যেখানে ইতিহাসের কাছে বন্দী প্রযুক্তি

বিজ্ঞানপ্রেমী তরুণ প্রযুক্তিবিদদের বলতে শুনি, তাঁদের ইতিহাসে কোনো আগ্রহ নেই। কারণ ইতিহাসের মধ্যে তাঁরা বৈজ্ঞানিক কিংবা প্রযুক্তির কোনো কিছু শিখতে পারেন না। যা হয়ে গেছে বহু বছর আগে, তা থেকে শেখার কী আছে? এখন সভ্যতা কত এগিয়ে গেছে, কেন তাহলে আমরা পুরোনো ইতিহাস ঘাটব? বিশেষ করে যেখানে মানুষ এখন ন্যানোটেকনোলজি, চালকবিহীন গাড়ি, মহাকাশে পর্যটনের মতো উচ্চাভিলাষী চিন্তা-ভাবনা করে চলেছে, তখন ২০০-৩০০ বছর আগে প্রযুক্তি কেমন ছিল, তা থেকে কী শেখার থাকতে পারে?

উত্তরটা এভাবে দিই, সরাসরি তথ্যগত কিছু শেখা যাবে না, কিন্তু তাত্ত্বিক অনেক কিছুর কারণ বোঝা যাবে। একজন প্রকৌশলী হিসেবে আমি সেটা দিয়েই উদাহরণ দিই, প্রকৌশলবিদ্যার যেকোনো প্রজেক্টের গোড়ায় রয়েছে কিছু স্বতঃসিদ্ধ, প্রমাণ ছাড়া সত্য বলে কিছু ধরে নেওয়া জ্ঞান ও তথ্য। কিন্তু যেহেতু এটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া, তাই নেই ধরে নেওয়া নীতিগুলোকে গাণিতিকভাবে কিংবা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করার দায় রয়ে যায় এবং সেটা করাও হয়। এখানেই কলা ও বিজ্ঞানের পার্থক্যটা প্রকটভাবে চোখে পড়ে।
প্রজেক্টের শুরুতে বেশ কিছু জিনিস আমাদের অনুমান করে নিতে হয়, যেটা পূর্ব ধারণা কিংবা অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া। একজন ভালো প্রকৌশলী অবশ্যই সেটা লিখে রাখেন কিংবা মনে রাখেন। কিন্তু মুশকিল হলো, একটা বড় প্রকল্পে বহু লোক কাজ করে এবং সবাই খুব ছোট ছোট অংশ করে থাকে, যেটা আস্তে আস্তে জোড়া দিয়ে বিশাল কাজ শেষ করা হয়। এখন গোড়ার অনুমানগুলো কিন্তু সবার কাছে পরিষ্কার থাকে না। অনেক সময় দায়িত্ব পরিবর্তন হয়, নতুন প্রকৌশলী এসে আগের প্রকৌশলীর করা কাজটা শেষ করার চেষ্টা করেন, তখন অনুমানগুলো তাঁর কাছেও পরিষ্কার ধারণা থাকে না। যেহেতু প্রকল্প তত দিনে অনেক দূর গড়িয়েছে, তাই তিনি ধরে নেন যে আগেরজনের শুরুর অনুমানগুলো সঠিক, যদি না নিশ্চিতকরণ পরীক্ষায় বড় কোনো গরমিল পাওয়া যায়।
এভাবে কিন্তু ব্যবধান বাড়তে থাকে শুরুর অনুমান থেকে বাস্তবতার। হয়তো কোনো অনুমান যখন করা হয়েছিল তখনকার জন্য সত্য ছিল, কিন্তু পরে নতুন আবিষ্কার কিংবা প্রাকৃতিক ঘটনার জন্য সেই অনুমান আর ঠিক নেই। যেহেতু অনুমানের ভিত্তি জানা নেই, তাই সেটাকে পরিবর্তন করার মতো তাড়নাও নেই। মাঝে মাঝে খুব নির্দোষ অনুমান মানবসভ্যতার দিক বদলে দেয়। চলুন একটু ইতিহাস ঘুরে আসি—
আমেরিকার রেললাইনের মাঝের দূরত্ব ৪ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি (এটাকে স্ট্যান্ডার্ড গেজ বলে যা যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম ইউরোপ এবং কানাডা ও আমেরিকায় প্রচলিত। ব্রডগেজ প্রচলিত রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে, এ ছাড়া বিভিন্ন দেশে অন্যান্য মাপে রেল রোড রয়েছে )।
খুবই অদ্ভুত একটা মাপ, কিন্তু কেন? কারণ ইংরেজ প্রকৌশলীরা সেভাবেই এগুলো প্রথমে তৈরি করেছিলেন। ইংরেজরাই প্রথম রেল প্রযুক্তি তৈরি করে এবং সেটা সারা বিশ্বে তাদের উপনিবেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়।
কিন্তু ইংরেজরা ওভাবে কেন রেললাইন তৈরি করল? কারণ যেসব প্রকৌশলী ওয়াগন ট্রাম তৈরি করতেন, তাঁরাই প্রথম রেলগাড়ি করেছিলেন। ওয়াগন ট্রামের সেই মাপ কেন হলো? কারণ তখনকার জনপ্রিয় বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ির ট্যাক্সি সার্ভিসও ছিল ইউরোপে তখন। বহুল প্রচলিত ঘোড়ার গাড়ির চাকার মাপে ট্রাম তৈরি হয়, কারণ তাতে একই উৎপাদন সরঞ্জাম ব্যবহার করার সুবিধা ছিল।
প্রশ্ন, এখন ঘোড়ার গাড়ির চাকার সেই মাপ কেন হলো? লক্ষ করুন, তখন রাস্তাঘাট এখনকার মতো পাকা ছিল না। মানুষ কোনো একটা পথে চলতে চলতে যে দাগ তৈরি হয়ে যেত, সেখান দিয়েই গাড়ি চালানোর চেষ্টা করত। তাতে কোনো গর্তে পড়ে চাকা ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকত না। ইউরোপের বেশির ভাগ পুরোনো রাস্তাগুলো তৈরি করে প্রাচীন রোমানরা। তারা ও তাদের যোদ্ধাবাহিনী সেসব পথে চ্যারিয়ট চালিয়ে যেত। চ্যারিয়ট হলো একটা যুদ্ধবাহন, যেটা রোমানরা অনেক বেশি ব্যবহার করত। দুটি ঘোড়ার পেছনে বেঁধে দুই চাকার ওপরে একটি পাটাতনে খোলা অস্ত্র নিয়ে সমরাঙ্গনে যুদ্ধ করত যোদ্ধারা। এগুলোই হলো চ্যারিয়ট। চ্যারিয়টের দুই চাকার মাঝের দূরত্বটা কীভাবে নির্ধারণ করত তারা?
চাকা দুটি এমন দূরে থাকতে হবে, যাতে নিরাপদে দুটি ঘোড়া একই গতিতে দৌড়াতে পারে, আবার পাটাতনের ভারও বহন করতে পারে। চাকার দূরত্ব কম হলে মোড় ঘোরার সময় উল্টে যেতে পারে গাড়ি, আবার বেশি হলে চাকার মাঝের এক্সেল ভেঙে যেতে পারে। তো তখনকার রোমান ঘোড়ার গতি, পশ্চাদ্দেশের দূরত্ব, রাস্তার অবস্থা, কাঠের দৃঢ়তা—এসব কিছু বিবেচনা করে যেই দূরত্ব তারা নির্ধারণ করেছিল, সেই দূরত্বই রাস্তায় হাজার বছর ধরে দাগ তৈরি করে। সেখান থেকেই ঘোড়ার গাড়ির চাকার দূরত্বের ডিজাইন প্রভাবিত হয়েছিল, তা থেকে ওয়াগন ট্রাম আর সেখান থেকে স্ট্যান্ডার্ড গেজ রেলগাড়ি। হয়তো এখন মনে হচ্ছে, তো কী হয়েছে, ৪ ফুট সাড়ে ৮ ইঞ্চি না হয়ে আরেকটু ছোট হলে কী হতো? বড় হলেই বা লাভ কী?
এবার দেখা যাক, আধুনিক বিজ্ঞানে এর প্রভাব কতটা হতে পারে। উৎক্ষেপণের সময় নাসার স্পেস শাটলের পেছনে যে দুটি লম্বা রকেট বুস্টার দেখা যায়, সেগুলোকে বলে সলিড রকেট বুস্টার (এসআরবি), এগুলো বারবার ব্যবহার করা যায় এবং এর ভেতরে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী মোটর, যেটা ১৪ মেগা নিউটন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত বল উৎপাদন করতে পারে। আধুনিক রকেট বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবে এসআরবিকে বিবেচনা করা হয়। আমেরিকার ইউটাহ অঙ্গরাজ্যের থিওকল নামক এক কোম্পানি প্রথম এই এসআরবি তৈরি করে। থিওকলের প্রকৌশলীরা প্রথমে এসআরবির মাপ আরেকটু মোটা করে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাতে বেশি জ্বালানি পরিবহন করে রকেটের দক্ষতাও বাড়ানো যেত। কিন্তু ইউটাহ থেকে ফ্লোরিডা লঞ্চ সাইট (যেখান থেকে রকেট ছাড়া হবে) পর্যন্ত এসআরবিগুলোকে তখন পরিবহন করার একমাত্র উপায় ছিল মালবাহী রেলগাড়ি। রকি মাউন্টেন পার হওয়ার সময় সেই রেললাইন আবার অনেক টানেলের মধ্য দিয়ে গেছে। টানেলের প্রস্থ রেললাইনের চেয়ে একটু বেশি। কিন্তু রকি মাউন্টেনগুলোকে রেলে পরিবহন করতে গেলে টানেলের চেয়ে বেশি প্রস্থের করা যাবে না। তাই তাঁরা বাধ্য হয়ে নকশা পরিবর্তন করে বর্তমান মাপে নিয়ে আসেন। এবার ভেবে দেখুন তো আধুনিক রকেটের নকশার পরিবর্তনের পেছনে কাদের হাত ছিল? প্রাচীন রোমানদের!
একদিন হয়তো মানবজাতি মঙ্গল গ্রহে পা রাখবে, কিন্তু তাদের এই যাত্রার পেছনে হাজারো বাধার মধ্যে খুব সামান্য হলেও একটি কারণ থাকবে হাজার হাজার বছর আগে কোনো রোমান কারিগরের কিছু অনুমান। সুতরাং এখন থেকে যদি কেউ আপনাকে অভিজ্ঞতা, পূর্বানুমানের ভিত্তিতে কোনো নিয়ম বা তথ্য মানতে বলে, প্রশ্ন করুন, জানার চেষ্টা করুন পেছনের কারণটা কী? ইতিহাসটা কী? কারণ প্রযুক্তি অনেক সময় ইতিহাসের কাছে বন্দী হয়ে থাকে!