মায়ের তীব্র কষ্টের এক ছাড়পত্রের নাম

ভুবন আমার নাম। মাকে তীব্র কষ্টের থেকে ছাড়পত্র দেওয়া এক ডাকটিকিটের নাম! এই নামের একটা গল্প আছে।
যার ক্লান্তিহীন শ্রোতা আমি। আর অক্লান্ত বক্তা আমার মা।
আমিই সেই মেয়ে যে জন্মেরও আগে সঙ্গী পেয়েছি। যমজ বলে পেয়েছি জন্মেরও আগে অন্তরঙ্গ প্রতিবেশী। রীপা।
২১ অক্টোবর আমাদের দুই বোনের জন্মদিন। যমজ সন্তান বলে আমাদের জন্মের সময় আমাদের মায়ের এক পৃথিবী কষ্ট হয়েছিল। এত কষ্ট, যেন পৃথিবীতে মা আর নেই। তারপর দুষ্টু মেয়েগুলোর মধ্যে বড় মেয়েটা পৃথিবীতে আসার পর; তার পিটপিট করা সদ্য চোখে আমাদের মা পুনর্জন্ম নেওয়া পৃথিবী দেখল। লীন হয়ে যাওয়া দেহে, বিস্ময় মাখানো। অস্ফুট স্বরে তার নাম দিল। তাকে চুপিচুপি বলল ভুবন। আমি বেঁচে আছি। তুমুল ব্যথার পরে আগত অন্য সন্তানের দিকে চেয়ে বলল, কষ্ট ভুলছি। এ যে দেখছি, ননির পুতুল!
সেই মায়ের সঙ্গে আমার রাগ। সময় সময় এক বিন্দু সময়ও নাই। বলি কার জন্য এত ব্যস্ত?
ব্যস্ত আম্মু আরও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরক্ষণে তাঁর মনে পড়ে, আরে গাছের ডাবগুলো তো সব নারকেল হয়ে যাচ্ছে।
কখন আসবি মা? আমি, আমার মা, আমার আজন্ম সঙ্গী বোন দুই মহাদেশে থাকি। তাই প্রযুক্তির অপর নাম আমার কাছে আশীর্বাদ। সেই ফোন, মায়ের টেলিফোন। আমাকে ফোনের লাইনে ফেলে রেখে মা কাকে যেন বলছেন, ভুবন আসবে। ভুবন আসলে তুই ডাব পাড়তে আসিস আকরাম।
অভিবাসী আমি।

ফোনের এ প্রান্তে আমার নিয়মের নিগড়ে সাজানো কামরা থেকে মুহূর্তেই ফিরে যাই শেকড় আর স্মৃতির কাছে। শৈশবের শ্যামল নদী, কাশবন, খেয়ানৌকা আর ডাহুক ডাকা ঝিলের খুব কাছাকাছি চলে যাই। যেখানে অপেক্ষায় আছে জননীর আঁচলের ছাই রঙা শাড়ির চওড়া পাড়, বাবার চোখের মোটা কালো ফ্রেম, হিজল ডোবা পুকুর জলের সবুজ শান্ত ঢেউ। যেখানে সন্ধ্যা নামলেই জোনাকির আলোকসজ্জা, মাছরাঙা, মাছ ভাত কিংবা অপেক্ষায় জানালার গ্রিল ধরে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক জোড়া কাজল চোখ!
আমি বহুদূরে থেকেও খুব কাছ থেকে দেখতে পাই, খোঁপার বাঁধন খুলে মায়ের শীতল পাটিতে বুনো ঘাস হয়ে চুপচাপ ঘুম। ঘুম ভাঙলেই মাংসের থালায় সন্দেশ রাখছি, সকলেই পাশাপাশি থাকছি বিবাদহীন। জানি, শত হৃদ্যতার এই সব আবেগী চাওয়াগুলো পাইকারি বাজারে হারাবে আজ তার ন্যায্য মূল্য। তবু আমার বাংলাদেশের মেলা থেকে শীতল পাটি কিনি, তাকে সাজিয়ে রাখি যুক্তরাষ্ট্র নামক এক দেশের গভীরে, ঘরে।
ব্যস্ত আমার মা। প্রতি শীতে কথা থাকে এই শীতে নিশ্চয়ই আমি থাকব তাঁর উনুনের কাছে। যেখানে উষ্ণতা, যেখানে আমার বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন প্রকল্প নিয়ে বাড়িঘর সেই সঙ্গে উঠোনের ইটও রং করান আমার মা। রং? কি রং বকা খাবার আগেই আমাকে বলেন, এবার একটু গোলাপি। আসলে প্রতিবারই গোলাপি। আমার মায়ের প্রিয় রং।
আমি ফোনের মধ্যেই মায়ের গোলাপি ব্লাউজের ঘ্রাণ পাই। তারপরে মা নিজে নিজেই স্বগতোক্তি করেন, মারে মোরগগুলা রাবা হয়ে গেছে, শীতকালে খেতে মজা।
প্রতি শীতে মরা বেলি ফুল গাছের গোড়া মা পরিষ্কার করান। ফোনে তো আমার চেহারা দেখা যায় না, তবু অস্থির হয়ে বলেই যাচ্ছেন। যেন আমি অভিযোগ করেছি! আপনাতেই বলে যাচ্ছেন, না না বেলি গাছটা মারেনি কেউ, মরে গেছে।
সব শীতেই মারা এমন, এমনই।
অথচ শীত কি আর প্রতি বছর একই রকম করে পড়ে? এ বছর এই কাজ তো ওই বছর সেই কাজ। কাজ কাজ আর কাজ।
আমরা একুশ শতকের সন্তানেরা মায়ের বুকের উপকূলে পরিযায়ী পাখি। আবেগের জলাশয়ে আমাদের দুর্লভদর্শন। আকুলতার বিলে আঙুল বুনে দেওয়ার এত সময় কই? প্রতি শীতের শুরুতে মায়েরা অপেক্ষার গাছ রোপণ করেন। শীত শেষে তা বোলশূন্য অভয়াশ্রম। হাহাকার করে ওঠে মায়েদের বুকের হাওর। ফেরা হয় না আমাদের। জন্মদিন আসে, জন্মদিন যায়। আমার জীবন ভ্রমণের সঙ্গী রীপা শূন্য দৃষ্টি রেখে মায়ের ঐশ্বর্যে পূর্ণ এক পৃথিবী থেকে বলে, মারা কখনো জন্ম তারিখ মনে রাখেননি, রাখেন না। রাখার দরকারও নেই। মায়েরা যে কখনো সন্তানের জন্ম ভোলেন না!
আচ্ছা; এই সকল আমরা কি তবে অতিথি পাখি হয়ে গেলাম?
অত অভিজাত পাখি তো আমি হতে চাইনি। দাঁড় কাক হতে চেয়েছিলাম। সকাল বিকেল মায়ের উঠোন জুড়ে কা–কা। বিরক্ত করা আর বিরক্ত করা। মা দিতেন লাঠি নিয়ে দৌড়ানি। লজ্জাহীন আমি দুই মিনিট পর ভুলে গিয়ে আবার মায়ের পেছনে হাজির কা–কা–কা।