মেঘের অপেক্ষা

‘না, আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড বড্ড ফাঁকা। কোথাও একটু নিজেকে আড়াল করব সে উপায় নেই’—মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে মেঘ। প্রচণ্ড অস্থিরতা এবং ভয়ে মুহূর্তে দুটোই তাকে গ্রাস করেছে। বা দিকে কিছুটা এগোতেই সে একটা জায়গা পেয়ে গেল নিজেকে আড়াল করার।
বিশাল বিশাল দুটি মেহগনি গাছকে দেয়াল করে দাঁড়িয়ে আছে একটি বাস। জায়গাটা কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। হাত ঘড়িটার দিকে তাকাল মেঘ। এখন বাজে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। আধ ঘণ্টা হয়েছে সে বাসা থেকে পালিয়েছে। বাসা বেশি দূরে নয়। যে কোনো সময়ই যে কেউ তাকে খুঁজতে এখানে চলে আসতে পারে। ধরা খেলে কী হবে তা এখন ভাববার সময় নেই। এখন শুধু একটাই চিন্তা, যাকে আসতে বলেছে সে কতক্ষণে আসবে। মেঘের দৃষ্টি রাস্তার অপর পাশে। যার আসার কথা সে ওই পাশেই বাস থেকে নামবে। কদ্দূর এল তাও সে জানে না। তাড়াহুড়া করে বাসা থেকে বের হতে গিয়ে মোবাইলটা ফেলে এসেছে।
মোবাইলের কথা মনে হতেই বাসার সবার কথা মনে পড়ে গেল। আব্বু আম্মু তাকে না পেয়ে কী করছে। ভাবার চেষ্টা করল। জীবনের সতেরটা বছর যাদের সঙ্গে কাটিয়েছে; যারা তাকে সব সময় আগলে রেখেছে তাদের কথা ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
ব্যবসায়ী বাবা আবদুল হামিদ ও আদর্শ গৃহিণী মা তাসফিয়া রহমানের অনেক আদরের মেয়ে মেঘ। তাদের সংসারের প্রথম সন্তান। মেঘের যখন জন্ম হয় তখন আকাশ আষাঢ়ের মেঘে ঢেকে ছিল। তাই বাবা মা আদর করে তার নাম রাখেন মেঘ। তারপর তাদের আরও তিনজন কন্যা সন্তান হয় কিন্তু মেঘের আদর এখনো বাবা মায়ের কাছে বেশি। ছোট তিন বোনও তাকে অনেক ভালোবাসে। আর মেঘও পরিবার বলতে ছিল অন্তঃপ্রাণ। ছোটবেলা থেকেই তাকে শেখানো হতো, তুমি বড় বোন, তোমাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হবে। অনেক কিছু ত্যাগ করতে হবে। এই শিক্ষার অবাধ্য সে কখনোই মনে স্থান দেয়নি। ছোট বোনদের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছে। রাতে ভূমিকম্পে যখন খাট নড়ছিল তখন পাশে ঘুমিয়ে থাকা ছোট বোন মনে করেছিল খাট বুঝি মেঘ নাড়াচ্ছে। তাই মেঘের ঘুম ভেঙেছিল ছোট বোনের কিল ঘুষিতে। তখনো সে হাসি মুখে সহ্য করেছিল। নিজের ভালোবাসার মন ছিল। কিন্তু তাকে রেখেছিল মৃত করে। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস মৃত ভালোবাসার চরটা জেগে উঠল একদিন নিজের অজান্তেই।
মাস ছয়েক আগের কথা। ঘড়ির কা’টায় ঠিক সকাল এগারোটা। ৩৬ নং বাস আজিমপুর সিগন্যালে আটকে আছে প্রায় ১৫ মিনিট। ডান পাশে জানালার সিটে বসে ছিল বর্ষণ। হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে যায় রাস্তার অপর পাশে। সতের-আঠার বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীল শাড়ি পড়ে। ঘন কালো চুল কাঁধের ওপর বড় খোঁপা করা। হাতে ধরে আছে নীল রঙের ব্যাগ। চোখের চাহনিতে উচ্ছলতা। সবকিছু মিলিয়ে ঠিক যেন একজন মেঘ কন্যা। দূর থেকে দেখে বর্ষণ চোখ ফেরাতে পারে না। হয়তো মেয়েটা তার বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছে। এ কথা ভাবতেই বর্ষণের কেন জানি কষ্ট হয়। এত সুন্দর একটা মেয়ে অন্য কারও জন্য অপেক্ষায়; না, তা সে ভাবতে পারে না। নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়, এই ভেবে যে হয়তো মেয়েটির কলেজে কোনো ফাংশান আছে তাই এভাবে সেজেছে। আর হয়তো কোনো বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করছে। এ কথা ভাবতে ভাবতেই সিগন্যাল উঠে যায় বাস আবার চলতে শুরু করে। মেয়েটিও দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।
পরের দিনদুপুর সাড়ে তিনটায় বর্ষণ উপস্থিত হয় চায়না বিল্ডিং গলিতে ‘ডিভাইন কোচিং সেন্টারে’। আজ এখানে তার প্রথম ক্লাস নেওয়ার কথা। তারপর তাকে পাঠানো হয় দ্বাদশ শ্রেণীর বিজ্ঞান ক্লাসে। ক্লাসে ঢোকার পর সব ছেলে মেয়ে তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে এখানে নতুন। আজই যোগ দিয়েছে সকলের উদ্দেশ্যে বর্ষণ তার পরিচয় দেয়। ‘আমি বর্ষণ মাহমুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্স এ অনার্স মাস্টাস। আমি থাকি মিরপুরে।’ তারপর ছাত্র-ছাত্রীরা একে একে তাদের পরিচয় দিতে লাগল। হঠাৎ করেই মিষ্টি কন্ঠের আওয়াজ এল ‘স্যার আসতে পারি।’ বর্ষণ শুনে তাকাল দরজার দিকে। দৃষ্টি সেখানেই আটকে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। মেঘ কন্যা দাঁড়িয়ে আছে দরজায় অনুমতির অপেক্ষায়। একি সত্যি! না নিজের কল্পনা। গতকাল মেয়েটিকে দেখার পর থেকে একটা অদৃশ্য মোহ তাকে ঘিরে আছে। অনেকবার ভেবেছে নীল শাড়ি পরা মেঘ কন্যার কথা। ভেবেছে আর কী কখনো তার দেখা পাবে অথচ আজ সে দাঁড়িয়ে আছে তারই দৃষ্টি সীমানায়। ইচ্ছে করলেই ছুটে যাওয়া যায়।
‘স্যার আসতে পারি?’ আবারও সেই মিষ্টি কন্ঠ। বর্ষণের ঘোর কেটে যায়। কিছু না বলে বোকার মত মেয়েটিকে প্রশ্ন করে, ‘কী নাম তোমার?’
‘মেঘ’ ছোট করে উত্তর দেয় মেয়েটি। খটকা লাগে বর্ষণের। কী জানি বানিয়ে নাম বলল নাকি মেয়েটি। সে আবারও বোবার মত প্রশ্ন করে, ‘সত্যি তোমার নাম মেঘ?’
‘কেন স্যার আপনার সন্দেহ আছে?’ দুষ্টিমি পূর্ণ হাসি দিয়ে জিজ্ঞস করে মেঘ। বর্ষণ কী বলবে বুঝতে পারল না। মেঘকে ভিতরে আসার অনুমতি দিল। বর্ষণ বুঝতে পারল তার আর রাগ নেই। এ মেঘের মুখ যেমন হাসে চোখও তেমনি হাসে। যে হাসির মায়াজাল ভেদ করার সাধ্য তার নেই। সুতরাং, নিজেকে সপে দিল সেই মায়াজালে।
এভাবে কেটে গেল মাস দুই। হঠাৎ করেই একদিন রাত বারোটার দিকে মেঘ ফোন করল বর্ষণকে। পড়া বুঝে নেওয়ার অজুহাতে অনেক কথা হয় প্রতিদিন। বর্ষণের সবচেয়ে ভাল লাগে মেঘের সেন্স অব হিউমার। আর মেঘের সবচেয়ে বড় গুন হলো সে কখনো রাগে না। তাছাড়া মেয়েটি অনেক বুদ্ধিমতী। বর্ষণ জানে সে যে মেঘকে পছন্দ করে এটা মেঘ বুঝতে পারে। কিন্তু মেঘ বর্ষনকে পছন্দ করে কিনা তা সে কখনোই বুঝতে দেয় না।
এভাবে কেটে গেল আরও চার মাস। বর্ষণ মেঘকে বলতে পারেনি, সে তাকে ভালবাসে। ফলে বর্ষণের মনের মেঘটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আজ সন্ধ্যা ৬টায় মনের সেই মেঘটা তৃপ্তির বৃষ্টির হয়ে ঝরে যায় যখন মেঘ তাকে ফোন করে অপ্রত্যাশিত কিছু শোনায়। বর্ষণ নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যখন সে কথাগুলো শুনছিল। আজ রাত আটটায় মেঘের বিয়ে। ছেলে কানাডা প্রবাসী। এরকম বিয়ের প্রস্তাব গত এক বছর যাবত প্রায়ই আসে। মেঘের তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। কেননা সে তার বাবা মায়ের অবাধ্য হতে চায় না। কিন্তু আজ তার কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না। হঠাৎ করেই বর্ষনকে পেতে ইচ্ছে করল। মুছে গেল সমস্ত বাধ্য বাধকতা। এক মুহূর্ত কিছু না ভেবে ফোন করল বর্ষনকে। আসতে বলল আজিমপুরে। সেখানে সে অপেক্ষা করবে। তারপর সবার চোখের আড়ালে বাসা থেকে বের হয়ে এখন সে আজিমপুরে বর্ষণের অপেক্ষায়।
মেঘ আজও নীল শাড়িতে; তবে বিয়ের সাজে। মনের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। হঠাৎ রাস্তার অপর পাশে বাস থেকে নামতে দেখলো বর্ষনকে। অসম্ভব একটা ভাল লাগায় আবিষ্ঠ হল মেঘ।
বর্ষণ যখন রাস্তা পার হয়ে দুই রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। তখন সে মেঘ কে দেখে হাত নাড়াল। বর্ষণ আজ পরেছে গাঢ় নীল পাঞ্জাবী। সোডিয়াম লাইটের আলোয় খুব সুন্দর লাগছে তাকে। ঠিক সেই মূহুর্তে আকাশ ভেঙ্গে শুরু হল প্রচণ্ড বৃষ্টি। ঝুম বৃষ্টিতে বর্ষণ কাকভেজা হয়ে গেল। ট্রাফিক আইল্যান্ড থেকে রাস্তায় নামল। পা বাড়ালো মেঘের উদ্দেশে। হঠাৎ করেই মেঘের মনে একটা আজানা ভয় আঘাত করল।
ভারী বৃষ্টির পানিও আঁড়াল করতে পারলো না মেঘের চোখের পানি। বর্ষণ যখন ঠিক রাস্তার মাঝখানে চলে এল, বা দিক থেকে ছুটে এল দ্রুতগতির একটি প্রাইভেট কার। কী করবে সে, সামনে এগোবে না পেছনে? না সে পেছনে যাবে না। কেননা আজ সে এসেছে সামনে এগিয়ে যেতে। সেখানে আছে মেঘ। মেঘের হাত ধরে পাড়ি দেবে বাকিটা পথ। গাড়িটা চলে আসে তার নাগালের মধ্যে। বর্ষণ পা বাড়ায় সামনে—। অপেক্ষায় মেঘ।