যে শিক্ষা স্বপ্ন দেখায়

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমার ফুটফুটে মেয়ের যখন তিন বছর বয়স, একদিন আমাকে গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, মা তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?

আমি হেসে উত্তর দিলাম গ্র্যান্ডমা (দাদি-নানি) হতে চাই। আমার অনেক নাতি নাতনি হবে। আমি সারা দিন পান খাব আর ওদের সঙ্গে গল্প করব। গান করব আর খেলা করব। তারপর আমার মেয়েকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?
মেয়েটি আমার খুব ভাব নিয়ে উত্তর দিল, আই ওয়ান্ট টু টিচ এ পিগ হাউ টু সুইম ইন এ ডিপ ডিপ ওশান (আমি একটি শূকরকে গভীর সমুদ্রে সাঁতার শিখাতে চাই)।
আমি ভয় পেয়ে জানতে চাইলাম, কিন্তু কেন?
মেয়ে বলল, কারণ শূকর জানে না কীভাবে সাঁতার কাটতে হয়।
প্রথমে মেয়ের উদ্ভট চিন্তায় শঙ্কিত হলেও বিশ্লেষণে এই ভেবে আশ্বস্ত হলাম, মা-খালা, বাবা-চাচা সবাই শিক্ষক, হয়তোবা জেনেটিকভাবে শিক্ষকতার সুপ্ত গুণ তার মধ্যে বিকশিত হচ্ছে। আমার মেয়ে যখন কিন্ডারগার্টেনে পড়ে তখন সে হতে চেয়েছিল জেনিটর। আবারও ভয় পেয়েছিলাম এবং জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন?
মেয়ে আমার উত্তর দিল, কারণ একজন জেনিটরের অনেক চাবি আছে এবং সে যেকোনো দরজা খুলতে পারে।
সত্যিই তো, একজন জেনিটরের এই ক্ষমতার কথা কখনো ভেবে দেখিনি। তারপর সে রক অ্যান্ড রোল স্টার, শিক্ষক, ডাক্তার অনেক কিছু হতে চেয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সে হতে চেয়েছে আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট। মাঝে মাঝে আমার মেয়েটি আমাকে বলত, মা আমি হিলারিকে পছন্দ করি না, ও আমার স্বপ্নকে কেড়ে নিয়েছে, আমি আমেরিকার প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলাম, হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে আমি আর ইতিহাস তৈরি করতে পারব না।
আমি আমার মেয়েকে আশ্বস্ত করে বলতাম, কে বলে তুমি ইতিহাস তৈরি করতে পারবে না, তুমি হবে আমেরিকার প্রথম মুসলিম মহিলা প্রেসিডেন্ট।
আমাদের জীবনটা স্বপ্ন আর সৌন্দর্যে ভরা। এস লে স্মিথ বলেছেন, তুমি সুন্দর খুঁজে পাবে ভ্রমর, ছোট শিশু, হাসি মাখা মুখ, বৃষ্টির গন্ধ এবং বাতাসের ছোঁয়ায়। আমার মেয়ের এই স্বপ্নে আমি সৌন্দর্য পেয়েছি। আর তা হলো প্রেসিডেন্ট হওয়া নয়, ইতিহাস তৈরি করার। এলিনয় রুজভেল্ট বলেছেন, ভবিষ্যৎ তাদের যারা নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রাখে। আর আমি আমার মেয়েকে বলেছি, তার স্বপ্নে বিশ্বাস রাখতে। তবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার এবং সমাজ ব্যবস্থার এখানে দায়িত্ব হলো, সে বিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সুন্দর ভবিষ্যৎ এ জাগরণের পথে দেখা দেবেই।
আসলে আমরা যখন শিশুদের প্রশ্ন করি তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও, তখন শিশুরা আজ থেকে দশ বা পনেরো বছর পরে কী হবে তা কল্পনা করে উত্তর দেয় না। শিশু মনের বর্তমানের ভাবনা তাদের ইচ্ছা রূপে প্রকাশ পায়। এ কারণে শিশুরা মেঘ, বৃষ্টি, রোদ, পাখি, বিড়াল অনেক কিছুই হতে চায়। একটি শিশু শিশুকাল কিংবা কৈশোরে যা হতে চায় তার সঙ্গে সে ভবিষ্যতে কী হবে তার মিল নাও থাকতে পারে। তবে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে বর্তমান ভাবনার প্রকাশের মাধ্যমে সে তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় বিকশিত করে। সে নিজেকে শ্রদ্ধা করতে শিখে এবং ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন করে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। স্বপ্ন শূন্য মন হতাশা আর বিষণ্নতায় পরিপূর্ণ থাকে। তালা মান্সি নামে এক শিক্ষক লেবাননের মওসাব আল তেলাইয়েনি নামক একটি শরণার্থীশিবিরে জয়নব নামে এক শিশুকে যখন প্রশ্ন করেছিল, তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? তখন শিশুটি বিষণ্ন চিত্তে উত্তর দিয়েছিল, আমি কিছুই হতে চাই না।
জয়নবের বাবা-মা সিরিয়াতে যুদ্ধে মারা গেছে। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা যুদ্ধে লিপ্ত। পরিবার শূন্য জয়নব আপনজন ছেড়ে, স্বদেশ ছেড়ে তখন শরণার্থী শিবিরে। তাই তার হতাশ মন কিছুই হতে চায়নি। বেঁচে থাকাটা যার জন্য অনিশ্চিত, তার জন্য ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা হয়তো বা নিরর্থক স্বপ্ন বিলাসিতা। জয়নব তিন মাসের একটি বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল, যেখানে তাকে ভাষা ও গাণিতিক বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। তিন মাসের এ কার্যক্রম শেষে জয়নবকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? আর জয়নব তখন উত্তর দিয়েছিল, আমি একজন শিক্ষক হতে চাই।

লেখিকা
লেখিকা

আসলে শিক্ষা যখন স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হয়, জীবনের মূল্য শেখাতে ব্যর্থ হয়, তখন সে মূল্যহীন শিক্ষা জীবনকে করে তোলে অর্থহীন। সে কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার শিক্ষা জয়নবের জীবনকে করেছিল অর্থহীন। যে শিক্ষা বাঁচতে শেখায়, ভাবতে শেখায়, আর স্বপ্ন দেখাতে শেখায়, সেই শিক্ষা হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষা। তিন মাসের শিক্ষা কার্যক্রম জয়নবকে প্রকৃত শিক্ষা দিতে পেরেছিল বলেই জয়নব তার স্বপ্ন ফিরে পেয়েছিল।
শিক্ষা বাঁচতে শেখায়, বাঁচাতে শেখায়, হারতে শেখায়, হারাতে শেখায়, মূল্য দিতে শেখায়, মূল্য পেতে শেখায়, স্বপ্ন দেখতে শেখায়, স্বপ্নের পথে হাঁটতে শেখায়। শিক্ষা করে তোলে আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী ও বিনীত। শিক্ষা আমাদের নিজেদের বুঝতে শেখায়, আমরা কী পারব আর কী পারব না। শিক্ষা আমাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখায়, স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ করতে শেখায়। আর এ কারণে শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত সব দেশে শিশুদের শিশুকাল থেকে বড় হয়ে কি হতে চাও, এ প্রশ্নের মাধ্যমে সুপ্ত বাসনা প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া হয়।
কিছুদিন আগে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। তখন আমেরিকায় নির্বাচনী হাওয়া বইছে। তাই অনেক মেয়ে শিশু এবং কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন বেশি লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, শিল্পী, খেলোয়াড় কিংবা ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্নগুলোও বাদ যায়নি। আসলে এখানকার শিশুরা যা স্বপ্ন দেখে সমাজ আর রাষ্ট্র তাতে সমর্থন দেয়। আর এ কারণে প্রায় আড়াই শ বছর আগে আমেরিকার ফাউনন্ডিং ফাদার বহুজাতিভিত্তিক একটি গণতান্ত্রিক সমাজের যে ভিত্তি স্থাপন করেছিল, তাতে একজন মুচির ছেলের পক্ষে প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব হয়েছিল।
পঞ্চাশ বছর আগে মার্টিন লুথার কিং I have a dream মন্ত্রে সিভিল রাইট প্রতিষ্ঠা করে যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিল তারই অঙ্কুরণ হয়েছে ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাধ্যমে।
আমেরিকানরা যখন প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তখন আমার মেয়ে, যে কিনা প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীর সন্তান সেও প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। অথচ যে দেশে আমার জন্ম সে দেশে নারী অনেক আগেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। তবে তা তাদের বাবা বা স্বামীর পথ ধরে। তাই দেশের বড় পদবির স্বপ্নটা তারা নিজের পরিবারের মধ্যে আটকে রেখেছেন, জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেননি।
আমার মেয়ে আমেরিকায় জন্ম হওয়ার কারণে যে স্বপ্ন দেখতে পারছে, বাংলাদেশে জন্ম হলে তা কখনো দেখতে পারত না, মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে তিরিশ লাখ শহীদ কি তাদের রক্ত দিয়েছে আমাদের শিশুদের থেকে স্বপ্ন কেড়ে দুটো পরিবারের কাছে বন্দী করার জন্য? আমাদের শিশুদের স্বপ্ন পরাধীন করবার জন্য? আর যদি তাই হয় তবে এ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙবে কে?
*ড. নুরুন নাহার বেগম, সহযোগী অধ্যাপক, East Stroudsburg University of Pennsylvania, USA.