যোগ্যতা

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ফারুক সাহেবের বনানীর বাসা থেকে ইকবাল হাসিমুখে বেরিয়ে এল। আজ তার জীবনের প্রথম চাকরি প্রাপ্তি। হোক না সেটা গাড়ির ড্রাইভারের। সে প্রাণিবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে প্রায় তিন বছর আগে। বিসিএস পরীক্ষা আর শত আবেদনের পরও তার চাকরি হয়নি। অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে ক্যাব ড্রাইভার রুমমেটের পরামর্শে গাড়ি চালানো শিখে আবেদন করতে থাকে। সে অবশ্য তার আবেদনপত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ইন্টারমিডিয়েট লিখেছে। যে বাড়তি যোগ্যতা তাকে গত তিন বছর বেকার রেখেছে তার উল্লেখ না করলে কী এসে যায়। বরং মুছে ফেলে দিলে বেকার জীবন অবসানের ক্ষীণতম একটা সম্ভাবনা থাকে।

চাকরিদাতা ফারুক আহমেদ সরকারের একজন অতি উচ্চপদস্থ আমলা। সরকারি কাজের জন্য ড্রাইভার আর গাড়ি আছে। তাকে পারিবারিক কাজের জন্য বিশেষত বাজারসদাই আর মেয়ের ভার্সিটিতে আনা নেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে। সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত তার ডিউটি। তিনবেলা খাবার আর বছরে এক মাস ছুটি। সারভেণ্ট কোয়ার্টারে তার থাকার ব্যবস্থা থাকলেও সে বাইরে থাকার অনুমতি পেয়েছে। সে একটা টিউশনি করে। সেই টাকায় তার ঘর ভাড়া চলে যাবে। আর অন্যের বাড়িতে থাকতে তার পরাধীন পরাধীন লাগে।

প্রথম দিন চাকরিদাতার মেয়ে সুমনাকে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে নামিয়ে দেওয়ার পর সে বলল, আপনার মোবাইল নম্বরটা দেন? যখন ক্লাস শেষ হবে তখন কল দেব।
আপা আমার কোনো মোবাইল ফোন নেই।

সুমনা কিছুটা বিরক্ত আর আশ্চর্য হয়ে বলে, মোবাইল ফোন ছাড়া ড্রাইভারের চাকরি করতে এসেছেন কেন? তাহলে ক্লাস শেষে কীভাবে কনটাক্ট করব? এই বলে সে হনহন করে জিওলজি ডিপার্টমেন্টে ঢুকে গেল।
ইকবাল লজ্জা আর অপমানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ক্লাস শেষে একই জায়গা থেকে সে সুমনাকে গাড়িতে তুলে নেয়। বাসায় ফেরার পথে মার্কেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে অন্যান্য টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে একটি মোবাইল সেট আর সিম কার্ড কিনে সুমনা তাকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কীভাবে লাইন অ্যাকটিভেট করতে হয় জানেন তো?
ইকবাল না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।
সুমনা আরও বিরক্ত হয়ে বলে, আজব তো! তারপর গাড়িতে বসেই সে মোবাইল ফোন ঠিকঠাক করে তার হাতে দিয়ে বলল, সাবধানে রাখবেন যেন আবার হারিয়ে না যায়।
ইকবাল থতমত ভঙ্গিতে সেটটা হাতে তুলে নেয়।
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। ক্লাস শেষে বাসায় ফিরতে ফিরতে গাড়িতে বসে মোবাইলে সুমনা তার এক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলছে। জব্বার স্যার কবে জীবদেহে বিকিরণের প্রভাব এই অ্যাসাইনমেণ্টটা দিল? আমি তো এর কিছুই জানি না?
ওপাশ থেকে তার বান্ধবী কী বলল তা ইকবাল শুনতে পেল না।
সুমনা আবার বলল, কালকে সকালের মধ্যে কীভাবে জমা দেব? তারপর মন খারাপ করে লাইন কেটে দিল।
রাতে ইকবাল মেসে ফিরে এসে খাটের নিচ থেকে তার বই আর নোটপত্রের ট্রাঙ্ক টেনে বের করল। তার যত দূর মনে পড়ে এই ধরনের একটা অ্যাসাইনমেন্ট সে অনার্সে থাকতে করেছে। অনেক খুঁজে পেতে সে ড. আবদুল জলিলের লেখা একটা বই পেল। সেখানে জীবদেহে বিকিরণের প্রভাব নামে একটা চ্যাপটার আছে। তারপর সে রাত জেগে অ্যাসাইনমেন্ট লিখতে বসে গেল।
বিকিরনপাত জীবদেহে সামান্য চুল পড়া থেকে শুরু করে জীবন সংহারী ক্যানসারসহ নানাবিধ মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং বংশধরদের ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ছাপ রাখে। শক্তি হিসেবে বিকিরণকে মূলত দুটি প্রধান দলে ফেলা যায় ১) তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ২) অতেজস্ক্রিয় বিকিরণ।
ভোরবেলা সে নয় পাতার লেখা শেষ করে।
পরদিন সকালে গাড়ি ডিপার্টমেন্টের সামনে থামিয়ে পেছনের দরজা খুলে দিয়ে সে অ্যাসাইনমেন্টের ফোল্ডারটা সুমনার হাতে তুলে দেয়। সুমনা গাড়িতে ফেলে যাওয়া নোট ভেবে হাতে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে ঢুকে যায়।
ক্লাস শেষে গাড়িতে উঠে সুমনা অবাক চোখে ইকবালকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি এই অ্যাসাইনমেন্ট পেলেন কীভাবে?
ইকবাল কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলে। তারপর নিজেকে সামলে বলল, আমি রুমমেটকে অনুরোধ করে আপনার জন্য লিখিয়ে এনেছি। সেও প্রাণিবিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করেছে।
সুমনা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ইকবালকে ধন্যবাদ দেয়। আর তার রুমমেটকে অসংখ্য কৃতজ্ঞতা পৌঁছে দিতে বলে।
বেশ কিছুদিন পরে সকাল–সন্ধ্যা হরতাল। সন্ধ্যায় এক বান্ধবীর জন্মদিনে যেতে হবে ভেবে সুমনা ফোনে সন্ধ্যার আগে আগে ইকবালকে বাসায় আসতে বলল। সে হরতাল শেষ হাওয়ার আগে হাঁটা পথে বনানীতে সুমনাদের বাসার দিকে রওনা হয়। চেয়ারম্যান বাড়ির ট্রাফিক সিগন্যালে এসে হরতাল পিকেটারদের সঙ্গে র‍্যাবের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার সময় সে ধরা পড়ে। র‍্যাব হেড-কোয়ার্টারে নিয়ে তার মোবাইল কেড়ে নিয়ে গণধোলাই দেওয়া হয়। শেষরাতে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর সে র‍্যাবের একজনকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে সুমনাকে ফোনে পুরা ঘটনা জানায়। সুমনা তার বাবা ফারুক আহমেদকে বললে সে সঙ্গে সঙ্গে র‍্যাব হেড-কোয়ার্টারে কর্তব্যরত সাব-ইন্সপেক্টর বশীরকে ফোন করে ইকবালকে অ্যারেস্টের কারণ জানতে চান।
বশীর দাঁত কেলিয়ে উত্তর দেয়, স্যার, এমন ডলা দিয়েছি যে আগামী এক মাস বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না। কত বড় সাহস র‍্যাবের সঙ্গে মাস্তানি।
সুমনার বাবা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করেন, ইকবাল আমার নাম বলার পরেও তোমরা আমাকে ফোন করনি কেন?
স্যার, আপনি তো আপনি। কাল ডলা দেওয়ার সময় একজন বলল যে, সে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিকট আত্মীয়। তারপর মুগুরডলা শেষে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাটা বল তোর আত্মীয়ের নাম কি? সে ঘাবড়ে গিয়ে কৃষিমন্ত্রীর নাম বলল। চিন্তা করেন স্যার ওই পোলা কত বড় ধুরন্ধর। দিলাম আবারও মুগুরডলা, হা–হা–হা।
নোংরা হাসি শুনেও ফারুক আহমেদ চরম ধৈর্যের পরিচয় দিলেন। হাসিমুখে বললেন, তা ঠিক। তারপর নরম গলায় বশীরকে জিজ্ঞাসা করলেন, বশীর ছুটিতে যেতে ইচ্ছে করে না?
বশীর আরও বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, স্যার গত এক বছর এই (গালি দিয়ে) হরতাল–পিকেটারদের জন্য ডিউটি থেকে কোনো ছুটি পাইনি।
ফারুক আহমেদ আফসোসের সুরে বললেন, মন খারাপ করো না বশীর। তোমার জন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনা বেতনে এক বছরেরে ছুটি মঞ্জুর করা হবে। আর ইকবালকে বিনা কারণে মুগুরডলা দেওয়ায় কেন তোমার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তার কারণ দর্শানোর নোটিশসহ আগামীকাল আদালতে হাজির হতে হবে। তাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোন নামিয়ে রাখল। তারপর পার্সোনাল সেক্রেটারিকে বশীরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আর ইকবালকে র‍্যাব হেড-কোয়ার্টার থেকে ছাড়িয়ে এনে ক্লিনিকে ভর্তি করার নির্দেশ দিল।
ইকবালকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো। তার সেরে উঠতে আরও সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে। এক বিকেলে অনেক খাবার আর ফুলের তোড়া নিয়ে সুমনা তাকে ক্লিনিকে দেখতে এল। শরীরের খোঁজ খবর নিয়ে ফুলের তোড়াটা ইকবালের হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আপনার জন্য দুঃসংবাদ আর সুসংবাদ দুটোই আছে। কোনটা আগে জানতে চান বলুন?
ইকবাল মাথা নিচু করে বসে থাকে।
সুমনা একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে, আচ্ছা দুঃসংবাদটাই আগে দিই। আপনার লেখা অ্যাসাইনমেণ্টটা পড়ে তারপর সেটার হাতের লেখা চাকরির আবেদনপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে আমার কৌতূহল আরও ঘনীভূত হয়। বাবাকে ব্যাপারটা জানলে, সে খোঁজ খবর করতেই পুরো ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। তাই প্রথমে শিক্ষাগত যোগ্যতা গোপনের অভিযোগে আপনাকে ড্রাইভারের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু আপনার ভদ্রতা, নম্রতা আর মেধার কথা বিবেচনা করে বাবা আপনাকে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে এক্সিকিউটিভ পদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যোগদানের তারিখটা ওপেন আছে। আপনি সুস্থ হয়ে ধীরে সুস্থে জয়েন করতে পারবেন। এই বলে দুটো খামই ইকবালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে মিষ্টি হেসে উঠে পড়ে।
ইকবাল সুস্থ হয়ে কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় জিপিওতে বসে সুমনাকে একটা চিঠি লেখে। আপনাদের পরিবারকে ধন্যবাদ জানাবার মতো ভাষা আমার নেই। আমার বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই যে, আমি যোগ্যতা লুকিয়ে মহা অন্যায় করেছি। তবে এ কথাও ঠিক যে, নিজের যোগ্যতার মাপকাঠিতে যতটুকু পাওয়া যায় তাতেই আমি সন্তুষ্ট। যেখানে যোগ্যতাকে সুপারিশের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় সেখানেই আমার যত আপত্তি আর অপারগতা। আর তাই আপনার বাবার সুপারিশের চাকরিতে জয়েন করতে মন থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছি না। বাধ্য হয়ে সুসংবাদের খামটা ফেরত দিতে হচ্ছে। আর চাকরি হারানোর সুবাদে মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগও হারিয়েছি। সেটাও সঙ্গে পাঠালাম।
সবকিছু ডাকে ফেরত পাঠিয়ে জিপিও থেকে বেরিয়ে তার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। আবার তাকে চাকরি খোঁজার সংগ্রামে নামতে হবে। যেটা হবে যোগ্যতার পরীক্ষায় তার আপসহীন সংগ্রাম।

নাইম আবদুল্লাহ: সিডনি প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক।