সেদিন যখন আন্টি চলে যাবেন বাসা ছেড়ে, যাওয়ার আগে বারবার আমাদের বাসার দরজায় নক করে বলছিলেন, ‘ও মা আমরা তো যাব খানে, কষ্টের কতাগুলো আর কারও কাছে কতি পারব না। আমার ছাওয়াল আমাক ঘর থেইকে বাইর করে দিলে তোমাগের বাসায় কেমনে আসমু? আমারে তোমাগো ঠিকানাডা লেইখা দিবা? কত কতা কয়েছি মাপ সাফ কইরে দিও মা’, বুকটা হুহু করে উঠে কষ্টে।
একদিন কাজ থেকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে দেখি ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা কানের দুলের বক্সটা লন্ডভন্ড হয়ে আছে। আম্মাকে চিৎকার করে ডাকতেই আন্টি দৌড়ে এসে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওমা আমার নাতি এরাম করেছে। মাফ কইরে দাও গো মা, অর আসপে না। আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তিনি বলে উঠেন, মা গো সারা দিন তো কথা শুনিই, আর শুনাইও না।’
কঠোর হওয়ার চেষ্টা করেও সেদিন কঠোর হতে পারিনি বৃদ্ধা আন্টির সঙ্গে। পারি না আমি। সন্তানের কাছে অবহেলা পেতে পেতে অভিমানে নষ্ট হয়ে গেছে তাঁর সব অনুভূতি। অভিমানে আর উনি কাউকে বইতে পারেন না, সইতেও পারেন না। দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করে করে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিমান হয়েছে ভীষণ কঠিন।
আমার আম্মা চোখে ইশারা দিয়েছেন কিছু না বলার জন্য।
ঈদের দিন সকালে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে কাজে যাচ্ছি। অ্যালার্ম দেওয়ার পরও ঘুম ভাঙেনি। অঘোরে ঘুমাতে দেখে চুন্নু জাগিয়ে দেয়। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে জামা-কাপড় পরে দরজা খুলে দৌড়ে কাজে বের হওয়ার সময় দেখি আন্টি নিচে গেটের সামনে বসে আছেন। ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই যাও মা?’ বললাম, ‘আন্টি কথা বলতে পারব না, কাজে যাই। আপনি এখানে বসে আছেন কেন?’ বললেন, ‘রাইতে রান্নাবান্না কইরে আর ঘুমাই নাই মা। তোমার চাচার সাতে কতা কলাম। আমার ছাওয়াল ঈদের মইদ্দে বাপেরে টাকা পয়সা কিছু দেয় নাই মা। তোমার কাছে ৩০০ ডা টেকা হইবে আমি তোমারে পরে আস্তে আস্তে দিয়া দিবনে মা।’ দেখি বলে তাড়াহুড়ো করে কাজে চলে যাই। বাসে বসে কাজে যাওয়ার সময় আন্টিকে নিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে থাকি। আন্টির মায়াময় ক্লান্ত, বিষাদমাখা মুখখানা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। বারবার আমার মায়ের কথা মনে পড়ছিল। আমার মাকে যদি বড় ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে থাকতে দিতাম আমার মায়েরও কি এমন করুণ অবস্থা হতে পারতো! ভেবে শিউরে উঠি।
আমরা সন্তানেরা দেশ থেকে গ্রিনকার্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে বাবা-মাকে এ দেশে এনে কি অমানবিক কষ্ট দিয়ে থাকে আন্টি হচ্ছেন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। দেশে স্বামী কষ্ট করছেন, এখানে আন্টি নিজে। সারা দিন ঘরের সব কাজ করে, বাচ্চাদের খেয়াল করে বিকেলে অবসর পেলে ছেলের বউয়ের কাছে বাচ্চাদের রেখে হাঁটতে বের হন। হেঁটে এসে ঘরে কেউ না থাকলে, আমাদের বাসায় আম্মা না থাকলেও বসে থাকেন। আমি কাজ থেকে ফিরে আন্টিকে দেখে বলি আপনার কাছে ঘরের চাবি নেই? প্রায় কান্নার মতো করে বলেন, ‘আমার পোলার বউয়ের গয়না সব বাসায় রাখে, তাই পোলায় ঘরের চাবি দিতে না করছে।’ আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। কষ্টে চোখের কোন ভিজে উঠে। শাড়ির খুঁটটায় মুখ লুকিয়ে আন্টি যখন বলেন, ‘জানো মা, আমার পোলা তার বৌকে বলে, মা আর সারা দিন কি করে বাচ্চাগের লাইগা, তুমি না থাকলে আমার বাচ্চাগের যে কী হইতো!’ কী বলে আন্টিকে সান্ত্বনা দেব বুঝি না। সংসার এক আজব চিড়িয়াখানা। মানুষ নামের কিম্ভূত সব চিড়িয়ার সেখানে বাস।
ঈদের দিন কাজ শেষে ঘরে ফেরার পর আব্বুকে বলি, আব্বু এবার ঈদে কাউকে কোন টাকা দেব না। আব্বু শুনেছেন কিনা জানি না। শুধু বললেন, যা ভালো মনে করো। আন্টিকে চুপে চুপে ডেকে এনে ২০০ ডলার হাতে দিয়ে বললাম, ভাইকে দেশে টাকা পাঠিয়েছি ঈদে, কিছু গরিব বাচ্চাদের দেখাশোনা করি ওদেরও পাঠিয়েছি। হাত প্রায় খালি। তাই যা চেয়েছেন দিতে পারিনি। তবে যা দিলাম এখনই গিয়ে আঙ্কেলকে পাঠিয়ে দিন। এটা আঙ্কেলের জন্য। আমাকে আর ফেরত দিতে হবে না। ডলারগুলো কোমরে গুঁজে রেখে আন্টি চলে যাওয়ার সময় বলছিলেন, তোমার মা আর তুমি ছাড়া কাউরে কষ্টের কতা কবার পারি নাই।
মৃত্যুর আগেই মৃত্যু, সব অপমানের দাগ তাঁর শরীরে। মৃত্যু ছাড়া আন্টির এই অভিমান থেকে মুক্তি নাই। বুকের গভীরে চৈত্রের কুয়োর তলানির মতো কিছু ভালোবাসা হয়তো পড়ে আছে, তাই শত কষ্ট সহ্য করে নাতি-নাতনির কাছে পড়ে আছেন। কিন্তু ওই দুস্তর অভিমান পার হয়ে সেইটুকু ভালোবাসা স্পর্শ করবে কে?
০৬/১৮/২০১৮, নিউইয়র্ক