মরুভূমির মরিয়ম যেভাবে চম্পাফুল হলো

চম্পা
চম্পা

সাত বছরের একটা মেয়ে। অপরিচ্ছন্ন চুল, আধময়লা জামা, হাতের আঙুলে মজুত করা কাদামাটি। আমাদের বাসায় যেদিন সে আসে আব্বু রেগে আগুন। আম্মুকে ডেকে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হইছে কুসুম?

আব্বুর ভাষ্যমতে মাথা খারাপ আম্মুর মাথা আসলে চিরকালই বরফ পানি। তার উত্তরে আম্মু শীতল কিন্তু দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ওর মা দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা অন্তত বাঁচুক। খাবারের কষ্ট তো করবে না। তা ছাড়া কিছু টাকা যদি ওর বিধবা মায়ের হাতে আসে তবে উপকার হয় খুব। ওর মায়ের মুখের এই কথা। বাবাহীন মেয়েটার আরও ভাইবোন নিয়ে মরুভূমির মতো অর্থের সংকটে খাঁ খাঁ করছে তাদের সংসার। সেখানে এই মরিয়ম ফুল তো প্রয়োজন মতো পানি পাচ্ছে না ফুটতে।

হ্যাঁ, আমাদের বাসায় মেয়েটা যখন আসে তখন ওর নাম ছিল মরিয়ম। অন্যায় বলতে ওটুকই, ওর নাম বদলে চম্পাকলি রাখা হয়। চম্পা নামে একটা আদর আদর ভাব আছে। নামের মাঝে আদর বসানো আম্মুর পুরোনো অভ্যাস। আমাদের কত হাবিজাবি বিশ্রী নাম আছে! তবুও অন্যায় করলে নিজের সন্তানকে ধরে উম্মুর ধুম্মুর দেওয়া যায়, কিন্তু চাইলেই কী এই মহৎ কাজটা অন্যের সন্তানকে অ্যাপ্লাই করা যায়!

নতুন নামের মেয়েটা খুব স্বচ্ছন্দে নামটিতে সাড়া দিল।

কেউ মরিয়ম নামে ডাকলে আপন ইচ্ছায় ঘাড় বাঁকিয়ে রাখে! চম্পা এত ছোট যে, বিছানায় প্রাকৃতিক কাজ করে। সন্ধ্যা নামতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ে। রাতের খাবারের আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে না খেয়ে ঘুমালে এক চড়ুইয়ের মাংস কমে যায়। আমার আম্মুর কুসংস্কার মুক্ত মন সব ভুল সংস্কার ছুড়ে ফেললেও এটাকে ফেলেনি। মাতো! তো চম্পাকে রাতের খাবার খাওয়ানোর জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করা লাগে। আম্মুর চূড়ান্ত নির্দেশ রাতে না খেয়ে ঘুমানো তার ইতিহাসে চলবে না। আমাদের বুয়া সে যুদ্ধটা করত। মাঝে মধ্যে খুব মেজাজও দেখাত। আঞ্চলিক ভাষায় আম্মুকে বলত, খালাম্মা কী শুরু করলেন আপনি! এই সব আন্ডা বাইচ্চা হালন সম্ভব ন।

আম্মু ঠান্ডা গলায় বলতেন, দুই দিন পর তোরই কাজে আসবে। এরে চিল্লাচিল্লি চুপ করলি মাফুজা। আমরা সবাই আবার মাহফুজাকে একটুসখানি ভয় পাই। রান্নাঘরের যোগাযোগ মন্ত্রী বলে কথা। খ্যাতি আছে আমাদের ঘরে তার শাসনামলের চৌদ্দ বছরই উন্নয়নের জোয়ার। আমাদের পাকস্থলীর উন্নয়ন আর কী!

অতঃপর চম্পা নামের মেয়েটা আস্তে আস্তে বড় হয়।

টুকটাক ফুট ফরমাশ ধরে। দুই–একটা দুধ দাঁত পড়ে। আম্মুর গোপন পরামর্শ অনুযায়ী আব্বু ডাকলে যেখানেই থাকুক, দৌড়ে গিয়ে, জি মামা দুবার বলে। তবুও আব্বুর অভিযোগ কুসুম বাগানের সাগরেদ নাকি, শুধু কুসুম বাগানের কাজই করে। ঘরের সব উজির নাজির নাকি শুধু কুসুম বাগানের খেদমতে ব্যস্ত। আব্বুর দুই পয়সার কাজেও আসে না!

এদিকে কাজের মধ্যে চম্পার প্রধানতম কাজ ছিল বিকেলবেলা দোকান থেকে বিস্কুট আর কেরোসিন আনা। বাসার সঙ্গেই আম্মুর চেম্বার ও হাসপাতাল। তাই সার্বক্ষণিক মানুষের যাতায়াত আমাদের বাসায়। তাদের সঙ্গে নম্র করে কথা বলা। আর আমাদের হাইপার বুয়াকে একটু হেল্প করে, সঙ্গ দিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখা। কখন কোনো মানুষরে আবার ঝাড়ি দিয়া বসে কে জানে!

লেখিকা
লেখিকা

এভাবে দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। দূর দূরান্তে বসত গড়া আমাদের সন্তানবিহীন ঘরটাতে ছোট্ট একটা মেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, ভুল করছে, তার ভুল শুধরে দেওয়ার জন্য ঘরে এক আধটু চিল্লাচিল্লি হচ্ছে। আমাদের পুকুরের মতো নিশ্চুপ হয়ে থাকা ঘরটাতে শিশুর ঝমঝম হচ্ছে! চম্পার মাও সেই ঝমঝমে দুই–একটা দিন থেকে যাচ্ছে। তবে মাঝেমধ্যে এর কিছুই হচ্ছে না। কারণ এর মাঝেই এক–দুই মাস অন্তর অন্তর চম্পা বোনের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে। এমন এক চৈত্র মাসে মায়ের সঙ্গে চম্পা বেড়াতে গেল। নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেল। এল না। আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। আম্মুকে বলি, আশা ছেড়ে দেন, আসবে না।

এক মাস পরে। হঠাৎ একদিন মায়ের হাত ধরে চম্পা হাজির। বাসায় এসে ধুপ করে টেবিলের নিচে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে এসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে আঞ্চলিক ভাষায় বলতে থাকে, ওরে মারে মারে আপু রে আই আর যাইতাম নো আঙ্গ বাড়িত। এগুন উগ্গা উগ্গারে মারে। সেই মুহূর্তে কে কাকে মারে সেই মারামারির মামলায় আম্মু আর গেলেন না। শুধু তাৎক্ষণিকভাবে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন চম্পা আবার এল বলে।

কিন্তু একদিন কাল হলো, আমাদের বাসায় আমার খালামণি বেড়াতে এলেন। আসার পথে তিনি দোকান থেকে নয় বছরের চম্পাকে কান ধরে আম্মুর সামনে এনে দিলেন এক হালকা আছাড়। খালামণি আম্মুকে শাসিয়ে বললেন, আপা, কী মেয়ে রাখছেন? আসার পথে দেখি সে দোকানদারের কোলে উঠে বসে আছে। তদন্তে বেরিয়ে এল দোকানদার নাকি তারে চকলেট মকলেটও দেয় ঘরের সমাচার জানতে। ওই যে একদিন তোঙ্গ ঘরে ঢেউখেলানো চুলের কে যেন হাঁটছিল, সে কে ছিল? তদন্তে সেসব জিজ্ঞাসাবাদও বাহির হইল! তারপর সেদিন থেকেই চম্পাকে দোকানে পাঠানোর ইতি হলো।

এমন করেই চম্পা একটু একটু করে বড় হয়। বড় হতে হতে চম্পা আমাদের মুরগির রিস্তায় ডাকে। মুরগির রিস্তা আঞ্চলিক ভাষা। অর্থাৎ ঘরের প্রতিটা সদস্যকে যুক্তিহীন যা ডাকতে ইচ্ছা তাই ডাকা। সেই সূত্রে আম্মুকে আপু, আব্বুকে আবার মামা। আর আমাদের খাম্মি ডাকে।

এমন করেই আজ অবধি। দিনে এক চিমটি আন্দাজে চম্পা বড় হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেই। সাধারণত ঘরের ছোট মেয়েরা ছোট কারও বড় হওয়া দেখে না। আমাদের ভাগ্য ভালো আমরা তা দেখতে লাগলাম। ফ্রক, জামা, স্কার্ট, বাবরি চুল। আমাদের ছোটবেলায় করা সবকিছুর প্রয়োগ দেখতাম। চম্পাকে নিয়ে আম্মু অহর্নিশ করছেন। দূরদূরান্তে থাকা আমরাও শান্তি পাই এসব দেখে।

এভাবেই বিছানায় প্রাকৃতিক কর্ম সারার দিন শেষ হয় চম্পার। চম্পার বয়স বারো কী তেরো, হঠাৎ কেমন খারাপ আচরণ করছে। আমরা হতাশ! আম্মুকে বলি, আম্মু হবে না। কয়লা ধুইলে কী ময়লা যায়? আম্মু স্থির কণ্ঠে বলেন, বয়স, সন্ধিকাল। ঠিক হয়ে যাবে।

সেই কালও অতিক্রান্ত হয়। ষোড়শী চম্পা। অষ্টাদশী চম্পা।

একটা লক্ষ্মী মেয়ের যত গুণ আছে আমাদের চম্পার তার সব আছে। প্রবল ব্যক্তিত্বও আছে। ঝাঁঝ এত! কি লাগবে তোর বললে নিস্তরঙ্গ ভারী কণ্ঠে বলবে, কিচ্ছু না। আছে সব। চম্পা হলো আমাদের ঘরের ফায়ার সার্ভিস। আমাদের যখন যার একা লাগে চম্পাকে আম্মু দুই দিনের জন্য ধার দেন আবার দিয়ে দেওয়ার শর্তে! আমরাও খুশি মনে সার্ভিসের শর্তে সাইন করি।

দেখতে দেখতে সেই হাতের আঙুলে মজুত করা কাদামাখা ছোট্ট মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেল। সেই কাদামাখা নখে সে এখন যত্ন করে নেইল পলিশ মাখে। শাড়ি চুড়ি পরে। সাজগোজের বক্সে সতর্ক পাহারা রাখে। বানান করে করে পত্রিকা পড়ে।

এবার আম্মুর অন্য চিন্তা। বিয়ে তো দিতে হবে। আম্মু আরও চান, বিয়ে দিয়ে আমাদের কাছাকাছিই যেন থাকে চম্পা। তাই প্রস্তাব দিলেন আব্বুকে। বেয়াই হওয়ার প্রস্তাব! আব্বুর স্টিল ফার্নিচারের ইন্ডাস্ট্রিতে আব্বু একটা ‘চমক’ বড় করেছে। একেবারে ছোট থেকে। সে এখন রাজকারিগর। প্রধান ম্যানেজার। খুব ভালো ছেলে। তাহলে? হোক না, কিন্তু। হ্যাঁ, কিন্তুরা তো এই দুনিয়াই কম নাই।

চমকের প্রফেশনাল অভিভাবক আব্বু। আব্বু রাজি। কিন্তু প্রফেশনাল অভিভাবকের সম্মতি থাকলেও ভালো ছেলের মা–বাবা কি রাজি হবে? শুনেছি ছেলেটার মা রাজি না। চম্পা যে আমাদের বাসায় একটা সময় কাজের জন্য...এই ভাবনা ওর মা এনেছিল। সে পরিচয়ে সে আমাদের কাছে নেই। তবুও আমরা অনেক কিছুই জয় করতে পারি। মানুষের অন্তর্গত ভাবনা তো আমাদের আওতাহীন। তবুও আমরা আওয়াজ করে বলি, কাজের মেয়ে হওয়া ভালো, অকাজের মেয়ে হওয়াটা তো কোনো কাজের কথা না! আমরা সবাই কাজ করি। কেউ অফিসে, কেউ আদালতে। কেউ ঘরে, কেউ বাইরে। তবুও ওই যে অন্তর্গত জগৎ সেখানে সে আওয়াজ সব সময় পৌঁছায় তা তো না। চাইলেই তা আমরা বদলে দিতে পারি না। বাস্তবতা তো ভিন্ন।

তবু স্বপ্ন দেখি খুব...

চম্পার বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ আসা আনন্দের মতো হঠাৎ কিছু ঘটে যাবে। আব্বু–আম্মু নিজেরা নিজেরা বেয়াই বেয়াইন হবেন। আমাদের ঘরের সর্বশেষ মেয়েটার বিয়েতে তুমুল আনন্দ করবার কত স্বপ্ন আবির মাখা এই দুই চোখে!
...
জাহান রিমা: ইমার্জেন্সি ডেন্টাল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র।