শ্যামল বাংলার আরও দু-দশটা অজপাড়া গাঁয়ের মতো এলাকাটি। কোনো কোনো সময়ে এমন অনুন্নত এলাকাও ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যেমন করে সিলেটের ‘বাঘা’ নামের গ্রামটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়।
সিলেট শহর থেকে মাইল পাঁচেকের হাওর পাড়ি দেওয়া গ্রাম। গ্রামটির দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে সুরমা নদী। উত্তর-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ হাওর। উত্তর-পূর্বে পাহাড়-সমতল আর হাওরের মিশ্র দুর্গম জনপদ। সবুজ অরণ্যের সমাহার। লাল মাটির পাহাড়ি বন্ধুর পথটি চলে গেছে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত। কোথাও বাঁক নিয়েছে হাওর জলাশয়ের কিনারা ঘেঁষে।
১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ রাতেই হামলা করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির ওপর। এ হামলা শুধু রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ২৫ মার্চের রাতেই সিলেটে ক্যাপ্টেন মুত্তালিব একাই প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। রাত ১২টার পর নিজের বালুচরস্থ বাসায় খেতে বসেছিলেন মুত্তালিব। এমন সময় জানালায় একটি গুলি লাগে। দ্রুত তিনিও রিভলবার হাতে বেরিয়ে পড়েন। কোথাও কাউকে না পেয়ে টিলাগড় পয়েন্টের অদূরে এসে উপস্থিত হন। এমন সময় সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি ছুটে আসছিল শহরের দিকে। নিজে প্রস্তুতি নিয়ে একটি খালে শুয়ে পড়েছিলেন ক্যাপ্টেন মুত্তালিব।
একটু পর দুজন সেনাসদস্য নিয়ে গাড়িটি টিলাগড় পয়েন্টে পৌঁছায়। তারপর বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় গাড়িটি স্টার্ট নিতে শুরু করলে চোখের পলকে খাল থেকে বেরিয়ে সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন মুত্তালিব। সঙ্গে সঙ্গে সেই সৈনিকের মাথার খুলি উড়ে যায়। পরমুহূর্তেই মুত্তালিব ট্রিগার চাপেন চালক সৈনিকের বুক লক্ষ্য করে। পাকিস্তানি সেই সেনার বুক ঝাঁজরা হয়ে যায়; উল্টে যায় গাড়িটি। শুরু হয় সিলেটে হানাদারদের হামলা। প্রান্তিক জনপদে ছড়িয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধ। ‘যার যা আছে’, তা নিয়ে এক অসম লড়াই। মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে নিরস্ত্র বাঙালির স্বাধীনতার লড়াই!
টিলাগড় পয়েন্টের কাছেই তখনকার রেডিও পাকিস্তানের সম্প্রচারকেন্দ্র। কেন্দ্রের পাহারায় থকা সশস্ত্র পুলিশ সদস্যরা পাক হানাদারদের হামলার মুখে সম্প্রচারকেন্দ্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁরা যাবেন কোথায়? হাওর পাড়ি দিয়ে তাঁরা আশ্রয় নেন বাঘা গ্রামে। গ্রামটি নিরাপদ। কোনো দিকেই যোগাযোগের কোনো সড়কপথ নেই। এ গ্রামে তখন বসবাস করছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস থেকে সদ্য অবসর নেওয়া হাবিলদার মঈন উদ্দিন চৌধুরী।
এলাকার প্রবাদ পুরুষ ছিলেন তখন আবদুল ফাত্তাহ চৌধুরী, চেরাগ মিয়া নামে যিনি পরিচিত ছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তৎকালীন কর্নেল ওসমানী ছিলেন এ এলাকার প্রার্থী। ওসমানী সাহেবের সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক নানা সম্পর্ক ছিল চেরাগ মিয়ার। চেরাগ মিয়া আওয়ামী লীগের নেতা তখন। মঈন উদ্দিন চৌধুরীসহ গ্রামের মাতবর তৈয়ব আলী, ফরমুজ আলী তখন আওয়ামী লীগের সংগঠক। ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীরা তখন ছাত্র সংগঠক। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নদীর ওপারের গ্রাম রনকেলীর মসুদ আহমেদ চৌধুরী তখন আওয়ামী লীগের এমপি হয়েছেন।
সত্তরের নির্বাচনে বাঘা গ্রামের বটের তল বাজারে আসলেন এম এ জি ওসমানী। সঙ্গে মসুদ চৌধুরী। সেই সভায় এক কিশোর হিসেবে আমার ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়ার প্রথম শিহরণ। আমার সঙ্গে সেদিনের শ্যামল বিশ্বাস, আবুল ফজল চৌধুরী, ফারুক, ফখর, হবিব, নজীর, আজিজদের উপস্থিতির কথা মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান সে সময়ে এমন অজপাড়া গাঁয়ে এভাবেই পৌঁছে যায়!
সিলেট রেডিও সম্প্রচারকেন্দ্র থেকে অস্ত্রসহ পুলিশ দলের প্রাথমিক আশ্রয় হয় মঈন উদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে। বাড়ির সামনের টঙ্গি ঘরে বসে অস্ত্র আর গোলাবারুদ সামাল দিতে লাগলেন তাঁরা। তাঁদের কাছে এক-দুটি স্টেনগান ছাড়া গোটা দশেক রাইফেল ছিল শুধু। সেই প্রথম আমার কোনো অস্ত্রে হাত রাখার প্রথম শিহরণ। বাড়ির পাশে অরণ্যবেষ্টিত মাঠে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মার্চপাস্টে অংশ নেওয়া!
বাঘা গ্রামের এ বীর যোদ্ধাদের নিয়ে কেউ কোনো উচ্ছ্বাস দেখায়নি। তাঁরা নিজেরাও নির্বিকার থেকেছেন। জীবনকে বাজি রেখে সময়ের শ্রেষ্ঠ কাজ করেছেন বলে হয়তো গর্ববোধ করেন।
পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল। শহর থেকে হাজারো মানুষ পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসছিলেন। ভিটেমাটি ছেড়ে অজানার পথে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসার সে দৃশ্য কেবলই অনুমান করা যায়। গ্রামের সম্পন্ন পরিবারগুলোতে এসব মানুষের আশ্রয় দেওয়া হয়। এরই মধ্যে খবর আসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তখনকার সময়ে এলাকার নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য,পরে মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়ক জেনারেল ওসমানী সংবাদ পাঠান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। পুলিশ সদস্যদের উত্তরের পাহাড়ি পথ ধরে ভারতের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মঈন উদ্দিন চৌধুরীকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যুবক-তরুণদের নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার ডাক আসে। খুব গোপনে এসব সিদ্ধান্ত নিতে হয়। পরিবারকেও জানানো যাচ্ছিল না, কোন অজানার পথে জীবন বাজি রাখছেন তাঁরা।
এক পরিবারের চাচাতো, মামাতো ভাইরা যুক্তি করলেন গোপনে। দেশে থাকাও তাদের জন্য তখন নিরাপদ ছিল না। আবদুল ফাত্তাহ চৌধুরীর দুই ছেলে মখসুসুল আলম চৌধুরী, অখসুসুল আলম চৌধুরী তখন নেহাত যুবক। তাঁদের চাচাতো ভাই আবু দাউদ চৌধুরীর ছেলে জোবায়ের চৌধুরী, মঈন উদ্দিন চৌধুরীর চাচাতো ভাই সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী সুফির সঙ্গে যোগ দিলেন বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মঈন উদ্দিন চৌধুরীর বোনের স্বামী কাজী সিরাজুল ইসলাম ও সদ্য স্কুল পেরোনো যুবক কাজী ফারুক।
গ্রামের যুবকদের জড়ো করলেন তাঁরা খুব দ্রুততার সঙ্গে গোপনে। পুরো গ্রাম তখন এক শরণার্থীশিবিরে পরিণত হয়েছে। ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা চৌধুরীরা তখন নেহাত ছাত্রত্ব পেরিয়েছেন। তাঁরা শরণার্থী সামাল দেওয়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। গ্রাম উপচে পড়া নিরাশ্রয় লোকজনকে নিরাপদে সীমান্তের দিকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে নামেন। এর মধ্যে তাঁরা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছেন ভারতে পাড়ি দেওয়া নেতাদের সঙ্গে। দিশেহারা অবস্থায় নির্দেশ চাইছেন। ভৌগোলিকভাবে একদিকে সুরমা নদী, আরেক দিকে হাওরবেষ্টিত বাঘা ইউনিয়নটি হয়ে ওঠে দেশ পালানো শরণার্থীদের প্রথম আশ্রয়স্থল।
এদিকে মঈন উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে বাঘা ইউনিয়নের যুবকেরা যুদ্ধের জন্য ঘর ছাড়েন। এর মধ্যে ছিলেন তোতা মিয়া, উস্তার আলী, নোমান উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, ছমির উদ্দিন, আতাউর রহমান, নুরুল ইসলাম, শফিক উদ্দিন, রবেন্দ্র চন্দ্র, হাবিলদার জুম্মা মিয়া (যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন) প্রমুখ। অসম সাহসিকতার জন্য হাবিলদার জুম্মা মিয়াকে বীর বিক্রম উপাধি দেওয়া হয়েছিল। আরও ছিলেন লেচু মিয়া (যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন), আলতা মিয়া, মোবারক, আবদুল মতিন, আবদুর রহিম, ইনসান আলীরা। এদের কেউ ফিরেছেন। কেউ ফেরেননি।
মুক্তিযুদ্ধের পর ফিরে আসা যোদ্ধারা মঈন উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে অস্ত্র জমা দিয়ে যে যার জীবনসংগ্রামে নেমে যান। কেউ লাঙল ধরেছেন, কেউ হাওর, নদী আর পাহাড়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেশের পতাকার দিকে তাকিয়ে থেকেছেন বিহ্বল অনুভূতি নিয়ে। এসব গ্রাম বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিজনকে নিয়ে গল্প হতে পারে; হতে পারে উপন্যাস। আমাদের উত্তরপ্রজন্ম জানতে পারবে, কী অসম সাহসিকতায় গ্রামের এসব দামাল ছেলেরা নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য।
সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী (সুফি) এলাকার তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। সত্তর সালে যুবক সুফি পুলিশে যোগ দেন। যুদ্ধ শুরু হলে দেরাদুন পুলিশ একাডেমি থেকে পালিয়ে আসেন। চাচাতো ভাই মঈন উদ্দিন চৌধুরীদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে চলে যান মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঘার চৌধুরী বাড়ি হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি। পুরো বাঘা গ্রাম মুক্তিযুদ্ধের গ্রাম হয়ে উঠেছিল। ভৌগোলিক কারণে দিনের বেলা পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে ভারত সীমান্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা বাঘায় যাওয়া আসা করতে পারতেন। রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতায় গ্রাম সরগরম হয়ে উঠত।
নানা এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য লোকজন বাঘায় এসে আশ্রয় নিতেন। তাদের পরে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হতো এ গ্রাম থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকার প্রভাবশালী জমিদার আবদুল ফাত্তাহ চৌধুরী ভারতে যাননি। তিনি ও গ্রামের প্রভাবশালী মাতবর তৈয়ব আলী, ফরমুজ আলী তখন এসব লোকজনকে রাতের আঁধারে ভারতে পাঠানোর আয়োজন করতেন। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। দেশের অভ্যন্তরের যোগাযোগের অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিল বাঘা। বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্ব তখন আমাদের।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মঈন উদ্দিন চৌধুরী তাঁর চাচাতো ভাই সুফিকে পাঠান গেরিলা যুদ্ধের জন্য নতুন যুবকদের সংগ্রহের জন্য। সুফি গ্রামে এসে তাঁর ফুটবল খেলার সাথি জলিল উদ্দিন ও ফারুক উদ্দিনকে নিয়ে ভারতের উদ্দোশ্যে রওনা দেন। গোলাপগঞ্জের পূর্ব দিকে ‘আমনিয়া’ নামক এলাকায় পৌঁছালে ভোর হয়ে যায়। সারা রাতের নির্ঘুম সুফি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দিনের বেলায় ঘুমাচ্ছিলেন এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে। সেখানেই রাজাকারদের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সুফি। তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজীর হাতে লেখা চিঠি ছিল। চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহের নানা বিষয়ের নির্দেশনা ছিল বলে পরে জানা গেছে।
মায়ের একমাত্র ছেলে ছিলেন সুফি। গ্রেপ্তারের পর সিলেট ক্যাডেট কলেজ এলাকায় তাঁকে বন্দী করে রাখা হয় বেশ কিছুদিন। জলিল আর ফারুককে নির্যাতন করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা প্রাণে বেঁচে গেলেও সুফি আর ফেরত আসেননি।
দেশ স্বাধীন হলে একে একে চাচাতো-মামাতো মিলিয়ে ১২ ভাই দেশে ফিরে আসেন সহযোদ্ধাদের নিয়ে। ফিরে আসেননি সুফি। সুফির মায়ের আর্ত কান্নার মধ্যেই সেদিন বাড়ির সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন মঈন উদ্দিন চৌধুরী। বলেছিলেন, ‘ভাই হারিয়ে আমরা পতাকা পেয়েছি!’ অন্য ভাইদের চোখও সেদিন ভিজে উঠেছিল!
সুফির মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই নীরব থেকেছিলেন। সুফিকে পাকিস্তানি বাহিনী মেরে ফেলে। পাওয়া যায়নি তাঁর মৃত দেহ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিলেট ক্যাডেট কলেজ এলাকায় হাড়ের স্তূপের মধ্যেও খোঁজ করা হয়েছে সুফির অস্তিত্ব। সুফির মা স্বাধীনতার পর আরও ৩৭ বছর বেঁচেছিলেন। ছেলের জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতেন এ সন্তানহারা মা। বয়ে যাওয়া অশ্রুধারা তাঁর গালে স্পষ্ট রেখার সৃষ্টি করেছিল।
নব্বই পেরোনো মুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দিন চৌধুরী এখন জীবনের শেষ প্রান্তে। মুক্তিযুদ্ধের একজন ট্রেইনার ছিলেন মঈন উদ্দিন চৌধুরী। ক্যাম্পে অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠিয়েছিলেন। সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্তের কাছের মানুষ ছিলেন মঈন উদ্দিন চৌধুরী। ট্রেনিং নেওয়া যোদ্ধারা কেউ ফিরেছে, কেউ ফেরেনি। কারও হাড় আজও হয়তো টোকা দেয় বাংলার কোনো কৃষকের লাঙলের ফলায়।
যে ঘর থেকে বেরিয়ে যৌবনে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, সেখানেই শয্যাশায়ী হয়ে জানালা দিয়ে চেয়ে থাকেন মঈন উদ্দিন চৌধুরী। নিজের বাড়ির সামনে যে খুঁটিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, সে জায়গাটি আর হেঁটে দেখতে পারেন না। যুদ্ধ জয়ের পর বাড়ির গাছগুলোতে রাজাকারদের বেঁধে রেখেছিলেন। সময়ের ফাঁকে সে গাছগুলোর গোড়া কতটা দুর্বল হয়েছে এ নিয়ে ভাবেন। যে ভাইদের নিয়ে যুদ্ধ গিয়েছিলেন, তাদের কথা স্মরণ করেন মঈন উদ্দিন চৌধুরী। জানালেন, স্বাধীনতার পর নিজে কিছু চাননি দেশের কাছ থেকে। যে ভাইদের নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাদের একজনও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সুবিধা গ্রহণ করেননি।
কিছুদিন আগে সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্তের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হলে দীর্ঘক্ষণ নীরব থাকেন অশীতিপর মঈন উদ্দিন চৌধুরী। সি আর দত্ত মুক্তিযুদ্ধের পর জানতে চেয়েছিলেন, ‘কোনো কিছু চাওয়ার আছে?’ মঈন উদ্দিন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘যা চাওয়ার, তা তো পেয়ে গেছি। আমরা দেশটা স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। তা হয়ে গেছে!’
দেশ স্বাধীন করে তৃপ্তির কথা বলেছিলেন মঈন উদ্দিন চৌধুরী। নিজের জন্য কিছু চাওয়ার ছিল না তাঁর। জানালেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর চেরাগ মিয়া, তৈয়ব আলী, ফরমুজ আলীর মতো লোকজনও স্বদেশের মুক্তির জন্য নিজেদের জীবন বাজি রাখার বিনিময়ে কোনো দাবি নিয়ে কারও কাছে যাননি। কেউ কোনো আনুষ্ঠানিক শ্রদ্ধা জানাতেও কোনো দিন ডাকেনি তাঁদের।’
তবে এখনো চাচাতো ভাই সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী (সুফি) কথা উঠলেই নীরব হয়ে যান মঈন উদ্দিন চৌধুরী। ভেজা কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়ে থমকে যান বারবার; বলতে পারেন না।
বাঘা গ্রামের এ বীর যোদ্ধাদের নিয়ে কেউ কোনো উচ্ছ্বাস দেখায়নি। তাঁরা নিজেরাও নির্বিকার থেকেছেন। জীবনকে বাজি রেখে সময়ের শ্রেষ্ঠ কাজ করেছেন বলে হয়তো গর্ববোধ করেন। সায়েফ উদ্দিন চৌধুরীর জন্য তাঁর যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী নিকটাত্মীয়রা একটি স্মৃতি তোরণ করেছেন। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেশে এমন উদ্যোগ আর নেওয়া হয়নি। মঈন উদ্দিন চৌধুরী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কামনা করেন, বাংলাদেশ যেন তার বীর সন্তানদের কখনো ভুলে না যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পথ থেকে দেশটা যেন সটকে না পড়ে—এটুকুই তাঁর চাওয়া।