তাঁর কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, গীতিনাট্য, গান; ৪. তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস, ৫. তাঁর পারিবারিক অবস্থা-দাম্পত্য জীবন, ৬. তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা, ৭. তাঁর শেষ জীবন। এখন দেখা যাক এগুলোর ওপর একটু চোখ বুলিয়ে:
* তাঁর শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার দিনগুলো
রবীন্দ্রনাথ যখন জন্মান, তখন তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথের বয়স ৪৫ বছর। অতগুলো ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর বাবা ছিলেন আধা সন্ন্যাসী, বেশির ভাগ সময় সংসার থেকে বাইরে বাইরে থাকতেন। মা নিত্য বাড়িভর্তি শতাধিক অতিথি আপ্যায়ন, সংসারের হাজারো ঝামেলা ও এতগুলো ছেলেমেয়ে সামলাতে সদা হিমশিম খেতেন। ছোট রবীন্দ্রনাথকে মাতৃস্নেহ দেওয়ার ফুরসতই তিনি করে উঠতে পারেননি। বাবা অবশ্য ছোটবেলায় একসময় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য ভ্রমণে বের হয়েছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ বলতে গেলে বাড়ির চাকরবাকরদের সংস্পর্শে মানুষ হয়েছেন। ভাইবোনদের সঙ্গে বয়সের তফাত অনেক হওয়ায় তিনি তাঁদের সঙ্গে খেলাধুলা, খুনসুটি, ঝগড়া, মারামারি করার সুযোগ পাননি। সবাই যেন ভাইবোন নয়, একেকজন অভিভাবক। অত বড় বিরাট জমিদারবাড়িতে কনিষ্ঠ রাজপুত্রের এই করুণ দশা মনকে নাড়া দেয় বৈকি।
* তাঁর লেখাপড়ার অবস্থা-ব্যবস্থা
রবীন্দ্রনাথের হাতেখড়ি হয় গৃহে। শিক্ষা শুরু হয় দাদা হেমেন্দ্রনাথের কাছে। তাঁকে শারীরিক ও মানসিক—দুদিক থেকে তৈরি করার জন্য বেশ আঁটসাঁট ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সাঁতার, জুডো, কুস্তি, উঁচু দিকে হাঁটার রুটিন যেমন ছিল, তেমনি ছিল ছবি আঁকা, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃত, অঙ্কশাস্ত্রের ওপর পড়াশোনার ব্যবস্থা। এই গৃহশিক্ষাগুলো হতো রেগুলার স্কুলে যাওয়ার আগে ও পরে। এত চাপ ও স্কুলের রুটিনমাফিক পড়াশোনা দেখে তখন থেকেই এই শিক্ষাপ্রণালির ওপর তাঁর বিতৃষ্ণা ধরে যায়। পরবর্তীকালে বিলাতে শিক্ষা নিতে গিয়েও শিক্ষা সমাপ্ত না করে তিনি ফিরে আসেন। এক নবকুমারের লেখাপড়া করার এই ছিন্নভিন্ন অবস্থা কেমন ভাবিয়ে তোলে। নজরুলের বেলায় না হয় বুঝলাম, বেচারার ফকিরি অবস্থা ছিল, কিছু করার ছিল না। কিন্তু জমিদার-তনয়ের এ কেমন আলগা আলগা ব্যবস্থা?
* তাঁর কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, গীতিনাট্য, গান
ওপরের সব কটি বিভাগে তিনি বাংলা সাহিত্যকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন যে এই দেড় শ বছরের ওপর হয়ে গেলেও কেউ কোনো বিভাগে তাঁকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি। তিনিই এ পর্যন্ত একমাত্র বাঙালি, বস্তুত ভারতীয়, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার গৌরব ভারতবাসীকে এনে দিয়েছেন। তিনিই একমাত্র কবি, যাঁর কবিতা বা গান দুটি দেশের জাতীয় সংগীত হতে পেরেছে, এবং অন্য আরেকটি দেশের জাতীয় সংগীতের ওপর প্রভাব ফেলেছে। মাত্র সাত বছর বয়সে, ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ বলে যে কবিতা লিখেছিলেন, তা আজও প্রায় সব বাঙালির মনে আছে। আরও আছে, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর নদে এলো বান’-এর কথা। অল্প বয়সে বৈষ্ণব পদাবলির ধাঁচে ভানুসিংহের পদাবলি লিখে পণ্ডিতদেরও তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’ এখনো মানুষ আওড়ে ও গেয়ে চলেছে। এরপর একেকটা কবিতা বা কাব্যের লাইনের পর লাইন আমাদের মনের মধ্যে সদাই ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে তুলে ধরতে পারি: ১. ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর’, ২. মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই, ৩. ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা, কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা, ৪. ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট্ট এ তরী, আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’, ‘বনের পাখি বলে, সেথা কোথা উড়িবারে পাই, খাঁচার পাখি বলে, হায় মেঘে কোথা বসিবার ঠাঁই’, ৫. ‘যেতে নাহি দিব, হায় তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়, ৬. ‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, যার আছে ভূরি ভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’, ৬. ‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম। পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী’, ৭. ‘শৈবাল দিঘীরে কহে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির’, ৮. ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’, ৯. ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে’, ১০. ‘মন্ত্রী কহে আমারো ছিল মনে, কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে’, ১১. ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, তুমি যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান’, ১২. যারে তুমি ফেল নীচে, সে তোমারে বাঁধিছে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমাকে পশ্চাতে টানিছে’, ১৩. ‘ঘরেতে এলো না সে যে, মনে তার নিত্য যাওয়া আসা, পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’, ১৪. ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান, গ্রহণ করেছ যত, ঋণী তত করেছ আমায়’।
কবিতা ছেড়ে এখন তাঁর গান সম্বন্ধে কিছু কথা বলা যাক। রবীন্দ্রনাথের গান সংগীতজগতে একটি সম্পূর্ণ অন্য ধারা নিয়ে এসেছে। এতে জীবনের সবকিছুরই ছোঁয়া আছে। পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলি এবং অন্যান্য নানা ধরনের গান। রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে কোন গানগুলো আমাকে নাড়া দেয়, এটি একটি ভীষণ কঠিন প্রশ্ন। এ যেন খড়ের গাদা থেকে সুই খুঁজে বের করার মহড়া। যদিও পূজা ও স্বদেশ পর্বই আমার বেশি প্রিয়, তবু কয়েকটার কথা উল্লেখ করা যায়, যেমন: ১. আগুনের পরশমণি, ২. আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, ৩. আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে, ৪. আমার সকল দুখের প্রদীপ, ৫. ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু, ৬. ভেঙে মোর ঘরের চাবি, ৭. আমি চিনি গো চিনি, ৮. গ্রামছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ, ৯. ওগো নদী আপন বেগে, ১০. তুমি কি কেবলই ছবি, ১১. যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন, ১২. শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, ১৩. আমি জেনেশুনে বিষ, ১৪. তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, ১৫. পুরানো সেই দিনের কথা, ১৬. ফুলে ফুলে, ঢলে ঢলে ইত্যাদি।
এগুলো যেমন নাড়া দেয়, তেমন রবীন্দ্রসংগীত সম্বন্ধে একটা মিশ্র অনুভবও আছে। ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর প্রধানতম শিষ্য ওস্তাদ আত্তা হোসেনের শিষ্য, বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, শিল্প, সংস্কৃতিজগতে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব শ্রী অরুণ ভট্টাচার্য। তিনি সঙ্গীতচিন্তা নামে তাঁর মৌলিক ও প্রামাণ্য গ্রন্থে সংগীতের রূপরেখা সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রসংগীত নিয়েও কথা বলেছেন। এখানে তা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:
‘রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, বাংলা ভাষায় গান রচনা করতে হলে সেই গান বাঙালির গান হবে, অথচ একই সঙ্গে, ভারতীয় সংগীতের ঐতিহ্য বহন করবে। বাঙালির গান অর্থে সেই গীতিকারের মূল সুরে এমন মানসিকতা বর্তাবে যা বাঙালির রস-পিপাসু চিত্তকে আকর্ষণ করবে। সুরে এবং ছন্দের নমনীয়তায় তা অন্যান্য প্রাদেশিক সংগীত থেকে পৃথক হয়ে বাঙালির গানের বৈশিষ্ঠগুলিকে অর্জন করবে। অন্যদিকে ভারতীয় সংগীতের আদর্শে তার অবয়ব গঠিত হবে।’ তিনি চেয়েছেন, ‘শুধুমাত্র সুরের মোহজালেই শ্রোতাকে অভিভূত করবেন না, কবিতার ভাব ও গভীরতা যেন একই সঙ্গে শ্রোতার মনে সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ তাঁর রচিত ও সুর-আরোপিত গানে কথা ও সুর কেউ কারও চেয়ে ছোট নয়। সুর কথাকে ঘিরে রাখবে, কথা সুরকে গভীরতর মগ্নতার দিকে টেনে নিয়ে যাবে।’
রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে উচ্চাঙ্গসংগীতের তফাত আছে। সে ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘খেয়াল গানে যদিও বাণী অনুপস্থিত নয়, তথাপি গায়ন পদ্ধতিতে বাণীর যে প্রাধান্য থাকে না, তা অস্বীকার করে লাভ নেই— সেখানে সুর, একমাত্র সুরের আবর্তই প্রধান। ...যতই আমাদের রাগপ্রধান গান ভালো লাগুক, তথাপি এ সত্য স্বীকার করা ভালো, বাংলা গানের বিভিন্ন ধারার গানগুলিতে যে একটি নিজস্ব বাঙালিয়ানা আছে, রাগপ্রধানগুলিতে যেন তা ঠিক নেই— সেগুলি যেন হিন্দি খেয়ালের অনেকটা ফটোকপি-কপি।’ এ পর্যন্ত তবু ভালো।
কিন্তু অরুণ ভট্টাচার্য মহাশয় এর উল্টো দিকেও রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রবীন্দ্রসংগীতে পূর্ববাংলার লোকসংগীতের বিন্দুমাত্র স্পর্শ নেই। রবীন্দ্রনাথের গুণী সমালোচকেরা বলে থাকেন, বাংলাদেশের বা বাংলার বাইরে সম্ভাব্য সকল রকম সংগীতের বহমান ধারা থেকে উপাদান গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের শরীরকে পুষ্ট করেছেন। কিন্তু লোকসংগীত বাংলা সমাজ-মানসের একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে। ভাবের ঐকান্তিকতায়, সুরের মর্মস্পর্শী আবেদনে, সুরকার রবীন্দ্রনাথকে কি তা একটুও নাড়া দেয়নি?
‘এটা ঠিক, শিশুকাল থেকে রবীন্দ্রনাথ রাগরাগিণী শুনে তাঁর কান তৈরি করেছিলেন। সে জন্য দীর্ঘদিন পর্যন্ত যখনই কোনো গানে সুর আরোপ করেছেন, শুদ্ধ বা মিশ্র রাগ বা রাগের ছায়া সেখানে উপস্থিত থেকেছে। এবং এ কথা সত্য, লোকসংগীত, রাগ সংগীতের বিপরীত মেরুতে। বিশেষ করে পূর্ববাংলার প্রচলিত লোকসংগীত ভাটিয়ালীতে যে রাগসঙ্গীতের কোনো প্রকাশ নেই, এটা সর্বজনস্বীকৃত। তাহলেও রবীন্দ্রনাথ যখন বাউলের ঢং আশ্রয় করেছেন, পরবর্তীকালে নানারকম পরীক্ষা করতে গিয়ে কীর্তনের ঢংও মাঝেমধ্যে ব্যবহার করেছেন, তখন পূর্ববাংলার লোকসংগীতের রেশ তাঁর গানে না থাকাটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।
‘রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে বরাবরই আত্মগত হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন, এবং বাউল তাঁর ভালো লাগার কারণ হিসেবে, সেই সাবজেকটিভ টোন-এর উল্লেখ করা যেতে পারে হয়তো। অন্য পক্ষে, লোকসংগীতের আবেদন বিষয়গত— সামাজিক বিন্যাসে পল্লীজীবনের সুখ দুঃখ আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসেবে লোকসংগীতের আবেদন। বিষয়গত আবেদন বলেই কি দার্শনিক রবীন্দ্রনাথকে তা আকর্ষণ করেনি? বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে একদিকে যেমন বনেদি আভিজাত্যের চিহ্ন সুস্পষ্ট ছিল, অন্যদিকে লোকসংস্কৃতির ধারায় একটা গণচেতনা পাশাপাশি কাজ করেছে। সেখানে রুচির প্রশ্ন এতটা উঁচু পর্দায় বাঁধা থাকত না। শ্লীলতার শাসন আলগা ছিল, কবিগান বা পাঁচালিতে সমকালের সমাজ চিত্র বা লৌকিক ধর্মীয় কাহিনি অনুসৃত হতো। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা, রুচি ও আভিজাত্যের বর্ম এত সুনির্দিষ্ট ছিল যে, এ সকল আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল থাকলেও তাঁর শিল্পচর্চাকে তা কোনোদিনই প্রভাবিত করতে পারেনি। শিল্পের বিচারে, রসের বিচারে, যা উতরোয়নি, রবীন্দ্রনাথ তাকে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন— এদিক থেকে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা লক্ষ্য করবার বিষয়।’
সংগীত ছেড়ে একটু গদ্যে আসি। গদ্য প্রসঙ্গের কথা উঠলে বলতে হয়, গোরা উপন্যাসটি পড়েনি এমন বাঙালি কম আছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রবন্ধটির দুটো জায়গা আমার এখনো মনে আছে। এক সাহিত্যসভার কথা, যেখানে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্কিমকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু, দীর্ঘকায়, প্রৌঢ় পুরুষ, চাপকান পরিহিত বক্ষের ওপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দণ্ডায়মান ছিলেন।’ মনে হয় ওই একই প্রবন্ধে ছিল, ‘আমরা শিক্ষায়তনে যতটুকু শিক্ষা পাই, ততটুকু বিদ্যা পাই নে।’ তাঁর নাটকগুলোর মধ্যে ভালো লাগে রক্তকরবী আর চিরকুমার সভা। আর ভালো লাগে চণ্ডালিকা, তাসের দেশ, চিত্রাঙ্গদা, মায়ার খেলা ও শ্যামা।
* তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসসমূহ
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর বর্ণনায় আমরা জানতে পারি, যখন ক্লাসে শেলি এবং কিটস পড়াতেন, রবীন্দ্রনাথ এমন পাংকচুয়াল ছিলেন যে, সেই পাঁচ বছরে এক দিনের জন্যও লেট করেননি। ক্লাস শুরুর ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্লাস শুরু করতেন এবং ক্লাস শেষের ঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস শেষ করতেন।
আলী সাহেবের মতে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পরিশ্রমী লেখক। তিনি বলেছেন, ‘কল্পনাই করতে পারা যায় না রবি ঠাকুর কী রকম পরিশ্রম করতেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যুর পর ডা. বিধান চন্দ্র রায় রবি ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়েছিলেন একটা কবিতার জন্য। কথাটা রবি ঠাকুরকে বলতেই তিনি নাকি হেসে উঠে বিধান রায়কে বলেছিলেন, “ওহে ডাক্তার, এটা কি তোমার ডাক্তারি নাকি? বুকে স্টেথেস্কোপ ধরলে আর কলমের ডগা দিয়ে প্রেসক্রিপশন বেরিয়ে আসল। তা তুমি যখন এসেছ তোমাকে তো আর খালিহাতে ফেরানো যাবে না। ঠিক আছে, তুমি বসো, আমি আসছি।”’ এ কথা বলে রবি ঠাকুর নাকি দোতলায় চলে যান ও কিছুক্ষণ পর একটি কবিতা এনে বিধান রায়ের হাতে দেন।
আলী সাহেব সৌভাগ্যক্রমে প্রায় এক বছর শান্তিনিকেতনে ছিলেন রবি ঠাকুরের নিচের তলায় এক ঘরে। সেখান থেকে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ালেই তিনি দেখতে পেতেন গুরুদেব তাঁর জানালার পাশে বসে লেখাপড়া করছেন। ভোর চারটার সময় দুই ঘণ্টা উপাসনা করতেন। তারপর ছয়টার সময় স্কুলের ছেলেমেয়েদের মতো লেখাপড়া করতেন। সাতটা, আটটা, নয়টা, তারপর দশ মিনিটের ফাঁকে জলখাবার। আবার কাজে লেগে যেতেন—দশটা, এগারোটা, বারোটা। তারপর খেয়েদেয়ে আধা ঘণ্টা বিশ্রাম। আবার কাজ লেখাপড়ার—একটা, দুটো, তিনটে, চারটে, পাঁচটা। কেবল কাজ আর কাজ। পাঁচটা থেকে সাতটা ছেলেমেয়েদের গান শেখাতেন বা দিনুবাবুর আসরে বসে গান শুনতেন, অথবা গল্পসল্প করতেন। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে আবার লেখাপড়া। মাঝেমধ্যে গুন গুন করে গান, আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত। তাঁর অমানুষিক কাজ করার ক্ষমতা ছিল আর তেমনি ছিল তাঁর অসীম জ্ঞানতৃষ্ণা। সত্যিই নাড়া দেওয়ার মতো।
রবীন্দ্রনাথের অনেক চিঠি আলী সাহেব নিজ হাতে কপি করে দিয়েছেন। অনেকেই নিজ থেকে তাঁর চিঠি কপি করে দেওয়ার জন্য নিয়ে যেত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত করে দিতে পারত না। তাদের কাছ থেকে সেগুলো ফেরত আনতে হতো। ‘ভাবতেও অবাক লাগে, রবি ঠাকুরের মতো লোককে গোরার মতো উপন্যাস নিজ হাতে তিনবার কপি করতে হয়েছিল। পূরবী কাব্যটি পর্যন্ত রবি ঠাকুর নিজ হাতে তাঁর সকল বইয়ের প্রুফ দেখতেন।
‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে রবি ঠাকুর খুব পছন্দ করতেন। মাইহার থেকে আলাউদ্দিন খান শান্তিনিকেতনে আসতেন। তাঁকে রবি ঠাকুর যে বাড়িতে থাকতেন, তার সবচেয়ে কাছের ঘরে থাকতে দেওয়া হতো। উস্তাদ আলাউদ্দিন খান শান্তিনিকেতনে থাকার সময় প্রায় দিনরাত, চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর ঘরে বসে বাজনা বাজাতেন। কেউ যদি তাঁকে প্রশ্ন করতেন, খাঁ সাহেব, আপনি দিনরাত বাজাচ্ছেন কেন? উত্তরে উস্তাদ আলাউদ্দিন খান বলতেন, “গুরুদেব ব্যস্ত মানুষ, উনি কখন অবসরে থাকেন তাতো আমি জানি না। তাই আমি দিনরাত বাজিয়ে যাই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গুরুদেবের যখন অবসর হবে তখনই তিনি আমার বাজনা শুনবেন।”’
* তাঁর পারিবারিক অবস্থা-দাম্পত্য জীবন
স্ত্রীকে রবি ঠাকুর খুব ভালোবাসতেন। স্ত্রীর অসুস্থতার সময় রবি ঠাকুর তাঁর যে সেবা করেছেন, তা খুবই বিরল। এ প্রসঙ্গে মুজতবা আলী তাঁর ‘মৃত্যু’ নামক রম্যরচনায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের শিষ্য অজিত চক্রবর্তীর মাতা কবিজায়ার মৃত্যুর কুড়ি বৎসর পর আমাকে বলেন, মৃণালিনী দেবী তাঁর রোগশয্যায় এবং অসুস্থাবস্থায় তাঁর স্বামীর কাছ থেকে যে সেবা পেয়েছিলেন তেমনটি কোনো রমণী কোনো কালে তাঁর স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছে বলে তিনি জানেন না।’ তিনি বলেন, ‘স্ত্রীর মানা, অনুরোধ না শুনে তিনি নাকি রাত্রির পর রাত্রি তাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করেছেন।’ একটা দোলা দেওয়ার মতো ঘটনা বটে।
* তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা
রবি ঠাকুর যে জীবনে কী দুঃখকষ্ট পেয়েছেন, তা সাধারণ লোক কল্পনাও করতে পারবে না। সবারই ধারণা, রবি ঠাকুর জমিদারের পুত্র ছিলেন। তাঁর কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে রবি ঠাকুর শেষ জীবনে তাঁর হাতঘড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মৃণালিনী দেবী শান্তিনিকেতনে আশ্রম করার জন্য তাঁর সব গয়না দান করেছিলেন। রবি ঠাকুর নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকা দিয়েই একটি কো-অপারেটিভ ব্যাংক খুলেছিলেন, সে টাকা আর কখনোই ফেরত পাননি। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, এই সব কথা স্বীকার করতে অনেকেরই খুব কষ্ট হয়। এটা একটা মোচড় দেওয়ার মতো খবর বটে।
* তাঁর শেষ জীবন
মৃত্যুর আগের শেষ কালটা কারোরই ভালো কাটে না। একেকজনের ভাগ্যে একেক ঘটনা ঘটে তা একসময় শেষ হয়। রবীন্দ্রনাথের শেষের দিনগুলো তেমন সুখের না হলেও তেমন একান্ত অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। তাই দোলা পাওয়ার মতো আলাদা তেমন কিছু নেই এতে।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই যে রবীন্দ্রনাথকে একেবারে দেবতা না ভেবে একজন মাটির মানুষ ভাবাই প্রয়োজন। সংগীত ছাড়াও পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর কিছু কিছু অসম্পূর্ণতা থাকতেই পারে। সে জন্য কিছু কিছু প্রতিকূল মতামত ও সমালোচনাও বাজারে চালু আছে এবং আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু যেহেতু দোষে-গুণে মানুষ, সে নিখুঁত নয়, সেদিক দিয়ে দেখলে বাঙালির জীবনে একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর সমকক্ষ কেউ নেই।