মা আমাকে ১০ মাস ১০ দিন পেটে রেখে অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবে বুধবার প্রত্যুষে জন্ম দেন। মাঝেমধ্যে স্তন পান করাতেন বৈকি, বাকি সব লুৎফা আর আনু বুজির অবদান। তাকে লিখতাম বেয়ারিং চিঠি। সেই মমতাময়ীদের একজন আনোয়ারা খান আনু চলে গেল না–ফেরার দেশে, ১৫ সেপ্টেম্বর। প্রবাসে থাকার কারণে হলো না শেষ দেখাও।
সারা রাত একটুও ঘুম হয়নি, এলোমেলো স্বপ্নে ভোর হলো। সোমবার থেকে শুক্রবার সকাল ছয়টায় উঠতে হয়। কারণ, সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিপ্লোমার ক্লাসের জন্য বের হই। ঘরে ফিরি বিকেল পাঁচটায়। ওই দিনও সময়মতো ক্লাসে গেলাম। ক্লাস চলাকালে মুঠোফোনে কথা বলা না গেলেও শিক্ষককে ফাঁকি দিয়ে চ্যাট করা বা ফেসবুক দেখা যায়। জার্মান সময় বেলা দুইটার দিকে লুৎফা বুজির মিসড কল এল। ভাবলাম, ক্লাস শেষে কলব্যাক করব। তিনটার দিকে ফেসবুক দেখতে গিয়ে মেজ ভাইয়ের ছেলে খোকনের স্ট্যাটাসে দেখলাম, মায়ের বিকল্প আমার বোন আনোয়ারা খান আনু আর নেই। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম, চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। অধ্যাপক শামি আফসার সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সহপাঠী ওয়ান্টা গাড়ি করে বাসায় দিয়ে গেল। সারা দুনিয়া অন্ধকার মনে হলো। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে সবাইকে কল করলাম। ভিডিও কলে বোনকে শেষ দেখা দেখলাম। ১৯১২ সালে মা মারা যাওয়ার পর বোনেরা টের পেতে দেয়নি মায়ের অভাব।
পেছনে ফিরে যদি যাই, আমার পরিবার ছিল কৃষিনির্ভর। গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ। সাত ভাইবোনের মধ্যে আমি কনিষ্ঠ। মা সাংসারিক কাজেই বেশি ব্যস্ত সময় কাটাতেন। বোনেরা আমার খাওয়াদাওয়া গোসল সবই করাত। এমনকি মক্তবে গেলেও আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেত দোপাট্টায় (ওড়না) জড়িয়ে। বিয়ে হয়ে গেলে মায়ের ওপর চাপ পড়ে। ওয়ান–টুতে পড়া অবস্থায় বোনদের বাড়ি ছিল আমার স্বর্গ। বয়সে অনেক বড় হলেও বন্ধুর মতো, ডাকতাম ‘দোস্ত’। আমার বন্ধুদেরও ছিল প্রিয়। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম, আনু বুজি বিভিন্ন রকম হাতের কাজে সৌখিন ছিল। বাবাসহ আমাদের সোয়েটার হাতে বুনে দিত। রংবেরঙের লেখা কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখত। স্বামী আবদুস সোবাহান মাতুব্বর পুলিশে চাকরি করতেন। স্বামীর সঙ্গে যশোর, নড়াইল, লোহাগড়া, বড়দিয়া, ঝিকরগাছা, ঝিনাইদহ, বাগেরহাট, রামদা, রাঙামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেছে। রাঙামাটি থাকার সময় পাহাড়িদের কাছে বাঁশের সাহায্যে কাপড় বুনতে শিখেছিল। টেলিফোনের সুবিধা না থাকায় আমরা ভাইবোনরা প্রতি মাসে কম হলেও দুটো চিঠি লিখতাম। আমি বেশির ভাগ সময় বেয়ারিং চিঠি লিখতাম। বেয়ারিং চিঠি হচ্ছে ডাকটিকিট না দিয়ে লেখা চিঠি। প্রাপক ডাক খরচ দিয়ে চিঠি রাখেন। আজকাল কেউ বেয়ারিং চিঠি লেখে কি না, জানি না। আরেকটা কথা না বললে অকৃতজ্ঞ হব। তা হলো আমি যখন তিন দশক আগে জার্মানিতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় নিই, শুরুতে কাজের অনুমতি ছিল না। তাই টাকাও ছিল না ফোন করার। তখন আমার সেজ ভাই কুদ্দুস খান আবুধাবিতে আবাসন ব্যবসা করত। আমি তাকে ফোন করতাম কিন্তু বিল দিত সে। ব্যাপারটা হলো আমি টেলিফোন কোম্পানিকে ফোন করে বলতাম, আমি এই নম্বরে কথা বলব কিন্তু বিল দেবে সে, তখন টেলিফোন কোম্পানি তাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করত, অমুক অমুক দেশ থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়, বিল আপনার! সে রাজি হলে লাইন দিয়ে দিত। এভাবেই ভাইকে ফোন করতাম। আনু বুজি টাকা দিয়ে চিঠি ছাড়াত। পাশাপাশি সে যখন আমাকে চিঠি লিখত, চিঠির মধ্যে ১০ টাকা বা ২০ টাকা বা বেশি হলে ৫০ টাকার নোট ভরে দিত। নড়াইল, বড়দিয়া থাকাকালে সে মুরগি পালত বাসায়। মুরগি ডিম দিলে আমি যখন যেতাম, ডিম সেদ্ধ করে বাচ্চাদের না দিয়ে আমাকে দিত। বিদেশ থেকে গেলে ছাতার মতো আগলে রাখত। করোনা মহামারি যখন শুরু হয়, তখন ঢাকায় ছিলাম। তখন নিজে অসুস্থ হলেও ভাইয়ের (আমার) পাশে বসে বিদ্যুৎ চলে গেলে বাতাস করেছে, মশা তাড়িয়েছে। চলে আসার পর প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে খবর নিয়েছে। বছর তিনেক ধরে ক্যানসারে ভুগছিল। সম্প্রতি গুরুতর অসুস্থও ছিল। চলে যাওয়ার দুই দিন আগে ফোন করে অনেক কথার শেষে বলল, ভাই, মাফ করে দিস, আর দোয়া করিস, যেন আজ রাতেই মরে যাই! আর কষ্ট সহ্য হয় না! সত্যিই, আমার মায়ের মতো বোন চলে গেল সৃষ্টির নিয়মে না–ফেরার দেশে।
আমরা প্রবাসীরা এমন করেই আপনজন হারাই, শেষ দেখা হয় না। এখন কেউ আর তার মতো কল করবে না, লেখা হবে না বেয়ারিং চিঠিও। শুধু ঝরবে মমতার অশ্রু। ভালো থেকো, দোস্ত।