মিটসেফ

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

মিটসেফ। কাঠের তৈরি এক শেলফ। ঠিক শেলফও না, কারণ তারজালির ফ্রেমে আবদ্ধ দুই পাল্লার এক দরজাও থাকত। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পাকঘরের অতি প্রয়োজনীয় আসবাব (কিচেন রুম আর পাকঘর কিন্তু এক নয়, দুস্তর ব্যবধান)। নামটা অবশ্য ভুল। কোরবানির ঈদের কিছুদিন ছাড়া আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সংসারে মিট মানে মাংস খুব কমই থাকত মিটসেফে।
তাহলে কি থাকত আমাদের মিটসেফে? দশজনের সংসার। হিসাব করা আয়। ফ্রিজ নামক বস্তুর কথা শুনেছি, দেখেছিও, ব্যস ওই পর্যন্তই। তাই মাছের টুকরা কয়েকটা বেশি হলে অল্প হলুদ-মরিচ-লবণ দিয়ে সেদ্ধ করে রাখা হতো মিটসেফে পরদিনের জন্য। ভাই-বোনদের কারও না কারও এসএসসি অথবা এইচএসসি পরীক্ষা। সীমিত সামর্থ্যের মাঝেও তাদের জন্য বরাদ্দ থাকত এক গ্লাস দুধ। সেই দুধের ঠিকানাও ছিল মিটসেফ। হঠাৎ হঠাৎ সেমাই পায়েসও থাকত। আর একটা খাদ্যের কথা বিশেষভাবেই মনে পড়ে। খাঁটি বরিশালের ভাষায় হোতলানো চিংড়ি মাছ। অল্প হলুদ-মরিচ-লবণ দিয়ে আধাসেদ্ধ চিংড়ি মাছ। আমাদের বাসায় যা নিয়মিত থাকত। কখনো কখনো তিন-চার দিন পর্যন্ত থাকত। প্রতিদিন অন্তত একবার জ্বাল দেওয়া হতো। তারপর হঠাৎ এক শুভ সকালে মা কিংবা বড় আপা পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে সেই তিন-চার দিনের পুরোনো হোতলানো চিংড়ি মাছ ভর্তা করত। পান্তা ভাত দিয়ে সেই চিংড়ি ভর্তা, আহ …অমৃত।
মিটসেফ নিয়ে তিক্ত স্মৃতিও আছে। কোনো কারণে সেদিন বাসায় অনেক বাজার হয়েছে। মিটসেফ ভর্তি কয়েক রকমের মাছ, সামান্য মাংস। দুধের পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে সবে সরটুকু হাতে নিয়েছি এই সময়েই পায়ের আওয়াজ পেলাম। কোনোমতে ঢাকনা বদ্ধ করেই দৌড়। ঘণ্টাখানেক পরে পাকঘরে মায়ের চিৎকার শুনে আবার দৌড়ে গেলাম। তাড়াহুড়ায় মিটসেফের দরজা বন্ধ করি নাই। এই সুযোগে আমার চাইতেও বড় ছোঁচা বিড়াল কাজ সাবাড় করেছে। দশজনের প্রতিবেলার খাবার নিয়ে যাকে চিন্তা করতে হয় সেই মার চোখজুড়ে ছিল হতাশা। সেই হতাশার মেঘ দ্রুত রাগে ঘনীভূত হয়ে লাঠির বাড়ি আকারে আমার পিঠে নেমে এল।

কত কিছুইতো আমার-আমাদের জীবন থেকে ঝরে যায়, গেলো। কালির কলম, গানের ক্যাসেট, টু-ইন-ওয়ান, রেডিও। আলগোছে মিটসেফও বিদায় নিল এক সময়। এর অনেক অনেক পরে একটা মিটসেফের দেখা পেয়েছিলাম।
২০০৫ সাল। মিডনাইট কুরিয়ার নামে বেশ বড়সড় এক আমেরিকান প্রতিষ্ঠানকে কাস্টমার হিসেবে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। প্রতিষ্ঠানটা এতটাই বড় যে এক লাফে আমাদের প্রতিষ্ঠানের আয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যাবে। তাদের কাজের সমীক্ষার জন্য যে টাকা দিচ্ছে সেটাও বেশ ভালো। এই কাজের জন্যই লস অ্যাঞ্জেলেস যেতে হবে। লন্ডন অফিসের দুই বস আর ঢাকা অফিস থেকে আমার যাওয়ার কথা। লন্ডনের দুজনতো শুধুমাত্র প্লেনের টিকিট কেটেই যাত্রা নিশ্চিত করল। বঙ্গসন্তানের আমেরিকা যাত্রাতো এত সহজ হতে পারে না। ভিসার জন্য আবেদন করে অপেক্ষা করছি তো করছিই। দূতাবাসে ফোন করলেই বলে তারাও অপেক্ষা করছে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের জন্য। অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। প্লেনের টিকিট বুক করে রেখেছিলাম। নির্ধারিত দিনের তিন দিন আগে যখন বুকিং বাতিল করব ভাবছি ঠিক সেই সময়েই ভিসা পেলাম। মাত্র নয় দিনের সফর। তাই খুব বেশি প্রস্তুতির কিছু ছিল না।
সময়মতোই ঘটনাবিহীন ভাবেই লস অ্যাঞ্জেলস পৌঁছালাম। যদিও আমেরিকান ইমিগ্রেশন নিয়ে অনেক ভীতিকর গল্প শুনেছি এবং সেইমত কিছু মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। ভাগ্যগুণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা হলো না। ম্যানহাটনে ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছালাম লন্ডনের বসদের দুই ঘণ্টা আগেই। পরবর্তী সাত দিন কাজ নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এর মাঝেও যা লক্ষ্য করেছি তা হলো আমেরিকার সবকিছুই মনে হয় সাইজে বড়। গাড়ি বড়, বাড়ি বড়, বিশাল রাস্তা এমনকি বার্গারের সাইজও বিশাল। আর মানুষ। আমেরিকার মতো দৈর্ঘ্য প্রস্থে এত বিশালাকার মানুষ আমি আর কোথাও দেখি নাই।
আমি গড়পড়তা সাধারণ মানুষের কথাই বলছি। একটা উদাহরণ দিই। মিডনাইট কুরিয়ার অফিসের রিসেপশনিস্টের নাম ক্রিস। খুব হাসি খুশি যুবক। বিশাল ডেস্কের আড়ালে প্রায়ই দেখতাম মুখ গোল করে শিস বাজাচ্ছে। অফিসের কিচেনটা কোথায় জানি না। ক্রিসকে জিজ্ঞাসা করলাম। ক্রিস উঠে দাঁড়াল আমাকে জায়গাটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। এই প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ক্রিসকে দেখলাম। সামনেই ছিল প্রমাণ সাইজের এক আয়না। ছেলেবেলায় জনি ওয়েসমুলারের টারজান খুব প্রিয় ছিল। আয়নায় ক্রিসকে প্যান্ট জামা পরা টারজানের মতোই লাগছিল আর পাশে আমাকে ঠিক যেন প্যান্ট জামা পরা শিম্পাঞ্জি চিতা।
শুক্রবার বিকেলেই লন্ডনের দুই বস ফিরে গেলেন। আমার ফিরতি ফ্লাইট রোববার সকালে। চায়ের মগটা হাতে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়াই। একটু দূরেই প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশি দেখা যায়। ধীরে ধীরে বিকেলের আলো মরে যাচ্ছে, রাস্তার আলো জ্বলে উঠছে। এ রকম সময়ে, এ রকম পরিবেশেই আমাকে ভূতে ধরে। এই অ্যাপার্টমেন্টের চাইতেও ছোট এক বাসায় দশজন মানুষের গাদাগাদি করে থাকা, সাড়ে চার ফুট চওড়া গলিতে লাটিম ঘোরানোয় ব্যস্ত এক বালক, কোনো কিছুই ঠিকভাবে করতে না পারা ক্রমাগত হোঁচটে অতিষ্ঠ এক বোকা কিশোর, সিনেমা দৃশ্যের মতোই চোখের সামনে ভাসে...ভাসতে থাকে। মাঝারি চিত্ত আর মাঝারি বিত্ত ছিল পুঁজি। আর ছিল ‘আরেকটু ভালো থাকার নিরন্তর চেষ্টা’। তবুও ভূতটা কানের কাছে ফিসফিস করে ‘ভুল চরিত্রে ভুলভাল অভিনয় আর কত?’
ভূতের হাত থেকে বাঁচার জন্যই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হই। আগেই জানতাম লস অ্যাঞ্জেলেস পাবলিক বাস ট্রেন খুব অপ্রতুল। তাও এই কয়েক দিনের গবেষণার ফলে পা যুগল আর বাসে করেই পৌঁছে গেলাম হলিউড বুলেভার্ডের বিখ্যাত ওয়াক ওফ ফেমে। পুরোনো দিনের গ্রেটা গার্বো, অড্রে হেপবার্ন, মেরিলিন মনরো, পল নিউম্যান থেকে শুরু করে আধুনিক কালের মাইকেল জ্যাকসন, উইল স্মিথ, ব্রুস উইলিসসহ অনেক তারকার হাতের ছাপ দেখতে পেলাম। টুরিস্ট এলাকা। সর্বদাই লোকে লোকারণ্য। অনেক হাসি খুশি চেহারার ভিড়ে হাঁটতে ভালোই লাগে। অনেক সময় নিয়ে রাতের খাবারও খেয়ে নিলাম এক ফাঁকে। এই করেই মনে হয় কিছুটা রাত হয়ে গেল। অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে গিয়ে দেখি বাস সার্ভিস আজকের মতো শেষ। অগত্যা ট্যাক্সি নিতে হলো।
—ভাই কি বাংলাদেশি? ট্যাক্সিতে উঠতেই পরিষ্কার বাংলায় প্রশ্ন করলেন ট্যাক্সি ড্রাইভার।
হ্যাঁ। বুঝলেন কীভাবে? উত্তর দিই।

লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ট্যাক্সি। সংগৃহীত
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ট্যাক্সি। সংগৃহীত

—বয়স চল্লিশ হয় নাই। তবুও এই রকম একটা খান্দানি টাক। চুলতো আর এমনে এমনে পড়ে নাইরে ভাই। হাসতে হাসতে বলেন ট্যাক্সি ড্রাইভার।
অল্প সময়েই আলাপ-পরিচয় হয়ে যায়। নাম জালাল। কিছু মানুষ আছে যারা খুব সহজেই আন্তরিকভাবে মানুষের সঙ্গে মিশে যান। জালাল ভাই তেমনই। আপনি থেকে তুমিতে যেতে বেশি সময় নেন না।
—ছোট ভাই থাকবা কয়দিন?
কালকের দিনটাই আছি। পরশু সকালে ফ্লাইট। উত্তর দিই।
—তাহলে ইউনিভার্সাল স্টুডিও আর ডিজনিল্যান্ড ঘুরে যাও।
সময় কম আর তা ছাড়া টিকিটের খরচওতো বেশ।
—যতটুকু বুঝতে পারছি খরচ দেবেতো তোমার লন্ডনের কোম্পানি। তোমার এত চিন্তা কীসের।
তাও ভাই। কোথায় কোথায় বিনা পয়সায় ঘোরা যায় তাই বলেন।
—বুঝছি। কাল সকালে আমিই নিয়ে যাব।
না, না ভাই। নিয়ে যেতে হবে না। ঠিকানা দিলেই হবে।
—ভয় পাইও না ছোট ভাই। তোমার কাছ থেকে ভাড়া না নিলেও আমার ক্ষতি হবে না। জালাল ভাইয়ের উত্তর শুনে আমার বেশ লজ্জা লাগে। আসলেওতো এই কারণেই নিষেধ করেছিলাম। এভাবেই অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে যাই। ভাড়া মিটাই।
—ছোট ভাই তোমার টয়লেটটা একটু ব্যবহার করতে হবে।
ঠিক আছে আসেন ভাই। জালাল ভাই টয়লেটে একটু সময় নেন। এই ফাঁকে আমি দ্রুত দুই কাপ চা বানিয়ে ফেলি।
—ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সব চাইতে বড় শারীরিক সমস্যা কি জান? টয়লেট থেকে বের হয়ে জালাল ভাই বলেন।
কি ভাই?
—ব্লাডার প্রেশার। এই জন্য যারা বেশিদিন ক্যাব চালায় তাদের অনেকেরই কিডনি রোগ হয়। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলেন জালাল ভাই।
আপনি আমেরিকাতে কত দিন?
—আট বছর। এর আগে গ্রিস-ইতালিতে ছিলাম পাঁচ বছর। সব মিলিয়ে তেরো বছর দেশে যাই না।
তাই নাকি? আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি।
—ছোট ভাই আমার জীবনকাহিনি সিনেমার মতো। কোনো দিন সময় পেলে বলব। চোর, ঠগ, জোচ্চোরের হাতে পড়েছি, কিছুদিন জেলও খেটেছি। এইবারের কন্টাক্ট ম্যারেজটা ভালো। আশা করছি আগামী বছরের মধ্যেই কাগজ পেয়ে যাব। কন্টাক্ট ম্যারেজ কি জানোতো?
জি শুনেছি কিছুটা।
—হুমম। কাগজের বিয়ে। নিউইয়র্কেও করছিলাম একটা। হারামি ছিল। কয়েক দিন পরপর টাকার পরিমাণ বাড়াতে বলত। কোনোমতে সেই গেরো থেকে মুক্তি পাইছি। এবারেরটা ভালো। মাসের এক তারিখ টাকা নিয়ে যায়। আর কোনো ঝামেলা নাই। বয়স হইয়া যাইতাছে। কাগজ হইলেই দেশে যাব। বিয়ে শাদি করে সংসারী হব। চা শেষ করেই চলে যান জালাল ভাই।
পরদিন সকালেই আবার আসেন জালাল ভাই। আমাকে নিয়ে বেভারলি হিলস, সান্তা মণিকা ঘুরে ভেনিস বিচে নিয়ে আসলেন। আমি এক রকম জোর করেই ভাড়া দিলাম। ট্যাক্সির মিটার বন্ধ ছিল। তাই প্রকৃত ভাড়ার অর্ধেকই হয়তো দিতে পারলাম। তবুও ভালো লাগল।
—এইখানে ঘোরাঘুরি করো। ভালো লাগবে। আমি ঘণ্টা তিনেক পরে এসে নিয়ে যাব। জালাল ভাই বলেন।
না, জালাল ভাই। ঘণ্টা ধরে ঘুরতে আমার ভালো লাগে না। আমি একাই ফিরব। উত্তর দিলাম। কিছুক্ষণ জোরাজুরির পর রাজি হলেন জালাল ভাই। কিন্তু বলল পরদিন এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। পুরো ভাড়াই নিতে হবে, এই শর্তে রাজি হলাম।
ভেনিস বিচে ঘুরে বেড়াতে ভালোই লাগল। রাস্তার জাদুকরদের জাদু দেখলাম, জিমন্যাস্টিক দেখলাম, টুকটাক কিছু কেনাকাটাও করলাম। সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে এলাম। সকাল আটটায় ফ্লাইট। সকাল পাঁচটাতেই দেখি জালাল ভাই হাজির। হাতে বার্গার আর কফি।
—ছোট ভাই খেয়ে নাও। প্লেনের খাবার কখন দেবে তারতো ঠিক নাই।
অতএব খাবার হাতে নিলাম।
—বাবা মারা গেছে পাঁচ বছর। বড় বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই আর এক বোনেরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কত ছোট দেখে এসেছিলাম ওদের। আর মা। মার হাতের খাবার খাই না কত দিন। বলতে বলতে গলা ধরে এল জালাল ভাইয়ের।
এ রকম সময় কী বলতে হয় আমি জানি না। তাই বললাম, চলেন জালাল ভাই এয়ারপোর্ট যাই।
—ছোট ভাই এখানে কিছু ভিটামিন আছে আম্মার জন্য। প্যাকেটে ঢাকার বাসার ঠিকানা, ফোন নম্বর সব আছে। আর এই পাঁচ শ ডলার আম্মাকে পৌঁছে দিলে খুব খুশি হব।
জালাল ভাই। ডলারটা না দিলে হয় না। মানে আপনার সঙ্গে দেখা মাত্র দুই দিন আগে...।
—আবারও বলছি আমার মাথার চুলতো এমনিতেই পড়ে নাই। মানুষ চিনি। এই সামান্য কয়েকটা ডলার তোমার হাতে নিশ্চিন্তে দিতে পারি।
এর পরে আর কথা থাকে না। জালাল ভাইয়ের ডলার আর ওষুধ নিয়েই ঢাকা ফিরি।
সপ্তাহখানেক পরে এক ছুটির দিনে ঠিকানামতো বাসায় গেলাম। আগেই ফোন দিয়েছিলাম। দরজা খুলল জালাল ভাইয়ের ছোট ভাই। দুলাল নামটা জালাল ভাইয়ের কাছ থেকেই শোনা।
—ভাইয়ার সঙ্গে তাহলে আপনার দেখা হয়েছে। শুনেছি মেম বিয়ে করেছে। এই জন্যই আর দেশে আসে না। দুলাল দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বলে।
উত্তরে কী বলব বুঝতে না পেরে বলি, আপনার আম্মার সঙ্গে দেখা করতে পারি।
—ভাইয়ার কাছ থেকে এসেছেন, আম্মার সাথেতো অবশ্যই দেখা করবেন। আমরা কাছে থাকলেও আম্মাতো ভাইয়া বলতে অজ্ঞান। আসুন ভেতরে আসুন।
সুন্দর সাজানো গোছানো বসার ঘর। শুধু এক কিনারে রাখা একটা মিটসেফই বেশ বেমানান।
—আচ্ছা ভাইয়া কি দেশে আসবে না? দুলাল জিজ্ঞেস করে।
অবশ্যই আসবে। আমাকেতো বলল আগামী বছরই আসবে।

লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ট্যাক্সি। সংগৃহীত
লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ট্যাক্সি। সংগৃহীত

—বিশ্বাস করি না। এ রকম বহুবার বলেছে। সেতো মনে করে টাকা দিলেই সংসারের সব দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেল।
—বাবা তুমিই জালালের কাছ থেকে আসছ। দুলালের কথার মাঝখানেই এক বয়স্ক মহিলা সোজা এসে নিঃসংকোচে আমার হাত ধরে বলেন।
—বল বাবা আমার বাজান কেমন আছে?
—আপনার জন্য একটু চায়ের কথা বলি, বলে দুলাল চলে যায়। বৃদ্ধা মাকে ডলার আর ওষুধগুলো দিই। আর যতটা সম্ভব তার ছেলের খবর দিই।
—এদিকে আসো বাবা বলে বৃদ্ধা হাত ধরে আমাকে মিটসেফের কাছে নিয়ে যান।
মিটসেফটা মনে হয় কয়েক দিন আগেই বার্নিশ করা হয়েছে। গন্ধটা আমার বেশ ভালো লাগে। বৃদ্ধা কাঁপা হাতে দরজা খোলেন মিটসেফের। জালাল ভাইয়ের কয়েকটা ছবি, এক জোড়া জুতা, আর অনেক মেডেল-শিল্ড-কাপ দেখতে পাই।
—বাজান আমার খেলাধুলায় খুব ভালো ছিল। এই মেডেল শিল্ড সব ওর পাওয়া। বাজানের খালি খিদা লাগত। এই মিটসেফের ভেতর মোয়া, নারু, ক্ষীর যা রাখতাম সব ও খেয়ে ফেলত। কত মাইর দিছি এই কারণে।
এতটুকু বলেই মিটসেফের পাশের চেয়ারে বসেন বৃদ্ধা।
—অভাবের সংসারে কোনো দিন একটু আদর-যত্ন করতে পারি নাই বাজানের। এখন ওরই চেষ্টায় অভাব দুর হইছে। কিন্তু বাজানরে আর পাই না। মিটসেফটা আমি জোর কইরা রাখছি। বাজান আসলে আমি নিজ হাতে রাইন্ধা এই মিটসেফ ভর্তি কইরা খাওন রাখমু...বাজান খাইব, ডুকরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা। কথা শেষ করতে পারেন না।
সেই প্রথম জানলাম-মিটসেফে শুধু বাসী খাবারই থাকে না, সময়-দূরত্বের কাছে অপরাজিত স্নেহ ভালোবাসাও থাকে।