মিলির জীবনের মর্মান্তিক চিত্রনাট্য

২০১৭ তে মিলির বয়সটা কত হতো। একুশ। বেঁচে থাকলে লাল টুকটুকে শাড়িতে কি রকম দেখাত তাকে। লাল রংটা মিলির পছন্দের রং ছিল। লাল চুড়ি, লাল জামা, লাল লিপিস্টিকের প্রতি তার দুর্বলতা ছিল প্রচণ্ড রকমের। ঈদ আসলেই বায়না ধরত লাল জামার। মোরগ ডাকা সকালে ঘুমকাতুরে কণ্ঠে বলত, আব্বু আমার লাল জামা চাই, চাই-ই।
মক্কারো বলি খেলা (মেলার নাম) শুরু হলেই নাকি স্বরে বলত, মুচড় চড়ির (স্থানীয় খাবার) সঙ্গে লাল চুড়ি এনে না দিলে আমি ভাত খাব না। সঙ্গে লাল ফিতাও আনতে হবে। বলে দিলাম কিন্তু!
আচ্ছা মৃত মানুষেরা কি ফিরে আসতে পারে। তবে আমার কেন জানি মনে হয় মৃত মানুষেরাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা তা অনুধাবন করতে পারি না। তারা হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু কি? সেটাই বিস্ময়। মৃত্যুর পর হয়তো ফিজিকসের কোনো একটা লেয়ারে অবস্থান করে তারা। আমাদের দেখে। আমরা দেখি না। অথবা এই ভাবনাটা হয়তো আমার হেলোসিনেশন শুধু।
আমার ছোটবেলার কথা। ছোট্ট ফুটফুটে মিলি সবেমাত্র হাঁটতে শুরু করেছে। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। কখনো বাবার বড় বড় স্যান্ডেলে ছোট পা দুটি ঢুকিয়ে দিয়ে সপাৎ সপাৎ করে হেঁটে, কখনো সারা রান্নাঘর জুড়ে জগের পানি ভাসিয়ে দিয়ে, নতুবা ভাইবোনদের সঙ্গে দুষ্টুমি দিয়ে। পরিবারের প্রথম সন্তান হিসেবে সে ছিল সবার মধ্যমণি।
তারপর আরেকটু বড় হয়ে মেয়েটি কী কিউট করেই না কথা বলত।
মিশু ভাইয়া, দাঁত পড়ে গেলে ইন্দুলেল (ইঁদুর) গলতে (গর্তে) ফেলতে হবে, এ লকম (রকম) না হলে দাঁত উতবেনা (উঠবে না)।
আল্লাহ আতিক ভাইয়া তলমুজের (তরমুজ) বিচি খেয়ে ফেলছে, পেটে তলমুজ গাছ উথবে (উঠবে)। কিংবা জমির ভাইয়া দেখ না আমার জল (জ্বর) হইছে, আজকে পড়তে বসতে হবে না! কী মজা কী মজা।
এই ভাইয়া সেই ভাইয়ার সঙ্গে ফোকলা দাঁতে এ রকম টুক টুক করে মজার মজার কথা বলতে থাকত। এমন আধো আধো বোলের বাচ্চাদের কার না ভালো লাগে। তারপর মিলি আরও বড় হলো। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মিলির প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই একটা সহাবস্থান ছিল। আসলে নারী আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হওয়া সুযোগ এই বয়সেই মেলে। গ্রামে এর চেয়ে বেশি বয়স হলে বাড়ির দেউড়ি (দেয়াল) মাড়ানোটা সমাজের চোখে অন্যায়। সমাজ একটা অদৃশ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েদের এটা করা বারণ, ওটা করা ঠিক নয়...এই প্রকার হাজারো নিষেধের দেয়াল। এইভাবে গ্রামের এই বয়সী মেয়েরা ধীরে ধীরে রক্ষণশীলতার ছবক নেয়।
এত কিছুর পরও মিলির দুরন্তপনাটা ছিল খুব। কখনো চিলেকোঠায় পুতুল খেলায় কনে সাজিয়ে বিয়ে দিচ্ছে। কখনো বড় পুকুর পাড়ে বড়শি নিয়ে তিতপুটি ধরায় ব্যস্ত, আবার কখনো মধ্যাহ্ন রোদের দুর্দান্ততা ভেঙে নাটাই হাতে ঘুড়ি উড়ানো। ঝড়ের দিনে ঝড় শুরু হলে প্রহর গুনত কখন ঝড় থামবে। ঝড় থামলেই যে আম কুড়াতে যেতে হবে। কখনো কখনো সোনা রাঙা বিকেলের কোল জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো।

এই দুরন্তপনার কারণে মিলির মা মাঝে মাঝে বকাবকি করতেন। বাবা বাড়িতে এলেই মিলির অসংখ্য নালিশ শুধু মায়ের বিরুদ্ধে। মায়ের বকাঝকায় মেয়েটা মুখ ফুলিয়ে বসে থাকত। মেয়েটা অনেক অভিমানী টাইপের তা তিনি খুব ভালো জানতেন। এরপরও কোনো মায়ের অস্বীকার করতে পারার মতো কোনো জো নেই, আমাদের সমাজে ছোট হোক কিংবা বড়, প্রত্যেকটা মেয়েই প্রচণ্ড আশ্রয়হীনতায় ভোগে। এই আশ্রয়হীনতার কথা ভেবেই মাকে একটু কঠোর ভাব নিতেই হয়।
এইভাবেই চলে যাচ্ছিল মিলির দিন। দুষ্টুমি, আদর, শাসন, ভালোবাসায় ভরপুর মিলির ছেলেমানুষি রঙের ডানপিটে শৈশব! বৃষ্টিটা তার খুব পছন্দের ছিল। আচমকা কালো এক রাতে মিলি ডাকাতের গুলি থেকে প্রিয় বাবাকে বাঁচাতে গিয়েই নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ডাকাত দল কোমলমতি দেহটাকে কি পৈশাচিক ভাবেই না ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। হায়েনারা কিশোরী মিলির জীবনের চিত্রনাট্য কি মর্মান্তিক ভাবেই না লিখে দিয়েছে। তাও আবার পৃথিবীর সবচেয়ে ভরসাস্থল বাবার কোলেই।
সেদিনও ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্তে তার প্রিয় বৃষ্টির পানির রংও লাল হয়ে গিয়েছিল। গোটা সমাজ কি নির্লিপ্তভাবে চেয়ে চেয়ে দেখেছে অবলা একটি মেয়ের মমতাময়ী মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আকুতি। সন্তানকে বাঁচানোর জন্য অসহায় বাবার দুনিয়া কাঁপানো আকুতি।
মিলি কার কাছে নাকি শুনেছিল, সন্ধ্যার পথ ধরে অন্ধকার নামলেই বড় পুকুরের পাড়ে কিলবিল করে পা থেকে মাথা জুড়ে শত চোখওয়ালা ভূত! তারপর থেকে জিন-ভূতের প্রতি মিলির ছিল বড্ড ভয়। মাগরিব হলেই সে হয়ে যেত মায়ের আঁচলের নিচে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ছোট্ট বাবুনি। অথচ কলিজার টুকরা তাকে সবাই মাটির নিচে রেখে এসেছিল একা একাই, তাও সেই বড় পুকুর পাড়ের কবরস্থানে।
সেদিন তার বাবারও গুলি লেগেছিল। গুলিটা তার বুকে লাগেনি। পায়ে গুলিটা লেগেছিল। ওই জায়গার চেয়ে বেশি ব্যথা লেগেছিল বুকের বাম পাঁজরে। বাবার পায়ের ব্যথা সে কবেই সেরে গেছে তা মনে নেই। এত বছর পরও হঠাৎ হঠাৎ আচমকা চিনচিনে ব্যথা করে ওঠে বুকে। এর একমাত্র কারণ তার কলিজার টুকরোটাকেই যে মাটিচাপা দিয়ে আসতে হয়েছে নিজ হাতে।
সন্তান হত্যার বিচার পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে করতে মিলির বাবা আজ ন্যুব্জ প্রায়। বিচারহীনতার এই দেশে সুবিচার পাওয়াটা যে বিলাসিতা তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেছেন। উনি জানেন এখনো বিচারের বাণী দেয়ালে মাথা ঠুকে কাঁদে। এরপরও মেয়ে হত্যার বিচারের পাওয়ার জন্য তার চেষ্টাটা বিরামহীন।
মিলিদের বাড়িতে একটি ঘরে দেয়ালের একপাশে টম অ্যান্ড জেরির ছবিওয়ালা মিলির স্কুলব্যাগটা এখনো লটকানো আছে। এটা দেখলেই মিলির বাবার মনে পড়ে মিলিকে কাঁধে চেপে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার প্রথম সকাল। লাল পেনসিল কিনে দেওয়ার প্রথম বায়না। মাঝে মধ্যে তিনি ব্যাগটার ওপর হাত বোলান। বুকের বাম পাশের বোবা ব্যথাগুলো বুকের মাঝেই হইচই করে থিতিয়ে উঠে।
মিলির বাবার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অসহায় বাবা মনে হয়। চোখ ভেঙে কিছু একটা বেরিয়ে আসতে চায়। চোখের নোনতা পঙ্ক্তিগুলোকে চোখের মাঝেই আড়াল করে ফেলতে চাইলেও ব্যর্থ হতে থাকে। অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন। খুব মন খারাপ হয় যখন মনে পড়ে আমরা কিংবা আমাদের সমাজ মিলি হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে পারিনি। অথচ খুনিরা এই সমাজের গলি ঘুপচিতেই মুখোশ পরে লুকিয়ে আছে।
এরপরও আমি নৈরাশ্যবাদীদের পক্ষে নই। আমি আশাবাদী। আমাদের মনে রাখতে হবে, অবশ্যই কেউ একজন আছেন, যার কাছে কিনা সবকিছুর পাই টু পাই হিসাব থাকে এবং আখেরাতে তো অবশ্যই ধরবেন। মাঝেমধ্যে তিনি দুনিয়ার কাজের ফল দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। মজার ব্যাপার হলো খুনি ও ভালো মানুষগুলো দেখতে অবিকল একই রকম হলেও নরহত্যাকারীদের সময় মতো সবাই চিনে ফেলে। মিলি ভালো থাকুক স্বর্গের শ্বেতকাঞ্চন ফুল হয়ে!
এক অন্ধকারকে গিলে খাচ্ছে আরেক অন্ধকার। আলো এখানে এক কনসেপ্ট মাত্র। যা বলা যায়, বোঝানো যায়, শেখানোও যায়। কিন্তু এনে দেওয়া যায় না। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষ এক অর্থে গিনিপিগ। আর বাকি যা কিছু সবই সিস্টেম। এ রকম আরেকটি কৈশোরও যাতে অকালে শেষ হয়ে না যায়। একজন প্রাণবন্ত কিশোরী মিলিকে নিরাপদ একটি সমাজ উপহার না দিতে পারার ব্যর্থতার দায়ে আসুন আমরা সবাই মিলে আরেকবার লজ্জিত হই।