
এক সময়ে ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রচলন ছিল না। ছিল না ডিজিটাল পৃথিবী। তখন বই, রেকর্ড ও ক্যাসেট ছিল মানুষের বিনোদনের মাধ্যম। এমন এক সময়ে নিউইয়র্কে এসে বসবাস শুরু করলাম। বাংলা বইয়ের দোকান খুঁজে পেতে জ্যাকসন হাইটসে হানা দিয়ে পেলাম সৈয়দ শহীদ ভাইকে। ঢাকার স্টেডিয়াম পাড়ার ম্যারিয়েটায় শহীদ ভাই আর শৈশব বন্ধু কবি ও নাট্যকার ইরাজ আহমেদের সঙ্গে কদাচিৎ আড্ডা মেরেছি বলে মনে পড়ে। কিন্তু শহীদ ভাইয়ের অন্য পরিচয় অনন্যা দিয়ে। আশির দশকের ঢাকার সাপ্তাহিক অনন্যা পত্রিকার শহীদ ভাই নিউইয়র্কে এসেও অনন্যাকে ছাড়তে পারেননি। আজকের ২৪ ঘণ্টার আলোকিত জ্যাকসন হাইটসের ব্যস্ত তিয়াত্তর স্ট্রিটের এক বেসমেন্টে রুচিশীল বইয়ের দোকান অনন্যা ছিল তখনকার নিউইয়র্কের বাঙালির একমাত্র বইয়ের দোকান। যখনকার কথা বলছিলাম সেটা বলা হয়নি, আমি এই শহরে পা রাখি ১৯৯৬ সালে। সেই সময়ের স্মৃতি মুছে ফেলে মুক্তধারার কথা সরাসরি বললে সেটা হবে খণ্ডিত। অনন্যার সৈয়দ শহীদের আগেই আর যারা সৃজনশীল এই ব্যবসা অর্থাৎ বইয়ের ব্যবসায় এসেছেন তার মধ্যে তখনকার তরুণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী বিশ্বজিৎ সাহা অন্যতম।

বিশ্বজিৎ অনেকটা বিস্ময়কর ঘটনার জন্ম দিয়ে তার উডসাইডের বাসার ড্রয়িং রুম থেকে ১৯৯১ সালে যাত্রা শুরু করে মুক্তধারা নামের প্রতিষ্ঠানটিকে বিশ্বময় পরিচিত এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। মুক্তধারা এখন শুধুমাত্র একটি বইয়ের বা সিডি-ডিভিডির দোকান নয়। এটি এখন দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত একটি নামে পরিণত হয়েছে। বইয়ের দোকান বললে কেউ কখনো অন্য কিছু ভাবেন না। কিন্তু যখন সিডির দোকান বলা হয় তখন কেউ কেউ বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় অনেকে বইয়ের চেয়ে সিডি বা ডিভিডিকে বেশি গুরুত্ব দেন। কারণ এটি আরও বেশি ডিজিটালাইজড। একদিন বাংলা ভাষার বই যখন কাগজের কপি থেকে সিডি কপি বেশি বিক্রি হবে তখনো কি কোনো প্রতিষ্ঠানকে বইয়ের দোকান না বলে সিডির দোকান বললে কেউ কি বিব্রত হবেন? নাকি ক্ষুব্ধ হবেন। কারণ আজকে শুধু বইয়ের দোকান হিসেবে পরিচিত মুক্তধারার মাধ্যমেই প্রবাসে আমরা এক সময়ে বাংলা সিনেমা ও নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছি। বই বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে মুক্তধারা ভিডিও ক্যাসেটে বাংলা সিনেমা ও নাটকের কপি বিক্রি করে অথবা ভাড়া দিয়ে আমাদের সংস্কৃতির এই বিরাট বিষয়টিকে প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছে উত্তর আমেরিকায়।

মুক্তধারা এখন একটি এমন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে যে, এর কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে লিখলে বা কথা বললে অনেকেই না বুঝে আগ বাড়িয়ে তার বিরোধিতা করেন। এরা কেন তা করেন জানি না। কিন্তু যারা মুক্তধারার সমালোচনা করেন তারাই কিন্তু মুক্তধারার প্রচারও করেন ও সত্যিকার সুহৃদ হিসেবে এর মঙ্গলও কামনা করেন। আর তাদের প্রচারেই কিন্তু আজ মুক্তধারাকে মানুষ চিনে এত বেশি করে। কিন্তু সমালোচনার বিরোধিতাকারীরা মুক্তধারার আলোতে নিজেদের আলোকিতই করেন শুধু।
মুক্তধারা নিয়ে লিখতে চাইনি, কারণ লিখতে গেলে সমালোচনা বা ত্রুটি-বিচ্যুতির কথাও লিখতে হবে। আর তা নিয়ে মাছের মায়েদের কান্নাও শুনতে হবে। কিন্তু বন্ধুপ্রতিম বিশ্বজিতের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারের কিবোর্ডে চাপ দিতেই হলো।
পরিচ্ছন্ন ব্যবসার পাশাপাশি মুক্তধারা নিউইয়র্কসহ আমেরিকায় বাংলা সংস্কৃতি প্রচারে যে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে তা প্রশংসনীয়। এর পাশাপাশি ১৯৯২ সাল থেকে বাঙালির চেতনা মঞ্চকে সঙ্গে নিয়ে জাতিসংঘের সামনে একুশে উদ্যাপনের রীতি চালু ও চেতনা মঞ্চকে নিয়ে একুশের বইমেলার আয়োজন করে যাচ্ছিল। এখন আর বইয়ের দোকান মুক্তধারা নয়, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন নামে অন্য সংগঠন এই কাজগুলো করে। কিন্তু সবগুলো সংগঠনের নেপথ্যে রয়েছেন অসীম ধৈর্যের অধিকারী বিশ্বজিৎ। আজকে মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে মুক্তধারার চেয়ে আমি এর কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহাকেই বেশি ধন্যবাদ দেব এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে জন্ম দিয়ে যুগ যুগ ধরে লালন করে যাওয়ার জন্য।

মুক্তধারার রজতজয়ন্তী উপলক্ষে নিউইয়র্কে র্যালি
কোনো রাখ ঢাক রাখলেন না কেউই। বড় মানুষগুলো অনেক বড় করে তুলে ধরলেন মুক্তধারা আর এর কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহাকে। অকৃপণ গুনগানে উঠে আসল নানা প্রসঙ্গ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বাংলা সাহিত্য আর সংস্কৃতিতে এই প্রবাসে বাঁচিয়ে রাখার ২৫ বছরের ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানালেন মুক্তধারার রজত জয়ন্তীতে উপস্থিত বাংলাদেশ আর প্রবাসের বিশিষ্টজনরা। তারা বললেন, ২৫ বছর মানুষের হাতে বাংলা বই তুলে দিয়েছেন বিশ্বজিৎ। তিনি তো আসলে বই তুলে দেননি। তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। প্রবাসে জন্ম নেওয়া আমাদের সন্তানরা জানতে পারছে তাদের শেকড় সম্পর্কে। এই কাজটি মোটেও সহজ সাধ্য ছিল না। অনেক নিন্দা-মন্দ হাসিমুখে সইতে হয়েছে তাকে। তারপরও পরম মমতায় আঁকড়ে রেখেছেন বাংলা বই। বিশেষত উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক, সিনেমা আর গান। আর ফি বছর এগুলোর পসরা সাজিয়ে দেশ-বিদেশ আর বুড়ো তরুণদের এক কাতারে দাঁড় করিয়েছেন বই মেলার আয়োজন করে।
শুধু মঞ্চে নয়, মুক্তধারার রজত জয়ন্তীতে পরম ভালোবাসায় স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের এ সময়ের জনপ্রিয় লেখক সাংবাদিক আনিসুল হক। তিনি প্রথম আলোতে বিশেষ কলাম লিখেছেন। রজত জয়ন্তীকে স্মরণীয় করে রাখতে ২৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য এক অনুষ্ঠানের।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটায় জ্যাকসন হাইটস থেকে বের করা হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রা উপলক্ষে বিকেল থেকেই সেখানে জড়ো হতে থাকেন প্রবাসী কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সংগঠক, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিসেবী, সাংবাদিকসহ বহু সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি। তাদের হাতে শোভা পায় নানা রং আর বর্ণের ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন। এ সময় অংশগ্রহণকারীদের কথা, কবিতা আর গানে সরব হয়ে ওঠে ওই এলাকার পরিবেশ। প্রখ্যাত অভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেন, অভিনেত্রী রওশন আরা হোসেন, লুৎফুন্নাহার লতা, মুক্তিযোদ্ধা ও বিজ্ঞানী ড. নুরন নবীসহ খ্যাতিমানরা যোগ দেন শোভাযাত্রায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসিও এসে যোগ দেন সবার সঙ্গে। এ সময় তিনি তার সংক্ষিপ্ত অনুভূতিও ব্যক্ত করেন।
সন্ধ্যা পৌনে আটটায় মূল রজত জয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় জ্যাকসন হাইটসের পিএস ৬৯-এর অডিটোরিয়ামে। সেখানে আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাংবাদিক আবেদ খান, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, বিজ্ঞানী ড. খন্দকার মনসুর, বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরন নবী, কবি ও সাংবাদিক শিহাব সরকার, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান, ড. শাহাদত হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা ও চিকিৎসক ডা. জিয়াউদ্দিন, অভিনেতা জামাল উদ্দিন হোসেন।
তারা উত্তর আমেরিকায় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অসামান্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখায় মুক্তধারা ও এর প্রধান নির্বাহী বিশ্বজিৎ সাহার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তারা বলেন, আজ থেকে ২৪ বছর আগে তরুণ বয়সে বিশ্বজিৎ জীবিকার খোঁজে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করার জন্য তিনি অন্য যে কোনো পেশা বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। হাতে তুলে নিয়েছেন বই। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বাঙালিরা যখন বই থেকে অনেক দুরে তখন তাদের কাছে তিনি বই ফেরি করছেন। চ্যালেঞ্জিং এ কাজটি তিনি একাই করে যাচ্ছেন। অনেক বাধা, নিন্দুকের নিন্দা, মন্দ লোকের কুৎসা, হাজারো প্রতিকূলতা নীরবে সয়ে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের বাংলা ভাষা, বাংলা বই, বাংলা গান, নাটক-সিনেমাকে।
আলোচনা পর্বের শেষের দিকে অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী।
পরে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সংগীত পরিবেশন করেন প্রবাসে তিন যুগ ধরে অতি পরিচিত মুখ ও মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম, এ প্রজম্মের জনপ্রিয় গায়ক শাহ মাহবুব, এটিএন তারকা ও নিউইয়র্ক শিল্পকলা একাডেমির সংগীত শিক্ষক রেজওয়ান প্রমুখ।
এর আগে প্রবাসে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখার জন্য মুক্তধারার প্রধান নির্বাহী বিশ্বজিৎ সাহার হাতে নিউইয়র্কের স্টেট সিনেটর মাইকেল জেনারিশের প্রোক্লেমেশন সার্টিফিকেট তুলে দেন তার ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মিস আইরিন।
২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে পূর্ব পশ্চিম নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলাদেশ ও প্রবাসের ৮০ জন খ্যাতিমান ব্যক্তির লেখা প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা প্রকাশিত হয়।