মানবিক মূল্যবোধ ও হিজড়া সম্প্রদায়

ছোট বেলায় মনে হতো, চাঁদা আদায়ের জন্য নারী সেজে ওরা ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। যখন বুঝলাম তারা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, তখন তাদের জীবনধারণ কেমন যেন প্রশ্নবোধক হয়ে গেল। তারা আমাদের সমাজের মানুষ। আমাদের মাঝেই তাদের চলাফেরা। তবুও কেন জানি পৃথক তারা। কেমন জানি মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। এরা সমাজে ‘হিজড়া’ হিসেবে পরিচিত। হিজড়া বলতেই অধিকাংশ সমাজের চোখে ভেসে ওঠে আটপৌরে শাড়িপরা সস্তা মেকআপ আর কমদামি লিপস্টিকে সেজেগুজে দল বেঁধে চাঁদাবাজি করা। পুরুষালি আচরণে নারীর পোশাক পরিহিত একদল লোক। কারও কাছে হিজড়া মানে আতঙ্ক, যৌন বিকৃত একদল মানুষ। হিজড়াদের নিয়ে অনেক কল্পকাহিনী শুনে আমরা বড় হয়েছি।

সমাজের রক্ষণশীলতায় অনেক কাহিনি সামনে আসেনি। হিজড়াদের অনেকে পারিবারিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে। কেউ হয়তো পালিয়ে রক্ষা পেয়েছে। কেউ প্রিয়জনের কাছে নির্যাতিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিয়েছে।

উত্তর পাকিস্তানের নাগরিক ‘মায়া’ একজন হিজড়া। অর্থাৎ পুরুষ হয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু নারীর বেশ ধরে তিনি চলাফেরা করে নারী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। এবং নারীদের মতোই জীবনযাপন করেন। কিন্তু কখনো রক্ষণশীলতা মেনে চলেননি। ফলে নিজ বাড়িতে নির্যাতিত হয়ে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিন তিনবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু পরিবারের লোক তাকে খুঁজে বের করে। শেষ বার পালিয়ে যাওয়ার এক মাসের মধ্যে মায়ার মৃত্যু হয়। তার শৈশবের বন্ধু আক্ষেপ করে বলেন, কিছুদিন আগে আমাদের পরিচয় হলে ভালো হতো। হয়তো এভাবে মৃত্যু হতো না মায়ার।

হিজড়া একটি উর্দু শব্দ, যা সেমেটিক আরবি ‘হিজর’ থেকে গোত্র হতে পরিত্যক্ত অর্থে এসেছে। পরবর্তীতে হিন্দি ভাষায় বিদেশি শব্দ হিসেবে প্রবেশ করেছে। বাংলা ভাষায় হিজড়া বলতে আন্তঃলিঙ্গ ব্যক্তিবর্গকেও বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী, যাদের জন্ম পরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়।

অধিকাংশ হিজড়াই পুরুষালি বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয়। এদের মধ্যে আন্তঃলিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে জন্মগ্রহণকারী খুবই অল্পসংখ্যক। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কিছু হিজড়া সমাজকর্মী ও পশ্চিমা বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) হিজড়াদের নারী বা পুরুষ পরিচয়ের পরিবর্তে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচয়ের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে লবিং শুরু করে। এর ফলে ভারত, বাংলাদেশে হিজড়ারা সরকার কর্তৃক আইনগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। তারা আইনিভাবে পাসপোর্ট এবং অন্যান্য দাপ্তরিক কাজে লিঙ্গ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে একটি তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু, লিখিত স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও তারা পুরুষ বা নারী কোনোটাই নয়। সরকারিভাবে স্বীকৃত হলেও এখনো আইনিভাবে তাদের সুরক্ষিত করা হয়নি।

সম্প্রতি ভারতের কেরালা রাজ্যে হিজড়াদের জন্য একটি স্কুল খোলা হয়েছে। যেসব হিজড়া বাল্যকালে লেখাপড়া করেনি, কেবল তারাই বয়স্ক শিক্ষা পাবে। হিজড়াদের সমাজের সঙ্গে একীভূত করাই স্কুল খোলার উদ্দেশ্য। ভবিষ্যতে তাদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানা গেছে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের রায়গড়ের মেয়র নির্বাচিত হন মধু বাই কিন্নর। তিনিই ভারতে একমাত্র প্রথম হিজড়া মেয়র। হিজড়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে তিনি বিজেপির প্রার্থীকে হারিয়ে দেন।

২০১৫ সালের মে মাসে কলকাতার কৃষ্ণনগরের মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দেন এক হিজড়া। তাঁর সহকর্মীরা, এমনকি শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। পরে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

সম্প্রতি ‘কমন জেন্ডার’ নামে হিজড়াদের নিয়ে বাংলাদেশে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ছবিটি বহুল বাণিজ্যভিত্তিক হবে বলে পরিচালক আশা ব্যক্ত করেছেন। ছবির মূল কাহিনি হচ্ছে, সুস্মিতা নামক হিজড়াকে বিয়ে করে এক হিন্দু তরুণ, কিন্তু তার পরিবার সুস্মিতাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই সুস্মিতা আত্মহত্যা করে। এখনো সমাজে হিজড়াদের বিড়ম্বনা বিবেকবানদের মনে পীড়া দেয়। কোনো শপিংমলে হিজড়াদের মহিলা টয়লেট ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। এই করোনাকালে হিজড়াদের জীবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের বাসা ভাড়া দিতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। পাশের নিম্ন মধ্যবিত্তরা খাদ্য সহায়তা পেলেও হিজড়ারা ত্রাণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে ‘পাথওয়ে’ নামক একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান হিজড়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একবেলা খাবার বিতরণ করে যাচ্ছে। ‘পথওয়ে’ তাদের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণসহ আর্থিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

সৃষ্টির এক অনন্য অবদান হিসেবে হিজড়াদের এককালে সমাজে সম্মান ছিল। কিন্তু এখন পদে পদে হেনস্তার শিকার হতে হয় তাদের। সমাজে তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগও পাওয়া যায়। হিজড়ারা পেটের দায়ে মহল্লায় কিংবা ব্যবসা কেন্দ্রে চাঁদাবাজি করে। নবজাতক শিশুসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে নেচে–গেয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না পেলে নবজাতককে নিয়ে টানাহেঁচড়া করার মতো ঘটনাও দেখা যায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় বহু হিজড়া সম্প্রদায় সঙ্গবদ্ধভাবে বসবাস করে, যা একজন গুরুর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই সম্প্রদায়গুলো পরিত্যক্ত অথবা পরিবার থেকে অবহেলিত হয়ে পালিয়ে কিংবা দত্তক নেওয়ার মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। তাদের রোজগারের প্রায় সব অর্থ গুরুর হাতে তুলে দেয়। আলাদাভাবে জীবনযাপন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ কেউ তাদের বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। এদের অনেকেই বেঁচে থাকার তাগিদে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কেন তারা এমন, কেউ কি ভেবে দেখেছে? তাদের ভেতরে যে রক্তক্ষরণ, না বলা যন্ত্রণা, হৃদয়ে গুমরে ওঠা আকুতি নিয়ে তাদের বেড়ে ওঠা, তা নিয়ে আমরা কেউ ভাবি না। জানা হয় না তাদের জীবনসংগ্রামের গল্প।

হিজড়া সম্প্রদায় মানবাধিকার বঞ্চিত একটি অন্ধকার জগতের বাসিন্দা হিসেবে মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা প্রতিনিয়ত বৈষম্যে শিকার। প্রতিকূল পরিবেশ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠী। সমাজের অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অতি প্রয়োজনীয় বাসস্থান থেকেও তারা বঞ্চিত। তাদের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার—এসব দায়িত্ব বর্তায় রাষ্ট্রের ওপর। সরকারি খাসজমি বরাদ্দ দিয়ে হিজড়া পল্লি আবাসন গড়ে তোলা সরকারের দায়িত্ব। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হিজড়াদের নির্দিষ্ট হারে ভাতার প্রচলন ছিল। যানবাহন চিকিৎসা ও বিনোদনের জন্য সিনেমা হল ফ্রি ছিল। কিন্তু এখন তা শুধুই গল্প।

বাংলাদেশে প্রথমবারের মত জমির প্রামাণিক নামে একজন হিজড়া নিজের উপার্জিত অর্থে হজব্রত পালন করেছেন। আসুন আমরা সবাই মিলে এসব সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সুখে–দুঃখে পাশে দাঁড়াই। তাদের উপহার দিই স্বাভাবিক জীবন।