মিষ্টি ভাবি

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মেরিন ড্রাইভ রোড। এখান থেকে দেখা যায় নীল সাগরের অনন্য রূপ। একাডেমিক কাজের ফাঁকে প্রতিদিনের মতো সেদিনও একাকী দাঁড়িয়ে আছি। ম্যাপলগাছের সারি, ঝরা পাতা আর উত্তাল সাগরের ঢেউ দেখছি। ক্যাম্পাসের দুই দিকে সাগর। আর দুই দিকে গহিন অরণ্য। মন ভোলানো এক ক্যাম্পাস। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে আছে পড়ালেখার কথা। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামে লেখা ‘এ প্লেস অব মাইন্ড’। আমি এর বাংলা করেছি ‘মনের জানালা’।
পৃথিবীর ১৪৯টি দেশের সুন্দর সব ছেলেমেয়ের পদচারণে যেন ‘আবে হায়াত’ শরাব পান করেছে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া। আর সেই স্বর্গীয় শরাবে মাদকতা বাড়িয়েছে পর্যটকের কোলাহল। এ যেন মানুষের হাতে গড়া এক ‘জান্নাতুল ফেরদৌস।’ সেদিন মনের সুখে কখন যেন গুন গুন করে শুরু করেছিলাম বাংলা গানের কলি।
এমন সময় একটা গাড়ি থেকে নামলেন টাইট জিনস আর গোলাপি রঙের ফতুয়া পরা এক সুন্দরী ভদ্রমহিলা। হতে পারে ভারতীয় বা ইরানি। কে জানে। সুন্দরী ওই নারী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সাগরপানে। হালকা মেকআপ আর ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক। সেই সঙ্গে রবির আলো তাঁকে করেছে অপরূপ, যেন এক প্রেমের কবিতা। গলায় সোনালি লকেট ঝিকঝিক করছে, আর সানগ্লাসটা যেন লুকোতে চাইছে তাঁর মায়াবী চোখ দুটোকে।
এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘গান বন্ধ করলেন কেন? ভালোই তো লাগছিল এই সাগরপাড়ে।’ আমি বিস্মিত। লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘হায় হায়, আপনি তাহলে বাংলাদেশি?’ তিনি আমাকে আবার অনুরোধ করলেন গানটা গাইবার জন্য। আমি হেসে বললাম, ‘আমি তো গান পারি না। এমনি একটু গুন গুন করছিলাম। তার চেয়ে আপনার কথা বলুন, কত দিন আপনি কানাডাতে আছেন, আর কী করছেন এখানে।’ তারপর আমি বিনয়ের সুরে বললাম, ‘আমি কি আপনাকে ভাবি বলে সম্বোধন করতে পারি।’
সুন্দরী নারী বললেন, ‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু আপনাকে আমি আবারও গানটা গাইবার জন্য অনুরোধ করছি। আপনি যদি গানটা গান তাহলে আমি আপনাকে এখনই বাংলাদেশি একটা খাবার খাওয়াব। আশা করছি আপনার খুবই ভালো লাগবে।’
আমি বললাম, ‘খাবার লাগবে না, আমি আপনাকে গানটা শোনাব। আপনি আমার দেশের মানুষ, দেশের মেয়ে। তবে আপনি কিন্তু হাসতে পারবেন না। তাহলে এমনিতেই গান বন্ধ হয়ে যাবে।’ আমি দুই চোখ বন্ধ করে বেসুরো গলায় গান ধরলাম, ‘আমি তোমারি প্রেম ভিখারি...বুকেরও ভিতরে আন্ধারো কুটিরে তুমি ওগো চান্দেরো বাতি...ভালোবেসে ঠাঁই দিয়ো পরানে গো...’।
অট্টহাসিতে আমার গান থেমে গেল। চোখ খুলতেই দেখি আমার সামনে এক প্যাকেট হরেক রকমের বাংলাদেশি মিষ্টি। আমি তাঁকে বললাম, ‘ভাবি, আপনি মিষ্টি কোথায় পেলেন? কত দিন যে আলিবাবা আর প্রিমিয়ামের মিষ্টি খাই না! এসব রসগোল্লা, চমচম আর কালোজাম আপনি বানিয়েছেন? তাঁর হাতে বানানো একটা রসগোল্লা খেলাম। এক কথায় অসাধারণ। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি খাবেন না?’
সুন্দরী নারী বললেন, ‘তাহলে তো আমার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবে। আমি সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে আনন্দ পাই, তাই সবাই আমাকে “মিষ্টি ভাবি” বলে ডাকে।’
তিনি আমাকে আরও জানালেন, আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রিয় বাংলাদেশ ছেড়ে মা-বাবার হাত ধরে এসেছিলেন এ দেশে। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো থেকে এমবিএ করেছেন। খুব ভালো আছেন। তিনি এখন ১৮টা ফ্ল্যাটের মালিক। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি তাহলে ১৮টা ফ্ল্যাটের মালিক!’
আমি আরও বললাম, ভাবি কানাডাতে ফ্ল্যাটের দাম কেমন? তিনি জানালেন, এটা তো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। তবে তাঁর ফ্ল্যাটের দাম বাংলাদেশি টাকায় তিন থেকে চার কোটি। তাঁকে আমি আমার পরিচয় দিলাম। তিনি জেনে খুব খুশি হলেন। আমি বললাম, ‘আপনার এই সফলতার কথা আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে বলব। আপনার কাছে আমার অনেক কিছু জানার আছে।’ তিনি বললেন, ‘আর কী কী জানতে চান?’
এমন সময় ভাবির আইফোন বেজে উঠল। আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে তিনি ফোন ধরলেন। কিছুক্ষণ কথা বলে জানালেন, তখনই তাঁকে যেতে হবে। একটা ফ্ল্যাটে একটা নতুন এসি লাগাতে হবে। ভাবি তাঁর গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে যেতে বললেন। আমি বললাম, ‘ভাবি, আপনার মিষ্টি খাওয়ার জন্য অবশ্যই আপনার বাড়ি যাব।’
মিষ্টি ভাবি হেসে হেসে গাড়ি থেকে নামলেন। মিষ্টির প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভাবির মিষ্টি না, ভাবির হাতে বানানো মিষ্টি।’ কথার মাঝে কোথায় যেন একটা রহস্য রেখে তাঁর গাড়ি সাগর ঘেঁষা মেরিন ড্রাইভ দিয়ে সামনে ছুটে গেল। আর পেছনে পড়ে রইল আমার না জানা কথাগুলো। নাম, ঠিকানা কিছুই তো রাখা হয়নি ‘মিষ্টি ভাবির’ কাছ থেকে।
রুহুল খান
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়া, ভ্যানকুভার, কানাডা