মেয়ের বাবা

বাবা হওয়ার অনুভূতি একেবারেই অন্যরকম। বিশেষ করে যে বাবার প্রথম সন্তান মেয়ে তার আবেগটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের হয়। একজন অগোছালো মানুষ হয়েও জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর যখন বাবা হলাম তখন কেমন যেন একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হলো। সেটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না। কারণ আমি কোনো কালেই গোছানো বা সংসারী মানুষ ছিলাম না। সারা জীবনই সকল সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই। পরবর্তীতে সেটা কতখানি লাভজনক হলো সেটা নিয়ে ভাবিনি। লাভ হলে ভালো লাগত আর ক্ষতি হলে সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতাম। বাবা হওয়াটা আসলে কতখানি লাভজনক হলো সেটা নিয়ে তাই ভাবিনি। তবে এক বন্ধুর বাবার কথাটা আমার খুব মনে পড়ে সব সময়। তিনি বলেছিলেন, শোনো ইয়াকুব আমরা ঠিক বয়সে বিয়ে করে বাবা-মা হয়েছিলাম বলেই কিন্তু আজ আমরা ঠিক সময়ে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে যেতে পারছি। তোমরা যদি বিয়ে করতে দেরি করে ফেল তাহলে তো তোমাদের ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার আগেই তোমরা মারা যাবে আর তোমাদের ছেলেমেয়েরা কম বয়সে অকুল দরিয়ায় পড়বে। এর সঙ্গে আমি একটা মজার লাইন যোগ করেছিলাম, মারা যাওয়ার পর ছেলেমেয়েরা এসে কবরের ওপর গাছের ডাল দিয়ে পেটাবে আর বলবে ব্যাটা জন্ম দিয়ে গেলি এখন মানুষ করবিনি কেডা?
মেয়েকে আমি প্রথম তিন মাস কোলেই নিইনি এই ভয়ে যে, যদি আমার কোলে উঠে ওর কোনো সমস্যা হয়। আমি বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিলে একটু বেশিই শক্ত করে ধরি যাতে পড়ে না যায় সেই ভয়ে। এতে করে বাচ্চাকাচ্চাগুলো কান্নাকাটি শুরু করে এবং বেশির ভাগ সময়ই বাচ্চার পেটে চাপ পড়ে যাওয়াতে আমার কোলে হিসু করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। একবার এক ভাতিজাকে কোলে নেওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও যখন সে হিসু করে দিল না আমি খুব খুশি হয়ে ওর দুহাত ধরে উঁচু করে আমার সামনে ধরলাম। ব্যস তখনই একটু ঢিলা পেয়ে দিল হিসু করে। আর তাকে যেহেতু আমি উঁচু করে ধরে রেখেছিলাম তাই আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হিসু এসে আমার একেবারে গালের মধ্যে পড়ল। সে এক অভিনব দৃশ্যের অবতারণা। ঘটনার আকস্মিকতা বুঝতে একটু সময় নিলাম তারপর দ্রুতই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফুপুর হাতে তাকে হস্তান্তর করলাম। ভাতিজাও ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে এবং দ্রুত আমার কোল থেকে নামিয়ে দেওয়া দেখে হয়তো তার একটু ব্যক্তিত্বেও আঘাত লাগল। তাই তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। যা হোক, নিজের মেয়েকে কোলে নেওয়ার পর ভাব জমতে আমাদের আর সময় লাগেনি। আমরা দ্রুতই একে অপরের অন্ত প্রাণ হয়ে গেলাম। সংসার জীবনে আমি এত দিনে আমার একজন যোগ্য সহকর্মী পেয়ে যারপরনাই খুশি হলাম। আমার সব কাজই সে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং বোঝার চেষ্টা করে আমি কী করতে চাইছি। আমাদের নিজস্ব একটা জীবনধারা চালু হয়ে গেল। আমি যেখানেই যায় মেয়ে তাহিয়া আমার পিছু নেয়।

আমাদের দুজনের অপকীর্তির ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। খুব ভোরে সকলের ঘুম ভাঙার আগেই আমরা উঠে পড়তাম। তারপর ক্যামেরা হাতে নিয়ে আমরা বাপ-বেটি অভিযানে বের হয়ে যেতাম। তারপর সারা পাড়াময় ঘুরতাম আর ছবি তুলতাম। কোনো দিন ধানের খেতের আল ধরে খালি পায়ে হাঁটতাম। মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করত, তুমি কেন খালি পায়ে হাঁটছ? আমি বলতাম এতে বুদ্ধি বাড়ে। তাহিয়া কিছু না বুঝেই মাথা নাড়ত। কোনো দিন নেমে পড়তাম পালং অথবা লাল শাকের খেতে। কোনো দিন রাত্রে ঝড় হয়েছে তাই আরও একটু সকাল সকাল বেড়িয়ে কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম ছোট ছোট আম। খেজুরের, তালের রসের সময়ে আমাদের প্রথম কাজ ছিল তালের খেজুরের গাছ খুঁজে বের করা। তারপর যিনি গাছ কাটেন তাকে খুঁজে বের করা। অবশেষে তার দেখা পেয়ে তার শিডিউল জেনে নিয়ে সময়মতো হাজির হয়ে যেতাম আমরা বাপ বেটি। তাহিয়া খেজুরের রসটা পছন্দ করত কিন্তু তালের রস এক চুমুকের বেশি খেতে পারত না, কারণ অনেক বেশি ঝাঁজ। আশপাশের কোনো গ্রাম্য মেলা আমাদের ছাড়া জমত না। তাহিয়া আমার কাঁধে উঠে অবাক বিস্ময়ে মানুষের আনাগোনা দেখত আর একের পর এক প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করত। সারা মেলা ঘুরে আমরা সবগুলা খেলাধুলার বাহনে চড়ে সাধ্যের মধ্যে সামান্য মিষ্টান্ন জাতীয় দ্রব্য কিনে বাসায় ফিরতাম।

এত গেল বাইরের কর্মকাণ্ড। বাসার মধ্যে আমাদের কর্মযজ্ঞ ছিল আরও বিশাল পরিসরে। অফিস থেকে ফেরার পর রাতের খাবারটা আমিই ওকে খাইয়ে দিতাম। খাবারতো সে কোনোভাবেই খাবে না। তখন একটা বুদ্ধি বের করলাম। ওকে এক গাল খাবার দিয়ে বলি তুমি লুকাও আমি তোমায় খুঁজি। পরেরবার ওর মুখে খাবার দিয়ে আমি লুকাতাম আর সে আমাকে খুঁজে বের করত। এভাবে খেতে খেতে আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যেত। আমি কখনো স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে কোনো কাজ করতে বসলে মেয়েও এসে আমার সঙ্গে বসে যাবে। তারপর আমার হাত থেকে স্ক্রু ড্রাইভারটা নিয়ে লেগে পড়বে সেই কাজে। এরপর তাকে সেখান থেকে সরানো মুশকিল হয়ে পড়ত। বাসার ছাদে ফুল গাছে পানি দিতে গেলে সেও এসে আমার সঙ্গে যোগ দেবে। আর তাকে না দিতে দিলে শুরু করবে চিৎকার। বৃষ্টি শুরু হলে চলে যেতাম ছাদে। তারপর বৃষ্টি থামার আগ পর্যন্ত ছাদ থেকে আমাদের নামায় কার সাধ্যি। শিল পড়লে আমরা গ্লাস ভর্তি করে শিল কুড়াতাম। কুড়ানোর সময় ওর হাতে দু-একটা দিলে সে আর সময় নষ্ট না করে সরাসরি পেটে চালান করে দিত।
সিঁড়িঘরের টিনের চাল থেকে অনেক পানি একসঙ্গে পড়ে দেখে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ভিজতাম। আমার দেখাদেখি সেও সেখানে ভিজবে। পাশের বাসার মেহগনির গাছে একটা কাক বাসা বেঁধেছে দেখে আমরা প্রত্যেকদিন খোঁজ নিতাম কবে ডিম পাড়ল, কবে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলো। একসময় বাচ্চাগুলো বড় হয়ে উড়ে যেত তখন একটু মন খারাপ করত মেয়েটা। আরেক পাশের বাসার গাছে কদম ফুল ধরার পর আমরা তক্কে তক্কে থাকতাম কবে সেগুলো ফুটবে। তারপর সেগুলো পেড়ে নিয়ে কত ধরনের খেলা। বাসার ভেন্টিলেটরে চড়ুই পাখি এসে বসে রাতে। সেটা দেখে আমরা হার্ডবোর্ড দিয়ে বাসা বানিয়ে দিলাম যাতে চড়ুই পাখি সেখানে বাসা বাঁধতে পারে। সেখানে এক জোড়া চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছিল। আমরা প্রায় প্রতিদিনই চেক করতাম ওরা ডিম পেড়েছে কি না? সাভারের নার্সারি থেকে একটা ক্রিসমাস ট্রি কিনে এনে সেটা বাসার একটা টবে লাগিয়ে বারান্দায় রেখেছিলাম। যেটাকে সাজিয়ে আমরা বড়দিন পালন করতাম। সেটাতে সত্যিই একদিন চড়ুই পাখি বাসা বেঁধেছিল কিন্তু সেটা আমাদের দেশান্তরি হওয়ার পর। সেই ছবি দেখে মেয়েটা আমার কত খুশি।
তাহিয়া একটু বড় হওয়ার পর আমি বাসায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁধে ঝুলে পড়া ছিল ওর একটা অভ্যাস। আমি ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাসায় ঢুকতাম। তারপর ওর সারা দিনের কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি শুনতে হতো। সবার আগে বলত কাকে আমার মার দিতে হবে। যাকে মারতে হবে সে আজ তাকে বোকা বানিয়েছে বা মেরেছে। বাইরে ঘুরতে বের হলে ওর সবচেয়ে পছন্দের বাহন হচ্ছে আমার কাঁধ। আমার কাঁধে চড়েই ওর সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। হেঁটে একটু ক্লান্ত হলেই রাস্তায় বসে পড়বে। তার মানে হচ্ছে তাকে কাঁধে নিতে হবে। রাতে ঘুমানোর সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে তার ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেল একসময়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে রাতে ওর বাথরুম পেলে চিৎকার করে আমাকে ডাকবে। এখন পর্যন্ত আমার তাকে ওর মাকে ডাকতে শুনিনি। পানি পিপাসা পেয়েছে তবুও আমাকে ডাকবে। মাঝেমধ্যেই আমার গা বেয়ে উঠে বুকের ওপর ঘুমানো অভ্যাস হয়ে গেল তার। ওর আরও একটা মজার খেলা ছিল আমি ঘোড়া হলে সে আমার পিঠে চেপে বসবে আর আমি ঘোড়ার মতো শব্দ করে করে সারা বাসা ওকে নিয়ে ঘুরব।
এত কিছু লেখার কারণটা এখন বলি। মেয়েটা দেখতে দেখতে ধাঁই ধাঁই করে বড় হয়ে যাচ্ছে আর আমার কাছে থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। হয়তোবা সব মেয়ের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনায় ঘটে। কিন্তু আমার স্পর্শকাতর মন কেন জানি ব্যাপারটা নিতে পারছে না। আমি চাইলেই এখন আর ওকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে পারি না। ওর ইচ্ছে করলেই ও আর দৌড়ে এসে আমার কাঁধে ঝুলে পড়তে পারে না। কারণ আমি এখন আর তাল সামলাতে পারি না। শেষ ওকে যেদিন কাঁধে নিয়েছিলাম এরপর প্রায় সপ্তাহখানেক কাঁধের আর কোমরের ব্যথায় ভুগেছিলাম। ঘোড়া এখনো হই কিন্তু তাতে চড়ে বসে ছোটজন।মেয়ে রাতে বায়না ধরে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। কারণ কোনো কিছু জড়িয়ে না ধরে ঘুমালে ওর ভয় লাগে, খারাপ স্বপ্ন দেখে। কিন্তু আমিই আর পারি না ওকে আগের মতো পুঁটলি পাকিয়ে জড়িয়ে ধরতে।
এই ব্যাপারগুলো নিয়ে মেয়ে অনেক মন খারাপ করে। আমারও অনেক মন খারাপ হয়। কিন্তু এটাই হয়তো মেয়ের বাবার নিয়তি। তারপরও অবুঝ মন কেন জানি মানতে চায় না। আমাদের পরিবারের প্রথম মেয়ে সন্তান হচ্ছে তাহিয়া। তাই দাদা-দাদি, নানা-নানি সবারই খুব আদরের। যদিও আমি ওকে এই সব আদর থেকে বঞ্চিত করে এক বিশাল অপরাধ করে ফেলেছি। আমি জানি না সে আমাকে এই অপরাধের জন্য কখনো মাফ করবে কিনা। পৃথিবীর সব মেয়ের বাবারই হয়তো আমার মতো অনুভূতি হয়। কিন্তু যেহেতু সে আমার প্রথম সন্তান তাই হয়তো মেনে নিতে পারছি না। পৃথিবীর সকল মেয়ে ও তাদের বাবাদের জন্য এক বুক অকৃত্রিম ভালোবাসা।
মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।