মাটি হব মাটি, কেন কর কান্নাকাটি?

প্রতীকী ছবি। আন্ডার দ্য শ্যাডো চলচ্চিত্রের দৃশ্য
প্রতীকী ছবি। আন্ডার দ্য শ্যাডো চলচ্চিত্রের দৃশ্য

যে বয়সে শিখি ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ তখন এই লাইনের মর্ম বুঝতে পারিনি। এর আসল অর্থ বুঝতে পারি যখন সাত বছর আগে ক্যানসারের সঙ্গে মোলাকাত হয়। মধ্যরাতে সেজদায় গিয়ে কাঁদতাম, আমার কোলে দুধের শিশু। আরও দশটা বছর জীবন দাও হে জীবনদাতা। মরতে তো হবে একদিন। কিন্তু শিশু একটু বড় হোক।
ওপরওয়ালা ডাক শুনেছেন। কমের মধ্যে সুস্থ করে তুলেছেন। পরে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় স্কুলের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সঙ্গে। তখন জানতে পারি তাদের মধ্যে দুজন ক্যানসার সারভাইভার আমার মতোন। ঢাকায় গিয়ে হইচই করে স্কুল রিইউনিয়ন করি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্কুলের বন্ধুরা এসে যোগ দেয়। কেউ ভুঁড়ি সঙ্গে দাঁড়ি, কারও চুলের অরণ্য হারিয়ে ধু-ধু মরুভূমি, কেউ আবার ইউনিভার্সিটিতে পড়া তরুণ দেখতে। মধ্য চল্লিশের সবাই বয়স চৌদ্দতে ফিরে যাই।
আটাশ বছর পর দেখা হয় রহমান দম্পতির সঙ্গে। সাকিল আর পপি। ক্লাস নাইন থেকে তাদের প্রেম। ইন্টারমিডিয়েটের পর বিয়ে করে দুজন। দুজনের পরিবারই খুব আশাহত হয় তাদের বিয়েতে। তারপর আমেরিকায় দুজন পড়তে যায়, কঠিন সংগ্রামের জীবন। দুই মেয়ে, এক ছেলে হয়। ফুটফুটে পরিবার তাদের। পরিশ্রমের পর সাফল্যকে ছুতে পেরেছিল। তাদের সাফল্য দেখে খুশি হই। পপিকে খুব ভাগ্যবতী মনে করি। দেখতে তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নিজের দুই মেয়ের সঙ্গে দাঁড়ালে তিনজনকে এক রকম লাগে। শরীরচর্চা পপির বিশেষ শখ। বুঝলাম তার তারুণ্যের রহস্য।

রিইউনিয়ন শেষে লন্ডন ফিরে আসি। রহমান দম্পতি সিঙ্গাপুর থেকে সমুদ্রে ক্রুজে যান। ফেসবুকে তাদের হলিডের দুর্দান্ত ছবি দেখি। আমরা প্রবাসী। কিন্তু অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক। রহমান দম্পতি প্লেনের ফার্স্টক্লাসে চড়েন, অবকাশ যাপনে পৃথিবীর পাঁচতারা হোটেলে থাকেন, বাংলাদেশে সহজেই ছুটি কাটান ছয় মাস। তাদের গাড়ি বিএমডব্লিউ, বেনটলি।
অন্যদিকে আমি প্লেনের অফ সিজনের ইকোনমির সস্তার টিকিট খুঁজি, নয়তো কোথাও যেতে পারি না। জিনিসপত্র কিনতে চাইলে সেলের জন্য অপেক্ষা করি। কবে দাম কমবে? দেশে গেলে তিন সপ্তাহের বেশি থাকতে পারি না। কাজের জন্য, রুটি রুজির জন্য ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরে আসতে হয়। আমার গাড়ির ২০০৪ সালের ফক্সওয়াগন। গ্যারেজের লোকজনের সঙ্গে খাতির, তাদের কাছে গাড়ি নিয়ে প্রায়ই যেতে হয়।
সব বৈষম্যের দেয়াল ভেঙে আমাদের বন্ধুত্ব টিকে থাকে। এই দম্পতি অনেক প্রিয় আমার। দুজনই আমুদে, অতিথিপরায়ণ, পরোপকারী। ফোনে যোগাযোগ না থাকলেও প্রতিদিন আমাদের ফেসবুকে যোগাযোগ হয়। তাদের নিয়ে গর্ববোধ করি। ​হঠাৎ​ একদিন এক কান্নার খবর শুনি। পপির ক্যানসার। পাকস্থলীর ক্যানসার। ফোর্থ স্টেজ। তার একটা টিউমার ১১.৫ সেন্টিমিটার।
সার্জারি আর কেমোর পর তার চুল পড়ে যেতে থাকে। আমি ভয়ে তার খোঁজ নিই না। জায়নামাজে তার জন্য হাত তুলি। বলি, আল্লাহ তার ছোট্ট নয় বছরের ছেলের দিকে তাকিয়ে তাকে সুস্থ করে দাও। আমার নিজের জন্য যেমন প্রার্থনা করি বা করতাম সেই রকম। ভাবতে পারি না মা ছাড়া আমাদের শিশুরা এতিমের মতন বড় হবে। দুনিয়ার সব ঐশ্বর্য জড় করলেও তাদের শৈশবে মা হারানোর শূন্যতা পূরণ হবে না। খুব ভাবি এখন আমাদের জীবনের সুস্থতা কত প্রয়োজনীয়! যাদের পিছুটান নেই, তাদের কথা আলাদা। আর ভাবি আমাদের গর্ব, আভিজাত্য সবকিছুর ওপর মৃত্যু হাসে।
বাংলাদেশে কথায় কথায় অনেকে বলেন, চিনিস আমি কে? রিকশাওলাকে চট করে থাপ্পড় দেন তার রূঢ় কথা পছন্দ না হলে। চিন্তা করেন না তার মতোন পড়াশোনা থাকলে, প্লিজ, থ্যাঙ্কিউ, সরি এই তিন ম্যাজিক শব্দ দিয়ে রিকশাওলা কথা শুরু আর শেষ করত। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও হাসিমুখে কোমল আচরণ করতে খুব কম মানুষকেই দেখি। নমনীয়তা কোনো দুর্বলতা নয়। এটা সহজাত থাকা উচিত ব্যক্তি জীবনের অনেক সাফল্য না থাকলেও। নিজে সুখে নাই, সেটা মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে বোঝাতে হবে কেন? আমাদের হতাশা ঝাড়ার জন্য আছে শিশু আর গরিব লোকজন। সহজেই ঝাড়ি দেওয়া যায়।
ক্যানসার আমার মতন ওয়ার্কিং ক্লাস, পপির মতন উচ্চবিত্ত বা ঢাকায় আমার বাড়ির সামনের বস্তির দিনমজুরেরও হয়। ক্যানসার ক্লাস দেখে না। শিল্পী, সেলিব্রিটি, গৃহবধূ, ব্যবসায়ী, কোটিপতি, চিকিৎসক—যে কারও কাছে সে যেকোনো সময় আসতে পারে। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘হরি বোল’ বা ‘ডাস্ট টু ডাস্ট’ বলবে আরেকজন, আর দেহ ছাড়ব আমরা। আমাদের কীসের এত অহংকার? কিসের এত লোভ? চিন্তা করি। মৃত্যু ভয়ে নির্দোষ আনন্দ ত্যাগ মহামূর্খতা।
কিন্তু আরও চাই, আরও, আরও যেকোনো কিছুর বিনিময়ে নদী-জঙ্গল, মানুষ মেরে—সব ধরনের অন্যায়, তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
সবশেষে প্রিন্সের সুর করা সেই গান—মাটি হব মাটি, কেন কর কান্নাকাটি?