মেয়ে, তোমার পাতেই উঠবে এবার মাছের মাথা

আমার বাবা, যাঁকে আমি আব্বা ডাকতাম, খাওয়ার সময় প্রায়ই মাছের মাথা আমার পাতে তুলে দিতেন। হয়তো ভাবতেন, কোথায় না কোথায় বিয়ে হয়! ভালো-মন্দ যদি কিছু খাবার সুযোগ না পায়! বাবার আশঙ্কা মিথ্যে হলো! বিয়ের পরে আমার ছোট সংসারে মাছের মাথা খাওয়ার মতো কেউ নেই! অগত্যা আমাকেই খেতে হয়! খাওয়া শেষে এঁটো প্লেটে ধীরে সুস্থে বেছে বেছে মাছের মাথা খাই। আর কেন যেন চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। আব্বার কথা খুব মনে পড়ে।
নিউইয়র্কে আসার পরে জ্যাকসন হাইটসে যে বাসায় থাকি, তার বয়স দেড় শ বছরের বেশি। ঘরের ভেতরে থাকলে বিদেশে আছি ভাবা বেশ কঠিন। এতটাই সাদামাটা। তবে কিচেনের জানালা দিয়ে রাতের বেলা বাইরে তাকালে কেমন এক অপার্থিব অনুভূতি হয়। দূরে ম্যানহাটনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, যেন কোন স্বপ্নপুরী দেখছি! বিশাল উঁচু সব ভবন। কী প্রচণ্ড আলোয় আলোকময়...। ওখানে কারা বাস করে? রাজা-বাদশাহরা? স্বর্গপুরীর রোশনাই দেখতে দেখতে দূর পরবাসে এসে জমিয়ে মাছের মাথা খাওয়াটা ভুলি না...!
এই সমাজে সবাই এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। মাছের মাথা, মুরগির রান, দুধের সর ইত্যাদি খাবার পরিবারের কর্তার জন্যই নির্ধারিত থাকে। নয়তো পরিবারের পুত্র সন্তানকে দেওয়া হয় এগুলো। আমি প্রথম সন্তান হওয়াতেই হয়তো কিছুটা আশকারা পেয়েছি।
আমাদের সময় বেশির ভাগ পরিবারে ভাইবোনের সংখ্যা ছিল চার থেকে ছয়। আমাদের আগের যুগে ছিল আট থেকে ১৪ জন। এখন বেশির ভাগ পরিবারে সন্তান সংখ্যা এক থেকে তিন। আর সেই সন্তানের মধ্যে মেয়ে সন্তান থাকে অতি কাঙ্ক্ষিত। বাবা হোক কিংবা মা, কেন যেন মেয়ে সন্তানের প্রতি আলাদা এক দুর্বলতা থাকে। সন্তানের জন্য মা-বাবার আত্মত্যাগ, মায়া-মমতা, ভালোবাসা হয়তো মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি উপলব্ধি করে। হয়তো মেয়েরা মা-বাবার কথা বেশি মানে, বেশি সেবা করে কিংবা বেশি সময় দেয়।
এভাবে সময় বদলেছে। প্রত্যেক পরিবারে এখন মেয়ে শিশু অতি কাম্য। এক মেয়ে হওয়ার পরে দ্বিতীয় সন্তানের বেলায় কেউ ছেলে হওয়ার জন্য আগের মতো আকুল হয় না! বরং মেয়ে হলে খুশিই হয়, স্বাভাবিকভাবে নেয়। দুই সন্তান ছেলে হওয়ার পরে অনেকের আক্ষেপ দেখা যায় মেয়ে নেই বলে। অনেককে বলতে দেখা যায়, পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া যায় না, যদি কন্যা সন্তান না থাকে।
কন্যা শিশু নিয়ে মা-বাবার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকখানি বদলালেও মিডিয়ায়, সমাজে, স্বামী-শ্বশুরবাড়িতে নারী এখনো নির্যাতিত, অবহেলিত, বৈষম্যের স্বীকার। মিডিয়ার কথাই ধরুন। নীতি নির্ধারক পর্যায়ে কতজন নারী পাওয়া যায় পুরুষের তুলনায়। যদিও নিজেদের নিষ্ঠা ও প্রতিভা দিয়ে ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থানে উঠে আসছে নারীরা। তবু মিডিয়াতে বিশেষ করে সিনেমা, নাটক, বিজ্ঞাপনে নারীদের পণ্য বানানোর প্রচেষ্টা কমেনি, বরং বেড়েছে। আর সমাজের নানা ক্ষেত্রে, সেটা আমেরিকার নিউইয়র্কের সমাজ হোক, আর বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলই হোক, নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের খবর জানা যাচ্ছে। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাপা পড়ে যাচ্ছে।
সারা পৃথিবীর চোখ যেখানে, সেই হলিউডের নায়িকারাও জানিয়েছেন, তাঁরা নানাভাবে যৌন নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত অস্কারের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘নির্যাতন’। এই বিষয়ে মুখ খুলতে হলিউডের নায়িকাদের যদি এত বছর লাগে, তাহলে অন্যদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। অনেকে বলেন, আমেরিকায় যৌন নির্যাতন, মানসিক কিংবা শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে এশীয় নারীরা ভালো অবস্থায় আছে। তবে প্রকৃত সত্য হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা ল্যাটিনো নারীরা যেভাবে মুখ খোলে, পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে, সমাজ-সংসার ও সংকোচের কারণে এশীয় নারীরা সেটা করে না।
বাংলাদেশ থেকে আগত বহু নারী আমেরিকাতেই স্বামী ও তার শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের কাছে নির্যাতিত হচ্ছে। এই নিয়ে গল্প করছিলেন আমেরিকার মূলধারার সঙ্গে যুক্ত নারীনেত্রী রোকেয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমি এক মেয়েকে চিনি, যে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন ছাড়া এখানে কারও সঙ্গে মেশে না। মানে তার সেই অনুমতি নেই। তার খালার বান্ধবী হিসেবে মেয়েটিকে নিয়ে একবার ঘণ্টাখানেকের জন্য ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। মেয়েটির স্বামীর এতে অনুমতি থাকলেও বাসায় ফিরে তাকে শ্বশুরের বকাঝকার মুখোমুখি হতে হয়। এভাবে তারা বিদেশে এসে দেশের চেয়েও বেশি পরাধীন হয়ে পড়ে। আবার কোনো কোনো শিক্ষিত পরিবার আছে, যারা হয়তো নিউইয়র্কের বাইরে অন্যান্য রাজ্যে বিশাল প্রাসাদ বানিয়ে বাস করে। তারা একজন শিক্ষিত মেয়েকে বউ করে আনে, একজন শিক্ষিত গৃহকর্মী পাওয়ার জন্য।’
নিউইয়র্কে অনেক মেয়ে কাজ করছে ঠিকই। কিন্তু কজন পারছে তাদের আয়ের অর্থ স্বাধীনভাবে ভোগ করতে? অধিকাংশই কিন্তু পারছে না। নিউইয়র্কে ইলেকশন কাউন্সিলের একমাত্র বাঙালি প্রতিনিধি মাজেদা উদ্দীন দীর্ঘদিন কাজ করছেন নির্যাতিত নারীদের নিয়ে। প্রতি দিনই অনেক অভিযোগ আসে তাঁর কাছে। তিনি দুটি ঘটনার কথা বলেছিলেন সেদিন, ‘আমার পরিচিত এক মেয়ে, সে একজন রেস্টুরেন্টের ওয়েট্রেস, যার স্বামী জায়রোর গাড়িতে কাজ করে। স্বামী তার স্ত্রীর আয়ের অর্থ নিজের অ্যাকাউন্টে রাখে। স্ত্রীকে জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট বা আলাদা অ্যাকাউন্ট করতে দেয় না। আবার আরেকজন, সেও রেস্টুরেন্টের ওয়েট্রেস, যার স্বামী সরকারি চাকরি করে। ওই ব্যক্তি প্রায় রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফেরে। নিজের আয়ের অর্থে নিজের অধিকার না থাকাটা কত কষ্টের, তা বলে বোঝানো যাবে না।’
স্ত্রী কাজ করে। স্বামী সন্তানদের দেখাশোনা ও ঘরের কাজ করে। এমন পরিবার আমেরিকায় অনেক দেখা গেলেও, বাঙালিদের মধ্যে বিরল। আজন্ম সংস্কার থেকেই বাঙালিরা ধরে নেয়, পুরুষ সংসারের কর্তা। সুতরাং তারাই মূল উপার্জনের কাজটা করবে। আর যারা সেটা করে না, তাদের ‘আকাইম্যা’ পুরুষ বলে ধরা হয়। এখানেও ব্যতিক্রম আছে। নার্গিস আহমেদ নিউইয়র্কে এসে ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস নিয়ে অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি নিয়ে এই খাতে দীর্ঘদিন কাজ করছেন। তাঁর স্বামী একজন নামকরা ফার্মাসিস্ট। স্বামীকে পড়াশোনা করার সুযোগ দিতে তিনি কাজ করেছেন, সংসার সামলেছেন। পরবর্তী সময়ে স্বামীর পেশাগত জীবনে সাফল্য প্রাপ্তিকে ভেবেছেন নিজের সাফল্য। নার্গিস আহমেদ বলেছেন, এভাবে স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়ার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে নারীকে।
নার্গিস আহমেদ যেভাবে নিজের জীবনকে তৈরি করতে পেরেছেন, সেটা অনেকে পারেন না। অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। আসলে প্রত্যাশা আর প্রত্যাশা ভঙ্গের সেই গল্পটা অনেক পুরোনো। ছেলে কি করে? আমেরিকা থাকে। আ-মে-রি-কা! মেয়ের মা-বাবার মাথা নষ্ট। তড়িঘড়ি করে পাত্রস্থ করা হয় কনেকে। তারপর স্বপ্নের আমেরিকায় এসে মেয়েটা জানতে পারে, তাঁর স্বামী এখানে সাদামাটা একটা কাজ করে। অর্জিত অর্থে একার পক্ষে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তাই হয়তো সাবলেট নিয়ে থাকে। কিংবা নিজেই সাবলেট দেয়। একটা ছোট বাথরুম, ছোট রান্নাঘর ভাগ করে নিতে হয় অচেনা মানুষদের সঙ্গে। এই অবস্থায় কিছুদিন পর ওই কনেকেও কাজে ঢুকতে হয়। সারা দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর বাসায় ফিরে আবার ভাত রাঁধো, বাথরুম পরিষ্কার করো, লন্ড্রি করো, বাজার করো..কত কি?
স্ত্রী দিনে কাজ করে। স্বামী এই সময় সন্তানদের রাখে। আবার স্ত্রী বাড়ি ফেরার পরে, স্বামী রাতে কাজ করতে বের হয়। দুজনের সম্পর্কটা হয় ‘হাই’ আর ‘বাই’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিজের আনন্দের জন্য, বিনোদনের জন্য আর কোনো সময় অবশিষ্ট থাকে না। কেউ কেউ বিষণ্নতায় ভোগে। তবে বেশির ভাগই ঘুরে দাঁড়ায়। নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নেই জেগে উঠতে হয় তাদের।
নিউইয়র্ক তথা পুরো আমেরিকায় ঘরে-বাইরে সমানতালে কাজ করছে বাঙালি নারী। মনে হবে যেন দশভুজা দুর্গা মা। সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়া, তাদের খাওয়ানো-গোসল করানো, হোমওয়ার্ক থকে শুরু করে বাজার, রান্না, ঘর পরিষ্কার সব দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে তারা। আবার বাইরেও কাজ করছে।
‘এখানে যেকোনো বয়সে পড়াশোনা শুরু ও সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের চাকরিতে ঢোকার সুযোগ আছে।’- কথাটা বললেন আরবান হেলথ প্ল্যানের পরিচালক মেরি জোবায়দা। তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে আরও জানালেন, ‘বিভিন্ন চরিত্রে নারীর ভূমিকা কেমন হবে বাংলাদেশে তা সমাজ ঠিক করে দেয়। কিন্তু এখানে এমন কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। দাদি-নানি হয়ে গেলেন বলে ঘুরতে পারবেন না, বাইরে কাজ করতে পারবেন না, আমেরিকায় এটা কেউ ভাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কথা আলাদা। সেখানে নারীর অবস্থানের অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজের দিকে তাকান। ভালো স্ত্রী কে? যে সবচেয়ে বেশি সহ্য করে, সে-ই না? আর এখানে একজন সিঙ্গেল মায়ের সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে টিকে থাকার সুযোগ আছে।’
যারা খুব ছোটবেলায় এই দেশে এসেছে কিংবা এখানেই জন্ম, তাদের অবস্থা তো আরও ভালো। আমেরিকায় মূলধারার এমন কোনো পেশা নেই, যেখানে তারা নিজেদের জয় পতাকা ওড়ায়নি। পুরুষদের চেয়েও তারা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। মেধায়-মননে বাঙালি নারীরা যে ভিন্ন সংস্কৃতির মেয়েদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, সেটা তারা করে দেখিয়েছে। বিশেষায়িত স্কুলের পরীক্ষা থেকে শুরু করে যেকোনো পরীক্ষায় ছেলেদের তুলনায় ভালো করছে মেয়েরা। যারা বেশি বয়সে আমেরিকায় এসেছে, তারাও পেশাগত যোগ্যতা অর্জন করে স্বীয় ক্ষেত্রে উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। যে কারণে একজন নীনা আহমেদ শুধু নারী বলে নয়, এ দেশের সমস্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের অনুপ্রেরণা।
শেষে বলি- মেয়ে, মাছের মাথা তো এখন তোমার পাতেই উঠবে। তুমিই এর যোগ্য।