যাযাবর

ওয়াশিংটন শহরের ডালাস বিমানবন্দরে এসে রহমান সাহেবের কেমন জানি উদ্‌ভ্রান্ত লাগছে। আগে কখনো এই বিমানবন্দরে আসেননি তিনি। চাকরিজীবনে দেশ–বিদেশ কম ঘোরেননি। কিন্তু বয়সের কারণে আজকাল নিজের ওপরে একদম আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। তা ছাড়া এবারের আসাটা এত তাড়াহুড়ো করে করা। মাত্র তিন–চার দিনের নোটিশে, তা–ও একদম নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে।

দেশে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দুই মহাদেশে থাকা তিন সন্তান রহমান সাহেবকে নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তাঁর একই সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ দুটোই আছে। হার্টে বাইপাস। তাই ছেলেমেয়েরা কিছুতেই তাঁকে দেশে থাকতে দেবেন না। বয়স হওয়ার আরেকটা সমস্যা হলো এখন আর নিজের বলে কোনো মতামতও নেই।

আজ এই ফ্লাইটে বেশির ভাগ মানুষই বয়স্ক, তাঁদের হুইলচেয়ার লাগবে। এদিকে লকডাউনের কারণে বিমানবন্দরে মানুষ খুব কম, হুইলচেয়ার ঠেলার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর অস্থির লাগছে, শিপু যদি এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলে তাঁর ব্যস্ত ডাক্তার। তার হাতে কি এত নষ্ট করার সময় আছে? তাঁর অস্থিরতা দেখে সঙ্গে আসা একটা মাঝবয়সী মেয়ে এগিয়ে এল সাহায্য করতে। মেয়েটাকে দেখে তাঁর নিজের ছোট মেয়ে সাদিয়ার কথা মনে পড়ে গেল। সাদিয়া থাকে সিডনিতে। তাঁর ইচ্ছা ছিল কদিন পরে ওর কাছে যাওয়ার। কিন্তু হলো না। ওর বাচ্চা হবে কয়েক মাস পরে, তাই বড় দুজন বলল ও নাকি এখন তাঁর দেখাশোনা করতে পারবে না। এ জন্যই আমেরিকায় আসা।


বাবাকে দেখে শিপু খুশি হয়েছে বলেই মনে হলো। আলগা করে জড়িয়েও ধরল। ওনার ইচ্ছা করে ছেলেটাকে ছোটবেলার মতো বুকে কিছুক্ষণ চেপে ধরে থাকতে। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে অনেক কিছুই আর করা যায় না।
ওকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে। ও থাকে শিকাগো। ওনাদের কয়েক ঘণ্টা পরে আরেকটা প্লেন ধরতে হবে। ফ্লাইট কেমন ছিল, শরীর কেমন, এসব টুকটাক কথাবার্তার পর আর বলার কিছু নেই। রহমান সাহেব বসে ঝিমুচ্ছেন আর শিপু ফোন গুঁতাচ্ছে। ঘুমিয়েই পড়েছিলেন মনে হয়, ওর ডাকে ঘুম ভাঙল। পরের ফ্লাইটটা ছোট, লোকও বেশ কম। হাত–পা ছড়িয়ে বসে একটু চোখ লেগে আসতেই রহমান সাহেবের পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল।
আজ নাজমা বেঁচে থাকলে কি তাঁকে শিপুর বাসায় যেতে দিত? মনে হয় না। নাজমা বেঁচে থাকলে তাঁকে এ দেশে আসতেই হতো না। বছর ১৫ আগে, হ্যাঁ তাই তো হবে। কী ভয়ংকর একটা রাত ছিল। তিনি আর নাজমা অসহায় হয়ে দম বন্ধ করে বসে আছেন তাঁদের শোবার ঘরে। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে চিৎকার। ভাঙচুরের শব্দ। শিপু আর দিঠি ঝগড়া করছে। দিঠির গলাই শোনা যাচ্ছে বেশি।
‘বিয়ের আগে তুমি বলেছিলে আমাকে আলাদা বাসা করে দেবে। আর কত দিন আমাকে এই ঘুপচির মধ্যে বাচ্চা নিয়ে কষ্ট করতে হবে?’


তার একটাই কথা, এখনি আলাদা হতে হবে। ওদের চিৎকারে তিন বছরের রবি জেগে উঠে কাঁদতে শুরু করে। রবির কান্নায় রহমান সাহেব আর নাজমার চোখ দিয়েও পানি পড়ছে। রহমান সাহেব ছুটে যেতে চাইলেন ওদের দরজায়। নাজমা ঠেকালেন। হঠাৎ পাগলা ঝড়ের মতো ঘর থেকে বের হয়ে এল দিঠি। সে আর এক মুহূর্ত এখানে থাকবে না। রবি মায়ের পা জড়িয়ে কাঁদছে, যেতে দেবে না মাকে। উফ্, সেই একটা রাত গেছে। শিপু আলাদা বাসা নেওয়ার পর নাজমা চেয়েছিলেন এই বাসা ছেড়ে নিজেদের ছোট্ট ফ্ল্যাটটাতে উঠে যেতে। রহমান সাহেবের জন্যই পারেননি। রবিকে দিনের পর দিন না দেখে, শিপুকে না দেখে তিনি থাকতে পারবেন না। তাই জোর করেই ওদের কাছাকাছি একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। তাও কি ওদের পেতেন? বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছেলেকে, নাতিকে দেখবেন বলে। আজ সেই শিপুর বাসাতেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি। হয়তো বদলেছে দিঠি, তা ছাড়া এখন তিনি একা। বলতে গেলে অনেকটা নির্বাক, আসবাবপত্রের মতো।


গাড়িতে শিপু তাঁকে বুঝিয়ে দিল ‘বাবা, দিঠির তো বয়স হয়েছে। রবিকে নিয়েও অনেক স্ট্রেস। তার ওপরে এখন এই পরিস্থিতি। তুমি একটু বুঝে চলো। কিছু লাগলে আমাকে বলো।’ রহমান সাহেব শুধু তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে।
ওর বাসায় সব বেডরুম দোতলায়। রহমান সাহেবকে দেওয়া হয়েছে কোনার একটা বেডরুম। তার সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম। একটা সুবিধা এই ঘরটা রাস্তার পাশে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায়। আকাশ, রাস্তা। সামনের দু–চারটা বাড়ি। সমস্যা হলো ওনার হাঁটুতে ব্যথা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে একটু কষ্ট হয়। উনি ভেবেছিলেন দিনে দুবার নিচে নামবেন। একবার নামলে অনেকক্ষণ থাকবেন। কিন্তু নিচে নেমে দেখেছেন দিঠির মুখ কেমন থমথম করে। সামনে মানুষ অথচ বোবার মতো বসে থাকতে থাকতে বড় বিরক্তি লাগে। বরং তাঁর ঘরে একটা টিভি আছে, সেটা দেখে সময় কাটে। উনি ঠিক টের পান তাঁকে নিয়ে শিপু কিছুটা সংকুচিত, তটস্থ। রবিও বড় হয়ে গেছে অনেক, কাছে ঘেঁষে না আর।


ওজু করতে গিয়ে বাথরুম ভিজিয়ে ফেলেন বলে এর মধ্যে দুদিন শিপু মৃদু রাগ করেছে। আর যেদিন রাতে বেশ ঠান্ডা পড়েছিল, হিটারও বন্ধ ছিল। সেদিন কেমন করে দুর্ঘটনাটা ঘটল তিনি বুঝতেই পারেননি। ঠান্ডা লাগার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন শিপুকে। ভেজা স্পর্শে যখন ঘুম ভাঙল, নিজেই বুঝতে পারেননি যে তিনি বিছানা ভিজিয়েছেন। রাত চারটা, এখন ওদের ডাকাও যাবে না। কোনোমতে উঠে কাপড় পাল্টে পাশের চেয়ারটায় ঠায় বসে ছিলেন। ভয়ে বাকি রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেননি। সকালে শিপুর চোখে দেখেছিলেন বিরক্তি আর আতঙ্ক। চুপি চুপি চাদরগুলো নিয়ে গিয়েছিল লন্ড্রি করতে। আর বাবাকে সাবধান করেছিল ‘দিঠি যেন কোনোভাবেই না জানে।’


কিন্তু কিভাবে যেন দিঠি টের পেয়ে গেল। আর তার দুদিন পরেই শিপু কাঁচুমাচু মুখে জানাল ‘বাবা, এখানে তো দোতলা, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে–নামতে তোমার বেশ কষ্ট হয়। সামিয়ার একতলা বাসা। ওখানে তোমার কষ্ট হবে না। টিকিট কিনেছি। আগামী রোববার তোমার ফ্লাইট।’


আজ সেই রোববার। দুই সপ্তাহ আগে এসেছিলেন শিপুর বাড়ি। আজ যাচ্ছেন সামিয়ার কাছে ডালাসে। আজ আর তিনি ভুল করেননি। শিপু অনেকগুলো ডায়াপার কিনে দিয়েছে, স্যুটকেসে আছে। দুটো আছে সঙ্গের হাতব্যাগেও।
প্লেন উড়ে চলেছে। কম বয়সে প্লেনে চড়তে খুব ভালো লাগত। দেশ–বিদেশ দেখার খুব শখও ছিল। সরকারি চাকরির অছিলায় গেছেন কয়েকটা দেশে। কিন্তু স্বপ্ন ছিল আরও অনেক। নাজমাকে নিয়ে ঘোরার ইচ্ছাও ছিল। তখন হয়নি। আজ তিনি সত্যিকার অর্থেই যাযাবর। তবে স্বাধীন যাযাবর নয়।