
তখন ছিল আগস্টের মাঝামাঝি। লোকজনের চোখে-মুখে আনন্দের আলো ছিটকে পড়ছে। গ্রীষ্মকালে কানাডায় লোকজন ঘরে বসে থাকে না। সারা দিন কাটিয়ে দেয় পার্কে কিংবা লেকের পাড়ে। সেদিন সন্ধ্যায় আমরাও বেরিয়ে পড়লাম খোকন ভাইদের সঙ্গে।
মানুষ বেশিক্ষণ দুঃখের মাঝে বাস করতে পারে না। তাই হয়তো অনিশ্চয়তা, হতাশা ও অপমান পেছনে পড়ে রইল। লেকের পাড় ঘেঁষে শুভ্র পাথরে পা মেলে বসে আমরা বাংলাদেশের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠলাম। একটু পরেই লেকের কোনায় চাঁদ উঠল। চাদের স্নিগ্ধ আলোয় লেকের পাড়ে মায়াবী আলোর খেলা আমাদের শরীর ছুঁয়ে দিল আলতো করে।
খোকন ভাবি আমাকে বললেন, চার মাস হলো, এবার তোমরা মামুর বাড়িতে ঢুকে যাও।
আমি কাগজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, মামুর বাড়ি কি?
মামুর বাড়ি মানে হচ্ছে কানাডার সোশ্যাল সার্ভিস বিভাগ। বেকার লোকদের প্রতি মাসে থাকা-খাওয়ার টাকা দেয়।
খোকন ভাই ওপাশের বেঞ্চিতে বসে ছিলেন। ভাবির কথা শুনে তিনি মহা খ্যাপা। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বললেন, কী বলো? এজাজ কোন ফ্যামিলির ছেলে ভুলে গেছো। মানুষ কী বলবে মামুর বাড়ি গেলে?
ভাবিও রেগে গেলেন। প্লাস্টিকের প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বলতে থাকলেন, কানাডা এজাজের মতো প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত লোক ইমিগ্রান্ট বানিয়ে নিয়ে আসছে। এখন তাকে কোনো চাকরি দেয় না। বেচারাকে একটা ইন্টারভিউতে পর্যন্ত ডাকে না। আনছে কেন তারে।
খোকন ভাইও আরও রেগে গেলেন। আসতে বলছে কে তারে, এত ভালো চাকরি ফেলে!
বড় বড় শহরের অনেক ইমিগ্রান্টই সরকারের এই সাহায্য নেয়। কিন্তু এটাকে বাঙালিরা অত্যন্ত লজ্জার মনে করে। এর চেয়ে ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করাও অনেক সম্মানের, বিষয়টা যেন এ রকম। দুজনেই দুজনকে তর্কে হারানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ভাবি হচ্ছেন প্রচণ্ড কানাডা বিরোধী। ১৩ বছর কানাডা থেকেও বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান মনেপ্রাণে। কী কী ভাবে কানাডারে ছোট আর বাংলাদেশকে ভালো বলা যায় তার সব কৌশলই তিনি একে একে প্রয়োগ করতে থাকলেন।
এজাজ বলল, আমি ভাবছি ঢাকাতে আমাদের জমি আছে, সেটা বিক্রি করে দিই।
আমি আঁতকে উঠলাম। ও মাইগড, বলো কী তুমি। বাংলাদেশের জমি বেঁচে কানাডায় সংসার চালাব। তাহলে কানাডায় এলাম কেন?
কেন কানাডায় এলাম এর উত্তর এজাজের আর জানা নেই। সেই সন্ধ্যায় অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আমরা সোশ্যাল সার্ভিসে দরখাস্ত করব। আমাদের তিনজনের জন্য সোশ্যাল সার্ভিস এগারো শ টাকা বরাদ্দ করল। কিন্তু শর্ত হলো আমাদের ফুলটাইম ইংলিশ ক্লাস অথবা ভলেন্টারি কাজ করতে হবে। কিংবা চাকরি খোঁজার কোর্স করতে হবে।। প্রতি মাসে একবার তাদের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে।
তখনো গ্রীষ্মকাল। চমৎকার সোনালি রোদে চারিদিক ঝলমল করছে। জানালা গলিয়ে সে রোদ আমাদের বেডরুমেও উঁকি দিচ্ছিল। আমি সবে চোখ মেলেছি। এজাজ দুহাতে দুটি গরম গনগনে চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল। মুখে হাসি। মেল বার্লো তার বাড়িতে আমাদের যেতে বলছেন। তার স্বামী জনকে নিয়ে নায়াগ্রার কাছে ছোট্ট শহর সেন্ট ক্যাথরিনসে (Saint Catharines) থাকেন।
মেল বার্লো এজাজের সহকর্মী ছিল বাংলাদেশে। সে একজন উন্নয়ন কর্মী। বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছে বহু বছর। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশে থাকাকালে চমৎকার সম্পর্ক ছিল। এখন দুজনেই ফ্রিল্যান্স কনসালট্যান্ট।

আমি তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসলাম। সত্যি, আমরা নায়াগ্রা যাব। আমার কণ্ঠে তখন আনন্দের ছোঁয়া।
এজাজ গরম চায়ের কাপ মাটিতে রেখে বলল, হ্যাঁ কবে যাবে বল, আমি টিকিট কেটে আনি।
আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম, আমাদের তো কোনো কাজ নেই, চল না কালকেই যাই।
এজাজ কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকিট কাটতে চলে গেল। আমিও সুটকেস গোছাতে লাগলাম।
পরদিন সকাল পাঁচটায় আমরা রওনা হলাম সেন্ট ক্যাথরিনসে। ঝিক ঝিক শব্দ তুলে ট্রেন ছুটে চলেছে। চারিদিকে দিগন্ত জোড়া মাঠ। গমের খেতে কৃষকেরা গম কেটে খড়গুলোকে মেশিন দিয়ে গরুর গাড়ির চাকার মতো গোল করে আঁটি বেঁধে রেখেছেন। কোথাও সোনালি ভুট্টা সবুজ পাতায় মোড়ানো। হলুদ সরষে খেতে মৌমাছিদের আনাগোনা। দুরে আঙুরের ঝোপ বেয়ে উঠেছে কাঠের মাচায়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলারা দুষ্টামি করে হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে লাগল। সারা কম্পার্টমেন্ট ফাঁকা। এজাজ একটা ফাঁকা সিটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। রোদেলা ছুটোছুটি করতে লাগল ফাঁকা বগিতে। আমি খোলা জানালায় বসে দুচোখ মেলে তাকিয়ে রইলাম এই অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে।
চার ঘণ্টা পর ট্রেন এসে থামল ছোট্ট শহর সেন্ট ক্যাথরিনসে। মেল বার্লো আর তার স্বামী জন দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। দুজনেই এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাদের। বার্লোর বয়স ষাটের কোঠায়। কিন্তু দেখে মনেই হয় না। অপরূপ সুন্দরী। জনের বয়সও পঁয়ষট্টি হবে। লম্বা, ফরসা, মাথা ভর্তি কোঁকড়া সাদা আর সোনালি চুল। জন আমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে গেল ওদের বাড়ি।
ছোট্ট দোতলা পুরোনো বাড়ি। চারিদিকে প্রচুর ফলের গাছ। আপেল, নাসপাতি, আঙুর, স্ট্রবেরি সহ আরও কত-কী। বার্লো আমাদের ঘুরিয়ে নিচতলাটা দেখালেন। নিচে একটি বেডরুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। আমরা হাত-মুখ ধুয়ে বাগানে বসে নাশতা করলাম। বাগানে গাছের ছায়ায় গোল টেবিলে সাদা নেটের টেবিল ক্লথ বিছানো। সেখানে ওর নিজের হাতের তৈরি স্যান্ডউইচ, চা, আপেল, আঙুর সাজানো। চায়ের কাপে ও রোদেলার গালে মিষ্টি সকালের রোদ্দুর। সেই রোদের দিকে তাকিয়ে চার মাস পর কেমন ভালো লাগা শুরু হলো। আস্তে আস্তে আমরা বলতে শুরু করলাম আমাদের চার মাসের অভিজ্ঞতা। কখনো চোখের জলে ভিজে যায় আমাদের সবকিছু, কখনো রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠ।

পরম মমতায়, পিঠে স্নেহের হাত রেখে বার্লো বললেন, সবকিছু একদিন ঠিক হয়ে যাবে। তখন তুমি হাসি মুখে আমার বাড়ি আসবে। সত্যি বলতে কী তোমার বাংলাদেশি সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি পাওয়া সহজ হবে না। তোমরা কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হও। কানাডায় যে কোনো কাজেই কানাডীয় সার্টিফিকেট চায়।
আমি ওর টেবিল গোছাচ্ছিলাম। আমার হাত থেকে চায়ের কাপটা ছিটকে পড়ল। কী বলে বার্লো। কত বছর আগে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। মনে মনে বললাম মাথা খারাপ, এই বয়সে হব ছাত্র?
বার্লো এজাজকে একটা কার্ড ধরিয়ে দিলেন। বাংলাদেশে এজাজের অফিসের ফান্ডিং করত যে সংস্থা তার ঠিকানা। নির্বাহী পরিচালকের নাম মিরাবেল। এজাজের চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, টরন্টো গিয়েই ওকে ফোন করবে বুঝলে। তোমাকে তো সে খুব পছন্দ করে। এজাজ মাথা নাড়ল। কোনো জবাব দিল না।
বিদেশের মাটিতে এই অনাত্মীয় বিদেশিনিকে আমাদের প্রচণ্ড আপন মনে হচ্ছিল। কানাডায় আমাদের সে সময়ের একমাত্র বন্ধু বার্লো–জন পরিবারের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হতে থাকলাম। এত দিনের অনিশ্চয়তা, ভীতি, দুর্ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা তিনজনেই। সাদা একটা খরগোশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে রোদেলা। অনেক দিন পর বার্লোর বাড়ির নির্জনতা ভেঙে শিশুর হাসির খিলখিল শব্দে সবকিছুই যেন আনন্দময় হয়ে উঠল। বার্লো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। আমি এই নিঃসন্তান ভদ্রমহিলার চোখের আনন্দের ঝিকিমিকি থেকে আর চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
ধারাবাহিক এই রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: