মন খারাপের ঈদ

করোনাভাইরাস
ছবি: রয়টার্স

ঈদ সামনে এলেই এখনো আমাদের সময়ের প্রাথমিকের বাংলা পাঠ্যপুস্তকের একটা গল্পের প্রথম কয়েকটা চরণ মাথায় এসে ভিড় করে। গল্পের নামটা আজ আর মনে নেই, যত দূর মনে পড়ে গল্পটার নাম ছিল ‘মহানবীর দয়া’। গল্পের প্রথম কয়েকটা চরণ ছিল এমন, ‘আজ ঈদ। মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে শিশুদের কলরব।’ এ চরণগুলোর পাশাপাশি মনে পড়ে শৈশবের আমাদের অনাড়ম্বর কিন্তু অনাবিল আনন্দের ঈদের দিনগুলোর কথা। সারা বছর আমাদের জন্য নতুন জামাকাপড় যা–ই কেনা হোক না কেন, ঈদ সামনে রেখে নতুন জামাকাপড় কিনে দেওয়া হতো। আমরা সেগুলো পরেই ঈদগাহে যেতাম আব্বার হাতের আঙুল ধরে। নামাজ শেষে ঈদগাহের বাইরের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো থেকে কিনে দেওয়া হতো মিষ্টি স্বাদের বিভিন্ন রঙের বাহারি আকৃতির নিমকি। এভাবেই একটা ঈদের দিন দেখতে দেখতে পার হয়ে যেত।
এরপর একটু বড় হয়ে গেলে পাড়ার মোড়ে সবাই মিলে চলত চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতা। কোনো কারণে চাঁদ না দেখা গেলে ভরসা ছিল রেডিও এবং পাড়ার একমাত্র সাদাকালো টেলিভিশন। ঈদের ঘোষণা আসার পর একধরনের উত্তেজনা নিয়ে আমরা ঘুমাতে যেতাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে আগেভাগেই তৈরি হয়ে থাকতাম আমরা। আব্বা তৈরি হওয়ার পর সবাই মিলে একসঙ্গে ঈদগাহে গিয়ে জামাতের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করা, তারপর ঈদগাহের বাইরের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে বাসায় ফেরা। এরপর একেবারে নিজেদের ইচ্ছেমতো খেলাধুলা করে একটা দিন পার করে দেওয়া।

ঈদের সময়ের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিল সবার সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ। পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন কাজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকলেও ঈদের আগে আগে বাড়ি আসা চাই–ই চাই। ঈদের আয়োজন যা–ই হোক না কেন, পরিবারের সঙ্গে সেটা ভাগ করে নেওয়াটাই ছিল ঈদের আসল উপলক্ষ। অনেকেই সারা বছর বাসার বাইরে বাইরে থাকতেন কিন্তু ঈদের সময় হলে ঠিকই বাসায় চলে আসতেন। আমাদের আব্বা একটা সময় মাথায় করে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করতেন। সেটা করতে গিয়ে কখনো মাস বা কখনো তার চেয়ে বেশি সময় বাসার বাইরে থাকতেন কিন্তু ঈদের আগে ঠিকই বাড়ি চলে আসতেন আর আমাদেরকে কুষ্টিয়ার বড় বাজারে নিয়ে যেতেন ঈদের পোশাক কিনে দিতে। যাদের নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাদের কাছে ঈদের সময়ে সবার এই মিলিত হওয়াটাই ছিল সবচেয়ে বড় উপলক্ষ। সবাই একত্র হয়ে দুঃখ–বেদনা ভাগাভাগিতেও যেন ঈদের আনন্দ।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শহর ও গ্রামের জীবনযাপন প্রণালির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শহর ও গ্রামের মধ্যে একটা দেয়াল আছে, যেটা ভেদ করে শহুরে আভিজাত্য যেমন গ্রামে ঢুকতে পারে না, ঠিক তেমনি গ্রামের স্নিগ্ধতা শহরকে স্পর্শ করে না। শহরের সবকিছুই কেন জানি বড্ড মেকি, বড্ড লোকদেখানো।

শহরের কাজকর্মের বেশির ভাগই করা হয় স্ট্যাটাস রক্ষা করতে বা পাছে লোকে কিছু বলবে—এমন ভয়ে। এ ছাড়া তৈরি হয়েছে একটা মেকি সভ্যতার। শহুরে মানুষদের ধারণা, এই ধরাধামে শুধুই তাদের রাজত্ব আছে বাকিদের কোনো অস্তিত্বই নেই। এরপরও একসময় মানুষকে গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর হতে হয় জীবিকার প্রয়োজনে; কারণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যাংক, বিমা, বাণিজ্যিক সব প্রতিষ্ঠান শহরে অবস্থিত। তাই বলা হয়, শহরের বাতাসে টাকা ওড়ে, আর সেই টাকায় গ্রামের মানুষকে শহরে টেনে আনে।

এ ছাড়া মানুষ গড়ার সূতিকাগার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গ্রামে অবস্থিত। আমার ধারণা, একজন মানুষ যদি গ্রামে থেকে ন্যূনতম জীবিকা আহরণ করতে পারতেন, তাহলে হয়তোবা শহরে যেতেন না। অবশ্য আরও একটা কারণ আছে, সেটা হলো পড়াশোনা শেষ করতে গিয়ে শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াকালীন মনের মধ্যে শিক্ষিত হয়ে যাওয়ার যে অহমিকা তৈরি হয়, সেটাও একটা বড় কারণ শহরে আসার। কারণ, তখন গ্রামের মানুষ ‘অশিক্ষিত, গাইয়া’ বলে প্রতীয়মান হতে থাকে। শিক্ষিত মানুষ আর গ্রামের ভাষায় কথা বলে শহুরে মানুষের কাছে নিজের সম্মান খুইয়ে ফেলতে নারাজ। এ ছাড়া অনেককেই দেখা যায় নিজেদের পূর্বপুরুষের পেশার কথা লুকাতে। একজন কৃষকের সন্তান হয়ে শিক্ষিত হওয়াটা আর তখন গর্বের থাকে না, হয়ে যায় লজ্জার। ব্যাপারটা এমন যে শিক্ষা ব্যাপারটাই যেন শহুরে মানুষদের জন্য নির্ধারিত। সেখানে গ্রামের গরিব লোকজনের ছেলেমেয়ে কীভাবে পড়তে আসবে। তাদের না আছে সচ্ছলতা, না আছে মানসিকতা।

যাহোক, তবু মানুষকে শহরে আসতেই হয়, কিন্তু তাদের মনটা পড়ে থাকে গ্রামের বাড়ির শীতল ছায়ায়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিদিন হাজারো মানুষ জীবিকার টানে ঢাকা শহরে আসছে, কিন্তু ঢাকা শহরের অপ্রতুল ব্যবস্থা তাদের কোনো স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তারা হয়তোবা কোনো একটা কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে, কিন্তু প্রহর গুনতে থাকে কবে গ্রামের বাড়িতে স্বজনের কাছে ফিরে নির্মল বাতাসে বুকভরে শ্বাস নিতে পারবে। তাই যখনই কোনো বড় ছুটির উপলক্ষ আসে, তখন শহরের মানুষ দলে দলে শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পাড়ি জমায়, আবার ছুটি শেষ হলে দলে দলে শহরে ফিরে আসে। এভাবেই চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের জীবনধারা। এর মধ্যেই অতিমারির মতো মহামারি এসে আঘাত হানল পুরো পৃথিবীতে।

এই অতিমারি এমন একটা বিষয়, যেটার সঠিক প্রতিকারের উপায় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি বলা যায়, তবে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

প্রতিরোধের সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে ঘর থেকে বের না হওয়া কিন্তু মুশকিল হলো দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো নিয়ে। তাদের পেটের দায়ে ঘরের বাইর যেতেই হচ্ছে। যদিও কর্ম অনেক কমে গেছে। তবে সবচেয়ে মুশকিল হলো পোশাক কারখানার কর্মীদের নিয়ে। মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সমালোচনার মুখে আবারও কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হলো। তখন পোশাক কারখানার কর্মীরা পড়লেন উভয়সংকটে। ঘর থেকে বের হলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় কিন্তু আবার কাজে না গেলে পেটে ভাতও জুটবে না। অবশেষে কারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। কারণ, করোনা মাফ করলেও ক্ষুধা এই মানুষগুলোর নিত্যসঙ্গী।

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি

এভাবে চলতে চলতেই একসময় সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ সবার সামনে এসে হাজির হলো। ইতিমধ্যে পাশের দেশ ভারতে নির্বাচনের ডামাডোলে এবং কুম্ভমেলার বদৌলতে অতিমারি মহামারির আকার নিয়েছে। তাই বাংলাদেশ সরকার জনসমাগম এড়ানোর পন্থা হিসেবে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ করে দিল যেন শহরের মানুষ দলে দলে গ্রামে ফেরা থেকে বিরত থাকে এবং অতিমারির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, কেন গ্রামের মানুষকে শহরে আটকে রাখা সম্ভব নয়, বিশেষ করে উৎসবের দিনগুলোতে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবার তাদেরকে অশিক্ষিত, গাইয়া, মূর্খ বলে শুরু হলো গালিগালাজ। আমি এখন পর্যন্ত একেবারে হাতে গোনা দু–একজনের পোস্ট দেখেছি, যারা শহর ছেড়ে গ্রামে আসার এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কয়েক মানসিক রোগের ডাক্তার ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের মহান বানানোর উপলক্ষ খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু কেউই মূল কারণটা বলেননি।

সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়ায় মানুষের এই উৎসবযাত্রা রীতিমতো ভোগান্তিতে রূপ নিল। যেহেতু সব পরিবহন বন্ধ, তাই তাদেরকে ফিরতে হলো হেঁটে।

এরপর নদী পারাপার হতে হলো ফেরিতে চড়ে। আগে যেখানে ফেরিতে বাস থাকত, এবার সেখানে দেখা গেল হাজারো মানুষ। মানুষ যে যেমনভাবে পেরেছে ঠেলে ধাক্কায়ে ফেরিতে উঠেছে। ফেরিঘাটগুলো রূপ নিয়েছিল এক একটা জনসমুদ্রের। যাঁরা হেঁটে ফেরিতে ওঠার সুযোগ পাননি, তাঁরা ফেরি বেঁধে রাখার দড়ি ধরে ঝুলে ফেরিতে উঠছেন—এমন সব ছবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। একটা ছবিতে দেখলাম, একজন বাবার তাঁর সন্তানদের জন্য কেনা পোশাকের ব্যাগটা পানিতে পড়ে গেছে, তাই তিনি নদীতে লাফ দিয়ে সাঁতরে সেই ব্যাগ ধরতে গেছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, বছরের এই একটামাত্র দিন তিনি তাঁর সন্তানদের হাসিমাখা মুখ দেখার আশায় পোশাকগুলো কিনেছিলেন। তাই তিনি কোনোভাবেই সেগুলো হারাতে চাইছিলেন না।

যাহোক, একইভাবে এই মানুষগুলো একসময় ফিরেও আসতে শুরু করল। তখন আবার নতুন করে তাদেরকে তুলাধোনা করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। যাহোক, শহরের মানুষদের জীবনে আসলে তেমন কোনো বিনোদন নেই, নেই কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা। তারা দিনে দিনে এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছে যে তাদের বাইরেও যে বাংলাদেশে বিশাল অভাবী জনগোষ্ঠী আছে, সেটাকে মোটামুটি অস্বীকারই করে চলে হরহামেশা।

তাই গ্রামের মানুষদের এহেন আচরণ নিয়ে মুখরোচক গল্প রচনা করে বিনোদনের উপকরণ খোঁজা হলো। এভাবেই আসলে চলবে বাংলাদেশের জীবনপ্রণালি। আমি ব্যক্তিগতভাবে দু–একবার ঢাকা শহরে ঈদ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ঈদের দিনটা এলে কতটা মন খারাপ হয়। মনে হয় শহরের এই চাকচিক্য দিয়ে কী হবে, যদি আনন্দ উপকরণগুলো পরিবারের সবার সঙ্গে ভাগ না করে নিতে পারি।

প্রবাসী হওয়ার পর গ্রামের মানুষদের সঙ্গে আত্মিক বন্ধনটা আরও দৃঢ় হয়েছে। এখন প্রতিক্ষণে তাদের অনাড়ম্বর জীবনযাপন প্রণালি অনুভব করি। গত ডিসেম্বরে দেশে যাওয়ার জন্য টিকিটও করে রাখা হয়েছিল অনেক আগে থেকেই, কিন্তু অতিমারি এসে সব ভন্ডুল করে দিল। আমি নিশ্চিত, যদি ঢাকা শহরে থাকতাম, কোনো প্রতিবন্ধকতাই আমাকে ঢাকায় আটকে রাখতে পারত না—হোক সেটা অতিমারি বা পরিবহন বন্ধ।

এবারের ঈদটা তাই মন খারাপের ঈদ প্রথমত দেশে যেতে না পারার আক্ষেপে, দ্বিতীয়ত শহুরে মানুষদের গ্রামের মানুষদের নিয়ে এমন স্থূল ঠাট্টা–মশকরা করা দেখে। তবে সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে, যাদেরকে নিয়ে এই ঠাট্টা–মশকরা করা হলো, তাদের বেশির ভাগেরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চালানোর মতো দক্ষতা বা শিক্ষা নেই। তাই এতে তাদের কেশাগ্রও বাঁকা হয়নি। তারা উৎসবের দিনে তাদের স্বজনদের কাছে ফিরে গেছে আনন্দ–দুঃখ ভাগাভাগি করতে। কারণ, সবাই মিলে ভালো থাকাটাই হলো আসল ভালো থাকা।