যুগলবন্দী

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমার কথা কাউকে আক্রমণ করে নয়, নিজের কিছু অভিব্যক্তি মাত্র। আমরা মেয়েরা বড় হয়ে ওঠার সময় নানা রকম অদ্ভুত আর বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হই। অনেক সময় সমাজের অনেক নারী মেয়েদের চলার পথে বিভিন্ন উপায়ে বিড়ম্বনা করে থাকেন। দৃষ্টির মধ্যে কেউ পড়লেই হলো, মেয়েটির বয়স, লেখাপড়া বা পারিবারিক অবস্থান—কোনো কিছু বিবেচনা না করেই তাকে ‘লক্ষ্যবস্তু’ হিসেবে স্থির করে, তার পিছু নেওয়া শুরু করে। আর কখনো সেই ‘লক্ষ্যবস্তু’র জন্য একা নয়, নারী-নারী যুগল হয়ে অভিযানে নেমে যায়। নারীর তাড়া খাওয়ার অনেক অভিজ্ঞতা আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে আছে। তাদের অভিসারের নানা রকম জটিলতার স্বরূপও আমার জানা আছে। সময়ের পরিমণ্ডলে কতক ঘটনার আলোকে যুগলবন্দী নারীর কিছু চিত্র তুলে ধরলাম।

একদিনের ঘটনা, আমি কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ি। ক্লাস শেষে ঘণ্টা বাজায় আমি খাতাপত্র ব্যাগে ভরছি। আমার দুবেণি করা মুখটা তুলে সবে সোজা করে সামনে তাকাতেই দেখি আচমকা দুজন নারী কোথা হতে ক্লাসের মাঝখানে আবির্ভূত। হাসি মাখানো মুখে আমাকেই লক্ষ্য করছে। রমণীদ্বয়ের হাস্যোজ্বল ভরা মুখাবয়ব আমাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করল। দুজনের মধ্যে যিনি বড়, এগিয়ে এসে বললেন, ‘একটু কলেজ গেটের বাইরে আসবে? তোমার সঙ্গে একটু কথা বলব আর একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’ অচেনা একজন নারীর এমন প্রস্তাব! বিহ্বলিত না হয়ে যাই কোথায়? ভাবলাম, আহা! কি মজা! মন যা চায় তা–ই যেন পায়। ‘আসলে আমার ছোট ভাই, পড়ালেখা করতে বিদেশ চলে যাচ্ছে, ও তোমাকে ওর সব নোটস দিয়ে যাবে, যাতে তুমি ভালো রেজাল্ট করতে পার। এরপর তুমিও চলে যাবে বিদেশে। এখন পরিচয়টা হয়ে নাও, ...ইত্যাদি, ইত্যাদি।’ আমার চোখের সামনে আমারই এমন সুনিপুণ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা! উপেক্ষা করার বিষয় নয়! আমার ওই বয়সের কৌতূহলী মন পাখির মতো উড়ে কলেজ গেটের বাইরে যাবে, না ক্লাস রুমে বসে পাখা ঝাপটাতে থাকবে? কিন্তু আমি যে শিশু পাখি! আমার না আছে সাহস, না পারি ডানা মেলে উড়তে! তাই বসেই ডানা ঝাপ্টালাম আর নরম স্বরে শুধু বললাম, ‘এই অভিপ্রায়ে কলেজের প্রান্তরে দয়া করে উদিত হবেন না।’ এত সহজে কি আর হার মানে? আবারও আসতে লাগল, একই গান গাইতে লাগল। নারীর ধৈর্য বলে কথা! আমিও ধৈর্যশীলা কম নই। হাল ছাড়লাম না, দেখি এর শেষ কোথায়? অনেক সাধনার পর, সেই নারীগণ অনুধাবন করল যে ঘটনা অতিরঞ্জিত হয়ে গেলে তাদেরই বিপদ বাড়বে, বরং কোনো অংশে কমবে না। আর যে পাখি উড়তেই চায় না, তাকে আর ওড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে কী লাভ? তারা কলেজে আশা বন্ধ করল আর আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম সে যাত্রা বাঁচতে পেরে।

কিছুদিন পরের ঘটনা। আমার বাবা সরকারি অফিসার ছিলেন; আর সে সুবাদে আমরা সব সময়ই সরকারি বাসায় থেকেছি। একদিন প্রাইভেট স্যারের কাছে পড়া শেষ করে বাসায় ফিরছি। আজিমপুরের কলোনিতে চারতলায় আমাদের বাসা। সিঁড়ি দিয়ে দোতলা পর্যন্ত উঠতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সম্মুখে দুজন দণ্ডায়মান। তাঁদের একজন আবার আমাদেরই কোয়ার্টারের আন্টি, আরেকজন আমার অপরিচিত। আমি শঙ্কিত! আবারও দুজন? না জানি আবারও কোনো নতুন গল্প, নতুন প্যাঁচ? পরের দিন আম্মা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি কীভাবে দাঁড়িয়েছিলে কথা বলার সময়?’ ‘আন্টিদের সন্দেহ তোমার নাকি একটি পা খাটো?’ আমি এ কথা শুনে মহা খুশি! আসলে আমার এক পা না, আমার দুই পা, হাত, চোখ, কান সবই খাটো...তাই আমি কম চলি, কম বুঝি, কম দেখি, কম শুনি...আর এসব কম নিয়েই আমার অস্তিত্ব। মনে মনে বললাম, ‘হে অ্যান্টিরা, আমার চলার পথের গতি রোধ না করে আমাকে আমার কম-টুকু নিয়েই থাকতে দিন।’

এরপর শুরু হলো বাসায় উৎপাত। আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির অনার্স প্রথম বর্ষে মাইক্রোবায়োলজিতে ক্লাস করছি। একদিন প্রায় রাত দশটার দিকে বাসায় দুজন মহিলার আগমন; তাঁদের একজন আবার আমার মায়ের পরিচিত। হঠাৎ করে এত রাতে তাদের বাসায় আসার কারণ আম্মা বুঝতে পারল না। পরের দিন উন্মোচিত হলো এই ঘটনার আসল রহস্য। আম্মাকে বলতে শুনলাম, ‘আমার মেয়ে তো মাত্র লেখাপড়া শুরু করেছে, আমরা এখনো কিছু ভাবছি না, আগে লেখাপড়া শেষ করুক।’ এরপর আমাকে আর চিন্তা করতে হয়নি, আমার মা-বাবা, ভাইবোন এসব পরিস্থিতি খুব ভালোভাবেই সামাল দিয়েছে।

আমার অনার্স শেষ হলো, নানা রকম অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। মাঝেমধ্যে মনে হতো মুক্ত আকাশ পেলে একটু একটু করে উড়ে বেড়াই। ওড়ার আর সময় কখন? মাস্টার্স ফাইনাল শেষ হওয়ামাত্র আরও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম থিসিসের কাজ নিয়ে। সকালে চলে যাই শ্যামলী যক্ষ্মা কেন্দ্রে, সেখান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, বারডেম হয়ে নিজের ডিপার্টমেন্টে—কাজ শেষে বাসায় এসে লম্বা ঘুম। এই ছিল আমার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ। একদিন শুনলাম দুজন নারী বাসায় এসেছিলেন আমাকে খুঁজতে। তাঁদের একজনের ছেলে পড়াশোনা শেষ করে মিসিগানের ডেট্রয়েটে অবস্থান করছে। সেই ডেট্রয়েটবাসীর মা নাকি বলেছেন, ‘আমার ছেলে কোনো দিন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি, আমার ছেলেই আপনার মেয়ের জন্য একমাত্র সুযোগ্য পাত্র।’ ‘কোনো মেয়ের দিকেই ছেলে তাকায়নি’—ব্যাপারটা বড় কোনো বিষয় না, যে বিষয়টি প্রধান তা হলো পাত্র আর তাঁর পরিবার সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে আমার বাবা তাঁর ছোট কন্যাকে কারও হাতেই সমর্পণ করবেন না। আমাকে কোন পাত্রে সম্প্রদান করা হবে—এ নিয়ে অনুসন্ধান যখন শুরু হলো, আমি তখন নিমগ্ন আমার যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া নিয়ে। এমনি একদিন ডিপার্মেন্টে এসে হাজির আরেক উপদ্রব। আবারও এক জোড়া নারী—যুগলবন্দী! তাঁদের নানা রকম প্রশ্ন আমার উপেক্ষা করার উপায় ছিল না। পরের দিন দেখলাম আম্মা কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলতে মহাব্যস্ত। বুঝলাম, এই যাত্রায় আর উদ্ধার নেই। এরপর শুরু হলো...ছেলের খোঁজ…পরিবারের খোঁজ…,। পারিবারিকভাবে প্রথমবারের মতো আমি যুগল নারীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম।

এখানেই শেষ নয়, জীবনগল্পের আরেক অধ্যায় শুরু। এখন আমি আর আমার মেয়ে মিলে যুক্ত হয়ে একসঙ্গে যখন লড়াই করি, মেয়ের বাবা আমাদের সঙ্গে সহজে যুক্তি-তর্কে পেরে ওঠে না। এখন বুঝি যুগলবন্দী নারীর শক্তি কোথায়!

পরিশেষে‌,

জয় করো নারী তুমি নিজ সত্তারে,
জাগিয়ে রেখ স্বপ্ন নিরন্তর তোমাতে।
যেওনা অন্যরে রহিতে অযাচিতভাবে,
শান্তি আনো এই সংসারে যুগলবন্দী হয়ে।

*শিক্ষার্থী, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র