মানুষ মানুষের জন্য

ফোনে গলা শুনে বুঝলাম ভদ্রলোক বেশ ভদ্র। পরিষ্কার ইংরেজি উচ্চারণ, অকারণ আমেরিকান টান নেই। তিনি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। ভয় ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও নেই। সব মিলিয়ে মানুষটাকে ভালোই মনে হলো। ইন্টারভিউর সব ধাপ শেষ করে যখন ওই কোম্পানিতে কাজ শুরু করলাম তখনো তার দেখা মেলেনি। তিনি কাজ করেন অন্য একটা গ্রুপে। তারপর একদিন কী কারণে যেন তার কাছে একটা কাজে পাঠালেন আমার বস। সেই প্রথম তার সঙ্গে সামনাসামনি পরিচয়। খুব ভালো লাগল। বন্ধুত্বপূর্ণ অমায়িক আচরণ। কোনো হামবড়া ভাব নেই। খুব সরাসরি কথা বলেন আর জ্ঞানের গভীরতা অনেক। খুব সহজেই আমি যে বিষয়টা জানতে চাই বুঝিয়ে দিলেন। এরপর আরও দিন গেছে। কাজের সূত্রেই বন্ধুত্ব বেড়েছে। অনেক ব্যক্তিগত আলাপও হতো মাঝে মাঝে। কথায় কথায় জানতে পারলাম, আমারই সমবয়সী তিনি। তার দুই ছেলে। তিন নম্বর সন্তান আসছে। দুটো বাচ্চাকেই বাড়িতে পড়ায় তার স্ত্রী। ওদের কোনো স্কুলে পাঠানো হয় না। তিনি খুব ধর্মভীরু খ্রিষ্টান। প্রথমে ভেবেছিলাম ধর্মীয় কারণে হয়তো বাচ্চাদের স্কুলে পাঠান না। শুধু চার্চে যায়। কিন্তু পরে আমি এই মানুষটির এক অসাধারণ গল্প শুনেছি।
মাইকের জন্ম এক অশিক্ষিত পরিবারে। শিক্ষার কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। আর্থিক সংগতিও বেশি না। সন্তানদের শিক্ষা, চরিত্র এসব নিয়ে তার মা বাবার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। দরিদ্র এলাকার অশিক্ষিত পরিবেশের এক পাবলিক স্কুলে নামকাওয়াস্তে তাকে ভর্তি করে দিয়েছে। ভাবুক প্রকৃতির গভীর মনের মাইকের সেই পরিবেশ একদম পছন্দ নয়। সেখানে পরিচয় হতে থাকে সব উঠতি বখে যাওয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। নোংরা অশ্রাব্য গালিগালাজ আর আচার আচরণের সঙ্গে। স্কুলে একদম ভালো লাগে না মাইকের। পড়ালেখাও আকর্ষণ করে না তাকে। তা ছাড়া, মা বাবার কাছ থেকেও কোনো উৎসাহ পায় না। তার জীবন তার। সেই জীবন নিয়ে সে যা ইচ্ছা তাই করুক, তাদের যেন কিছুই যায় আসে না। ভাবুক প্রকৃতির ভদ্র ছেলে মাইককে প্রতিদিনই ক্লাসের ছেলেমেয়েদের হাসি তামাশার শিকার হতে হয়। সে যেন তাদের এক আনন্দের উৎস। এই পরিবেশ এক সময় তার কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। তা ছাড়া সংসারেও নিত্য টানাটানি। সে বাধ্য হয়ে একদিন ঠিক করে স্কুল ছেড়ে দেবে। মা বাবাও খুশি, সংসারে আয় উন্নতি বাড়বে।
স্কুল ছেড়ে সে কাজ নিল মোটর মেকানিকের। কাজেও তার মন বসে না। সঙ্গী সাথিরাও সব অর্ধ শিক্ষিত। তবু লাভের মধ্যে, অর্থের অভাব কিছুটা দূর হয়েছে। কিন্তু কাজে কোনো মজা নাই। এইভাবেই বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। কৈশোর পেরিয়ে মাইক এখন পরিপূর্ণ যুবক। কাজের একঘেয়েমি থেকেই একদিন মাথায় চিন্তা আসল কিছু একঘেয়ে কাজ যদি কোনো মেশিন দিয়ে করানো যেত। কোথায় যেন শুনেছিল, কম্পিউটার দিয়ে অনেক কিছু করানো যায়। তারপর শুরু হলো পড়াশোনা, খোঁজ খবর। এ দেশের পাবলিক লাইব্রেরিগুলো অনেক সমৃদ্ধ। সবার জন্য অবারিত। এই খোঁজ খবর করতে করতেই সে বুঝতে পারল তার মনে আছে এক গভীর তৃষ্ণা ও জানার আগ্রহ। কম্পিউটার নিয়ে জানার আগ্রহ। পয়সা জমিয়ে রাতের কলেজে ভর্তি হলো। ঘুম নেই, রাত জেগে ক্লাস শেষে হোম ওয়ার্ক করা, দিনে কাজ, রাতে ক্লাস। বয়স্কদের ক্লাস। এভাবে করেই হলো অসাধ্যসাধন। একটা ডিগ্রি অর্জন হলো কম্পিউটারে। বাজারে তখনো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারের অভাব। চাকরি পেয়ে গেল এক নামী কোম্পানিতে। তারপরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। চাকরিতে তার দারুণ সুনাম।
পাবলিক স্কুলের ভয়াবহ স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়ায় আজও। সেই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মাইক সিদ্ধান্ত নেন তার সন্তানদের তিনি পাবলিক স্কুলে পাঠাবেন না। নোংরা কথা, আচরণ যেন তারা না শেখে। বাচ্চাদের হোম স্কুলিং করে। তিনি নিজে প্রিন্সিপাল আর বাচ্চাদের মা টিচার। বাচ্চারা নিয়ম করে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা, খেলাধুলা ও চার্চের মাধ্যমে অনেক কিছু করে। আমি অবাক হয়ে যেতাম দেখে প্রিন্সিপাল বাবা নিয়ম করে প্রতিদিন লাঞ্চের সময় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাসায় ফোনে বাচ্চা ও টিচারের সঙ্গে কথা বলেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বার মাস। নিয়ম করে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ফিল্ড ট্রিপে যান। মাইকের বাবা–মা তাকে কোনো জীবনবোধ শেখাননি। তাই পড়ালেখার পাশাপাশি ধর্ম, মানবিক গুণাবলি সবকিছুর ট্রেনিং চলছে তার বাচ্চাদের অতি যত্নের সঙ্গে।
আরও বড় বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল যেদিন তিনি বললেন, আমাকে একটা বাংলা চিঠি পড়তে হবে। তাঁর নিজের ছোটবেলা অনেক দারিদ্র্যে কেটেছে। সেই কষ্ট তিনি কোনো দিনও ভুলবেন না। তাই পৃথিবীর একটা দরিদ্র বাচ্চাকে হলেও তিনি সাহায্য করতে চান। তিনি শুনেছেন বাংলাদেশের শিশুদের কষ্টের কথা। তাই তিনি একটি দরিদ্র বাংলাদেশি শিশুকে দত্তক নিয়েছেন। মাসে মাসে ওর জন্য টাকা পাঠান, নাম তার নিমাই। সেই নিমাই দিনে দিনে বড় হচ্ছে, লেখাপড়া শিখছে, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ পাচ্ছে। নিমাইয়ের কথা যখন বলছিলেন তার চোখে অন্য রকম একটা আলো খেলা করছিল। প্রায়ই তার কাছে নিমাইয়ের গল্প শুনতাম। নিমাই ওকে বাংলায় চিঠি লিখেছে, এক অমূল্য চিঠি।
হাজার হাজার মাইল দুরে অচেনা অদেখা একটা ভিনদেশি বালকের জন্য তার যে মমতা দেখেছি সেটা সত্যি অতুলনীয়। আরেকটা জিনিস স্পর্শ করেছিল আমাকে, সেটা হলো অতি অল্পে সন্তুষ্টি। মাইক প্রায়শই তার অতীতের কথা বলতেন। একটা দিনের জন্য ভুলে যাননি, তিনি একজন মোটর মেকানিক ছিলেন আর তাই প্রতিনিয়ত তিনি কৃতজ্ঞতা জানাতেন নিজের বর্তমান জীবন নিয়ে। হয়তো বাচ্চাদের নিয়ে সামান্য বার্গার খেতে মাসে একবার দোকানে গেছেন, তাতেই মহা খুশি। তার কোনো পাসপোর্ট নেই, কারণ তিনি কখনো আমেরিকার বাইরে যাননি।
তাতে কী? তিন চার সপ্তাহ ধরে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে গাড়িতে করে ঘুরেছেন। তার এখন পাঁচ বাচ্চা, দুইটা কুকুর। এত জনের প্লেনের টিকিট কেনার ক্ষমতা তার নাই। তাতে তার আনন্দ বা সন্তুষ্টির কোনো কমতি নেই। একজন পরিপূর্ণ সুখী ও স্বনির্মিত মানুষ।