যে প্রেম হিরণ্ময়

অনেক ভালো করে লক্ষ্য করেও নীরা বাসার নম্বরটা পড়তে পারছে না। আলো তেমন নেই। নভেম্বর মাস। সন্ধ্যা ৬টা না হতেই আলো নিভে গেছে দিনের। তারপর মনে হয় স্নো পড়বে রাতে, তাই আকাশটাও কেমন থমথমে। কনকনে ঠান্ডা বাইরে। এই প্রথম কলোরাডো আসা নীরা আর মারুফের। আসলে শুধু নীরার। প্রায় ১০ বছর আগে মারুফ কলোরাডো আসে—ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারে মাস্টার্স করতে। আর তারপর এই আবার। যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্টেটকে বলে রকি মাউন্টেন স্টেট। প্রায় তিন হাজার মাইল বিস্তৃত এই পর্বতমালা আমেরিকা ও কানাডা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছিল নীরা। হঠাৎ মারুফের কোথায় চমক ভাঙে।
ভালো করে দেখ ৫৭৯ কিনা, মারুফ বলে উঠে।
আরে না ওইটা ৫৭৭, নীরার উত্তর। মনে হয় পাশের একতলা বাসাটা হবে। কারণ বাম পাশেরগুলি সব বেজোড় নম্বর। যদিও কোনো আলো জ্বলছে না বাসার সামনে, কিন্তু মনে হচ্ছে এটাই।
মারুফ গাড়িটা ঘুরিয়ে নেয়। একটু চিন্তায় পড়ে যায় মারুফ। কালকে রাতেও তো মণি ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো। তাহলে কী তাঁরা বাসায় নেই, না কি ভাবির কোনো সমস্যা।
প্রায় ১০ বছর পর নীরার পীড়াপিড়িতে কলোরাডোতে আসা। আর কাজের চাপে এত দুরে আসার সময় হয় না সব সময়। অথচ এই শহর জুড়ে কত স্মৃতি। প্রায় ১২ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে ছাত্র হিসেবে এসে পুরাই দিশেহারা মারুফ। পাহাড়ি রাস্তা, গাড়ি ছাড়া উপায় নাই চলাচলের। নিজের গাড়ি নাই, গাড়ি চালাতেও জানে না মারুফ। তারপর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা, নভেম্বরের শুরু থেকে প্রচণ্ড ঠান্ডা। শহরে তেমন বাঙালিও নেই। সেই সময় মণি ভাই আর ভাবি না থাকলে হয়তো বাঁচা দায় হয়ে যেত একদম।
বললাম না এটাই, নীরার কথায় মেমোরি লেন থেকে ফিরে আসে মারুফ। গাড়ি থেকে নেমে কাছে গিয়ে দেখতে পায় নম্বরটি ঠিক আছে।
একবার বেল টিপতেই দরজা খুলে দেন মণি ভাই, মনে হয় তাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
মণি ভাই কেমন আছেন, কত দি-ই-ন পর! মারুফ চিত্কার করে ওঠে।
এত দেরি কেন আপনাদের? মারুফ মনে মনে ভাবে সবাইকে আপনি করে বলার অভ্যাসটা এখনো আছে মণি ভাইয়ের।
আর বলবেন না, আপনার বাসা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এই পাড়াতেই চক্কর খাচ্ছি। আপনার বাসার বাইরের লাইটটা জ্বালানো নাই। তাই বাসার নম্বরটা পড়তে পারছিলাম না।
ওহ সরি, মেয়েটার কালকে থেকে জ্বর। এতক্ষণ পট্টি দিচ্ছিলাম। খেয়াল নেই। একটু লজ্জা পেয়ে মণি ভাই উত্তর দেন।
এই আমার বউ নীরা, মারুফ পরিচয় করিয়ে দেয় মণি ভাইকে।
আসেন আসেন ভেতরে, এই ঠান্ডায় জমে যাবেন। মণি ভাই নীরা আর মারুফকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসেন।
ড্রয়িং রুমটা ছোট কিন্তু ছিমছাম সাজানো। একপাশে একটা বড় স্পেশাল চেয়ারে একজন খুব ফরসা হাসিখুশি ভদ্রমহিলা কালো রঙের একটা শাল গায়ে বসে আছেন। দেখলে বোঝা যায় একসময় খুব সুন্দরী ছিলেন। না বললেও নীরা বুঝতে পারে এটা জুলি ভাবি। কত গল্প যে শুনেছে মারুফের কাছে। দেয়াল জুড়ে মণি ভাই আর জুলি ভাবির সোনালি দিনগুলির ছবি, সব ফ্রেমে বাঁধানো।
নীরা লক্ষ্য করে মারুফের চোখ ছলছল করছে। কেমন আছেন ভাবি, কান্না ভেজা গলায় মারুফ বলে ওঠে।
এখন তো অনেক ভালো। নিজে নিজেই হুইল চেয়ার চালিয়ে বাসায় চলাচল করতে পারে, বেশ আশাবাদী গলায় উত্তর দেন মণি ভাই।
আপনারা বসেন। মণি ভাই চেয়ার এগিয়ে দেন নীরা আর মারুফকে।
নীরা হঠাৎ লক্ষ্য করে জুলি ভাবি আঁ আঁ করে শব্দ করছেন। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছেন। মণি ভাই বললেন, কি বলছ জুলি? জুলি ভাবি শুধু আঁ আঁ করে শব্দ করলেন আবার। মণি ভাই নীরাকে বলল, আপনাকে ওর পাশের সোফাতে বসতে বলছে। নীরা উঠে গিয়ে পাশে বসল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, বাচ্চারা যখন প্রথম কথা শিখে তখন যেমন একটা ধ্বনি দিয়ে সব কথা বলতে চায় তেমন ভাবেই কথা বলছেন জুলি ভাবি।
অবিরত আঁ আঁ শব্দ করে কিছু বলতে চাচ্ছেন। নীরা বা মারুফ কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু মণি ভাই মনে হয় শুনে শুনে অভ্যস্ত। তাই ভাবি যা বলছেন সবই তিনি ওদেরকে অনুবাদ করে দিচ্ছেন। মণি ভাই নীরাকে বললেন, আপনাকে বলছে আপনার পায়ের চপ্পল জোড়া খুব সুন্দর। চমকে পায়ের দিকে তাকাল নীরা। বাংলাদেশ থেকে গতবার আনা একটা রুপালি চপ্পল। বুঝতে পারল জড়োভারত হয়ে যাওয়া এই মেয়েটি একদিন খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। হয়তো আর দশটা বাঙালি মেয়ের মতোই চুরি, ম্যাচিং শাড়ি আর চপ্পল পরতেন। জুলি ভাবি আবার শব্দ করে মণি ভাইকে কিছু বললেন। নিজের পায়ের দিকে কিছু দেখালেন। মনে হয় জুতা পরতে চাচ্ছেন। কিন্তু আসলে সেটা না। মণি ভাই একটা রুপার নূপুর এনে খুব সযতনে জুলি ভাবির পায়ে পরিয়ে দিলেন। পক্ষাঘাতগ্রস্থতার জন্য জুলি ভাবির পা অনেক ফুলে গেছে। তাই সেখানে সাধারণ কোনো জুতা বা চপ্পল পরানো সম্ভব না। কিন্তু নূপুর পরেই খুব খুশি ভাবি। আনন্দে আঁ আঁ শব্দ করতে লাগলেন।
নীরা মারুফের কাছে শুনেছে, মণি ভাই আর জুলি ভাবির গভীর প্রেমের গল্প। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা যান মণি ভাইয়ের। তাই চাচার বাসায় মানুষ হওয়া ও পড়াশোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে টিউশনি করতেন আর জুলি ভাবি ছিলেন ছাত্রী। কিন্তু জুলি ভাবি স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র মেয়ে। তাই তার বাবা-মা কিছুতেই রাজি ছিলেন না চালচুলোহীন এতিম মণি ভাইয়ের সঙ্গে জুলি ভাবির বিয়ে দিতে। কিন্তু পাত্রপাত্রী নাছরবান্দা। তাই বাড়ির অমতে নিজেরাই বিয়ে করে ফেলেন। এর কিছুদিন পর ডিভি ইমিগ্রান্ট ভিসায় নিউইয়র্ক চলে আসেন এই দম্পতি। দুজনেই অড জব শুরু করেন—দোকানের কাজ, গ্যাস স্টেশন যেখানে যেটা পান।

কয়েক মাস পর জুলি ভাবি বুঝতে পারেন এ ভাবে চলবে না। এটা কোনো ভালো জীবন হতে পারে না। তাই মণি ভাইকে তাড়া দিতে থাকেন পড়াশোনা শুরু করতে। অন্তত বিদেশি একটা ডিগ্রি থাকলে একটা ভালো কাজ, একটা ভালো জীবন তো হবে। বিদেশে ফান্ড না পেলে পড়াশোনা খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু জুলি ভাবি তা মানবেন না। বললেন, আমি কাজ করব, তুমি পড়বে। মণি ভাইয়ের admission হলো কলোরাডো ডেনভার ইউনিভার্সিটিতে। চলে এলেন এই পাহাড়ি জায়গায়। কিন্তু টাকা–পয়সা নেই। সব খরচ ভাবি পুরোদমে কাজ করে আর মণি ভাই মাঝে মাঝে কাজ করে জোগাড় করলেন। সারা দিন রাত পরিশ্রম করেন জুলি ভাবি। স্বামীর পড়াশোনা শেষ করতেই হবে। নিউইয়র্কের অড জব করা জীবনের চেয়ে একটা ভালো সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেন তিনি। শেষ সেমিস্টারে অবশেষে একটা funding জোগাড় হলো, কিছু টাকা পয়সা পেলেন।
কয়েক বছর পর মণি ভাই পড়াশোনা শেষ হলো, একটা ভালো চাকরিও পেয়ে গেলেন কিছুদিনের মধ্যে। এ যেন জুলি ভাবির স্বপ্নের শুরু। অফিসের কাছাকাছি একটা ছোটখাটো বাড়িও কিনে ফেললেন। কারণ পরিবারে নতুন অতিথি আসছে। জুলি ভাবির বাবা মাও মেনে নিলেন তাদের। নাতি–নাতনির ওপর কী আর রাগ করে থাকা যায়। সব মিলিয়ে অনেক কষ্টের পর জুলি ভাবি আর মণি ভাইয়ের জীবনে সবচেয়ে সুখের দিন। কিন্তু নিয়তি তখন হাসছে, যেন নতুন প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের নিয়ে খেলার জন্য। তাই এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বাচ্চা হওয়ার সময় হাসপাতালের কিছু একটা ভুলে জুলি ভাবির neurological শক হলো এবং তা থেকে কমায় চলে গেলেন তিনি। সদ্যোজাত ফুটফুটে মেয়েটাকে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখলেন মণি ভাই। এত চড়াই-উতরাইয়ের পর কোথায় এখন দুজনে মিলে আনন্দ করবেন তাদের ভালোবাসার ধনকে নিয়ে, কিন্তু হায় নিয়তি ততটাই নির্মম। প্রায় দশ দিন ধরে কৃত্রিম অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে ভাবিকে। হাসপাতালে বোর্ড বসল। আমেরিকায় সব চিকিৎসা পুরোপুরি নির্ভর করে ইনস্যুরেন্সের ওপর। মৃতপ্রায় রোগীকে অক্সিজেন নল দিয়ে হাসপাতালে যত রাখা হবে ততই ইনস্যুরেন্সের খরচ। তাই তারা ডাক্তারকে চাপ দেন রোগী রিলিজ করতে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়। মণি ভাই বুঝতে পারেন আকারে ইঙ্গিতে হাসপাতালের নার্স আর ডাক্তাররা চাচ্ছেন লাইফ সাপোর্ট খুলে নিতে। তাদের মতে জুলি ভাবির অবস্থা আর উন্নতি হবে না। শুধু শুধু কেন কষ্ট দেওয়া।
মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ডাক্তার ডেভিড ডেকে পাঠালেন মণি ভাইকে। জিজ্ঞাসা করলেন, হাউ ওল্ড আর ইউ?
এই প্রশ্নে বেশ হকচকিয়ে গেলেন মণি ভাই। থতমত খেয়ে উত্তর দিলেন থার্টি টু।
ডাক্তার ডেভিড বললেন, ইউ আর সো ইয়ং। ইউ নো, ইভেন ইফ ইউ টেক ইউর ওয়াইফ ব্যাক হোম, শি উইল বি লাইক ভেজিটেবল। শি উইল নেভার ওয়াক, টক অর ক্যান ডু এনি থিং। শি উইল বি ইন হুইল চেয়ার রেস্ট অব হার লাইফ। ইউ হ্যাভ টু নট অনলি টেক কেয়ার অব ইউর daughter বাট অলসো ইউর ওয়াইফ। লেট হার ডাই ইন পিস, লেট আস টেক দ্য অক্সিজেন আউট। ইউ আর সো ইয়ং, ইউ হ্যাভ এ লাইফ ম্যান।
এটুকু শুনে মণি ভাইয়ের বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কত অবলীলায় ডাক্তার তার প্রিয়তমাকে ‘vegetable’, অথর্ব বলে দিল। আর কোনো দিন জুলি হাঁটতে, চলতে, কথা বলতে পারবে না। হুইল চেয়ারে তার বাকি জীবনটা কাটাতে হবে। তাই তার মরে যাওয়াটাই সমীচীন। ডাক্তারের মতে স্বার্থপরের মতো জুলিকে মরতে দিয়ে নিজের আর তার মেয়েটার জীবন নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই মণি ভাইয়ের উচিত। কষ্টে বুকটা ভেঙে যাচ্ছিল মণি ভাইয়ের। কীভাবে তিনি পারবেন জুলিকে ফেলে নিজের জীবন নিয়ে চলে যেতে। সেই জুলি, যে কিনা ভালোবাসার জন্য ঘর ছাড়ল, ধনীর একমাত্র মেয়ে হয়েও তার মতো গরিবের সঙ্গে কষ্ট করল এত দিন। আর আজকে যে এই ভালো ডিগ্রি, চাকরি সবকিছুই জুলির আত্মত্যাগের ফসল। তীব্র ক্ষোভ আর রাগে চিত্কার করে উঠলেন মণি ভাই, গালাগালি বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
কিছুটা অলৌকিক ভাবেই দিন দশেক পর ভাবির অবস্থা একটু ভালো হলো। মণি ভাই ডাক্তার ও ইনস্যুরেন্সের সঙ্গে অনেক ঝামেলা করে হাসপাতালে রাখলেন কিছুদিন। তারপরের ঘটনা আরও কঠিন। বন্ড সাইন করে অসুস্থ স্ত্রী আর দুই সপ্তাহের বাচ্চাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসলেন। neurological শকের জন্য জুলি ভাবি তার আদরের মেয়েটাকেও চিনতে পারেন না, কথা বলা তো দূরের কথা। খাওয়া, গোসল, বাথরুম কোনো কিছুই আর নিজে করতে পারেন না। মণি ভাই মূলত দুটি নবজাতক শিশুর দায়িত্ব পালন করেন। তার সঙ্গে চাকরি তো আছেই। একজন নার্স রাখেন, দেশ থেকে জুলি ভাবির বাবা–মাকে নিয়ে আসেন। কিছুটা ধাতস্থ হন এই কঠিন জীবনে। আর সারা দিন শুধু অনলাইনে সার্চ করেন ভালো nerosurgon–এর। কখনো আশা হারান না মণি ভাই। মনে হয় হঠাৎ একদিন জুলি আবার ফিরে আসবে আর তার সঙ্গে রাগত গলায় বলবেন, কী বিচ্ছিরি লাল জামার সঙ্গে সবুজ মোজা পরিয়েছ আমার মেয়েটাকে। খুবই শৌখিন ছিল জুলি। মেয়ে হবে জানতে পেরে কত কিছু কল্পনা করত জুলি। মেয়েকে কখন কী ড্রেস পরবে, কীভাবে চুল বাধবে বড় হলে। কিন্তু সেসব আজ শুধু কল্পনা মাত্র। সাদা গাউন আর হুইল চেয়ারে তাকে দেখতে খুব কষ্ট হয় মণি ভাইয়ের। তিন বছর না যেতেই একে একে জুলি ভাবির বাবা–মা দুজনেই মারা যান। আবার ছন্দপতন। সাড়ে তিন বছরের জয়িতা আর জুলিকে নিয়ে হিমশিম খান মণি ভাই। ইতিমধ্যে একজন বিখ্যাত nerosurgon সার্জারি করেছেন। এতে জুলি ভাবির অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। একেবারে অচল ডান হাতটা একটু নাড়াতে পারেন। মাঝে মাঝে নিজের মেয়েটাকে চিনতে পারেন। আর আঁ আঁ শব্দ করেন মাঝে মাঝে। মণি ভাইয়ের জন্য সেটাই বা কম কীসের। আস্তে আস্তে মণি ভাই এই জীবনসংগ্রামে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। সকালে অফিসে যান আর বিকেলে এসে একাই দুটি শিশুর যত্ন করেন। গোসল, খাওয়া রান্না, কোনোটাই জুলি ভাবি করতে পারেন না। মেয়েটা একসময় স্কুলে যাওয়া শুরু করে, একটু স্বস্তি আসে জীবনে। একটা নার্স রাখলেন অফিসের সময় জুলি ভাবিকে সাহায্য করার জন্য। এভাবেই পার করে দিলেন আটটা বছর। এখনো চোখ বুজলে দেখতে পান তাদের সেই হাসি আনন্দের দিনগুলি, যখন জুলি সুস্থ ছিল। উচ্ছল প্রাণচঞ্চল এক তরুণী, যে কিনা ম্যাচিং করে শাড়ি আর টিপ পরত, গান গাইত খোলা গলায়। দীর্ঘ দিন পক্ষাঘাতে ভুগে এখন শরীরে পানি এসে গেছে। সব সময় ম্যাক্সি পরে থাকেন। শাড়ি চুড়িগুলি থরে থরে সাজানো আলমারিতে। পরার লোক নাই। কিন্তু এখনো ওই হাত ধরলে মণি ভাইয়ের মনে হয় এই তো সেই মেয়েটি, হয়তো কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি, সব আগের মতো হয়ে যাবে একদিন।

এত দিন পরও মারুফকে দেখে চিনতে পেরেছেন জুলি ভাবি। মণি ভাই বললেন, দেখেছেন, বললাম না জুলি ভালো হচ্ছে আস্তে আস্তে, আপনাকে চিনতে পেরেছে। আগে তো আমাকেও চিনতে পারত না। মণি ভাইয়ের কণ্ঠে যেন বিজয়ের উচ্ছ্বাস। চলেন আমার সঙ্গে একটু ডাল ভাত খান। আমার মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে, জ্বর আছে এখনো, খাবে না কিছু। মণি ভাই ডেকে নিয়ে যান নীরা আর মারুফকে খাবার টেবিলে। খাবারের আয়োজন দেখে অবাক দুজনেই। আশা করেনি মণি ভাই এত কিছুর পর তিন চার রকম রান্না করে খাওয়াবেন।
খাওয়া আর আড্ডার পর বিদায়ের পালা। মারুফ আর নীরাকে জুলি ভাবি অনেক কিছু বলতে চাচ্ছে, মনে হয় বলতে চাচ্ছে আবার আসবেন। মণি ভাই বললেন, জুলি বুঝতে পেরেছে আপনারা যাচ্ছেন। বিদায় নিয়ে কোনোরকমে দৌড়ে গাড়িতে উঠল মারুফ আর নীরা। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে তীব্রভাবে। রাত অনেক হয়েছে। তাই চারপাশ সুনসান নীরব ও অন্ধকার। মণি ভাই আর জুলি ভাবি ঘরের ভেতরের জানালার ওপাশ থেকে তাকিয়ে আছেন। নীরার মনে হলো সে যেন সেই বিখ্যাত প্রেম কাহিনি ও হেনরির দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজির (The Gift of the Magi) সেই জিম আর ডেলার এ যুগের সংস্করণকে দেখে এল অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। জিম ও ডেলা দুজনেই একে অন্যের অজান্তে দুজনের জন্য তাদের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস বিক্রি করে ক্রিসমাসের উপহার কিনে আনে। কিন্তু মণি ভাই আর জুলি ভাবির আত্মত্যাগ যেন সেটাকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রেমের প্রতিযোগিতায় তো সবাই জয়ী হয় কমবেশি, কিন্তু প্রেমের পরীক্ষায় কজন? বিশেষত যে পরীক্ষার শেষ কবে কেউ জানে না।
সাদা তুলোর মতো স্নো পরছে। ধবল শুভ্র তুষারে ঢেকে যাচ্ছে মণি ভাই আর জুলি ভাবির ছোট্ট বাসাটি। কিন্তু সব আঁধারের মাঝেও তাদের এই প্রেম আপন মহিমায় আলোকিত, এই প্রেম হিরণ্ময়।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। গোপনীয়তা রক্ষার্থে স্থান, কাল ও পাত্রপাত্রীদের নাম বদলে দেওয়া হয়েছে)