মনের ‘স্ক্রিপ্ট রাইটিং’

না, এটি নাটক, সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটিং নয়। এটি বাস্তবে, আপনি প্রতি মুহূর্তই একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন, আমি তার কথা বলছি। এই যে ভোরবেলা স্বাদের নাশতা তৈরি করতে করতে আপনি খুব খুশি। পতিদেব খেয়ে নিশ্চয় একেবারে আশ্চর্য হয়ে যাবে মুগ্ধতায়। বলবে, তুমি বানিয়েছ? কিন্তু আপনার লেখা অনুসারে বাস্তবে কিছুই হবে না। অফিসে যাবেন বেচারা এত তাড়াহুড়ো করে খেয়েছে যে, কী খেয়েছে সে নিজেই জানে না। আপনি হয়তো জিজ্ঞেস করলেন, খাবার কেমন হয়েছে? সহজ সরল ব্যক্তি যে আপনার নার্ভ পড়তে পারেনি, বলবে, হয়েছে এক রকম বা বলে ফেলল, মুখ ফসকে আমার মায়ের মতন হয়নি।

আপনি ধরে নিয়েছেন, সে আপনাকে এটি আঘাত দেওয়ার জন্য বলেছে। এই আঘাত আপনাকে আরও বড় ধরনের নাটকীয় দৃশ্য সারা দিন লিখাবে। এমনও হতে পারে, দুঃখে আপনি নাকের জল, চোখের জল এক করে বসে আছেন। ভেবেছেন, দিন শেষে সে এসে ‘সরি’ বলবে, অভিমান ভাঙাবে। কিন্তু সে যখন এল, সে তো সব ভুলে গেছে। আপনার গোমড়া মুখ দেখে উল্টো প্রশ্ন করল, কী হয়েছে? মুখ এমন কালো কেন?

কত বড় সাহস? নিজে অপরাধ করে এখন সে ভুলে গেছে। তখন আপনার চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রার মেজাজ চড়ে এক শ ডিগ্রি হলো। এ সবকিছুর মূলে কিন্তু আসলে ওই বেচারা স্বামী বা পরিবারের কেউই না। আসল ক্রিমিনাল আপনার মনে মনে তৈরি করা চিন্তার স্ক্রিপ্ট, যা আপনার বাস্তবের সঙ্গে একটুও মেলেনি। যদি মিলতো তবে আপনি অবশ্যই খুশিতে গান গাইতেন-

‘আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে’

মানুষের মন এক বিচিত্র জগৎ। এখানে কয়েক সেকেন্ডও জীবনের বিশাল নাটক প্লে করা যায়। সে হোক অতীত, হোক বর্তমান, হোক ভবিষ্যৎ। নিজের অজান্তে প্লে বাটন অন হয়ে যায়? সব সময় অটো মুড অন করা। আপনি বুঝতেও পারবেন না, সে কোন চিন্তা থেকে কোন চিন্তায় চলে গেছে। এ চিন্তা দিয়ে আপনি চাইলে মঙ্গল গ্রহেও পৌঁছে যেতে পারেন। মনের এই অস্থিরতার জন্য মনকে বানরের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এ মন, চিত্ত স্থির করা সাধনা, অনুশীলন ছাড়া সম্ভব নয়। একটা নির্দিষ্ট দিকে মনকে তৈরি করা একটু কঠিন বটে। তবে তৈরি করে ফেললে জীবন সহজ হয়ে যায়।

মনের কাজই হচ্ছে চিন্তা করা এবং যার বেশির ভাগ হচ্ছে দুশ্চিন্তার সঙ্গে জড়িত। মন যদি সাবলীল না হয়, তার মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। যাকে বলে রেস্টলেস মাইন্ড বা বিশ্রামহীন মন। সে তখন নানা দিক থেকে লিখতে থাকে কাহিনি। এবং এর ওপর সম্পর্কের সরলতা, জটিলতাও তৈরি হয়। কারণ, আমরা নিজের অজান্তে অতি প্রিয়জনের বিরুদ্ধে ক্রিটিক্যাল চিন্তা শুরু করি। অথচ এর প্রভাব পড়ে বাহ্যিক ভালো ব্যবহারের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। মন একসঙ্গে দুটি চিন্তা তৈরি করে। এটি এ রকম হলে সঙ্গে সঙ্গে বলে, যদি অন্য রকম হয়? কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে না, আসে লাগামহীন ভাবনা। নিজের মনের চাহিদা চলতে থাকে দৃশ্যের পর দৃশ্যজুড়ে। নিজের বানানো দৃশ্যের সঙ্গে যখন কিছু মিলে না, তখন মানুষের মন আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি হয়। এ বানানো দৃশ্যকে বলা হয় স্ক্রিপ্ট রাইটিং। নারী-পুরুষ সবার ক্ষেত্রেই এ ধরনের ব্যাপার ঘটে। আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক—

আমি আমার বান্ধবীর বাসায় জন্মদিনের দাওয়াতে যাচ্ছি। যেতে যেতে আমি ভাবলাম, আমি যেতেই সে আমাকে একটা বড় ধরনের সংবর্ধনা দেবে। ভাবতে ভাবতে আমি তৈরি হচ্ছিলাম, গিয়েই ওকে জড়িয়ে ধরব। অনেক কথা বলব। ও হয়তো আমাকে এক কাপ স্পেশাল কফি খাওয়াবে। মনের মধ্যে নিজেকে অন্য রকম এক অনুভূতি দিয়ে রেখেছি। নিজের মনে আমি বিশাল স্ক্রিপ্ট লিখেছি। পথে আমার ট্রাফিক জ্যামে পড়ে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে। ওদের বাসায় গিয়ে দেখলাম, ওর জন্মদিনের কেক কাটা শেষ হয়ে গেছে। সে আমাকে হাই বললেও আমার দিকে তার কোনো নজর নেই। সে অন্য অতিথিদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত। আমি যা ভাবতে ভাবতে আসছিলাম, এ রকম কিছুই হয়নি। সবার সঙ্গে সাধারণ অতিথির মতন কিছু খাবার দেওয়া হলো। তারপর আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হলো। মনে মনে ধরে নিলাম, সে আমাকে অবহেলা করেছে। তার মূল কারণ আমি যা ভেবেছিলাম, সে রকম কিছুই হয়নি। নিজের মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। ওপরে হালকা হাসি দিয়ে ভেতরে অনেক কষ্ট সঙ্গে নিয়ে ফিরলাম। নিজের পারিবারিক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আচার–অনুষ্ঠানে এ রকম অনেক ব্যাপার ঘটে, যার জন্য আসলে কেউ দায়ী না।

এখন আমি বিশ্লেষণ করি পুরো ঘটনাটা। কষ্টটা কি সে আমাকে দিয়েছে? না আমি নিজেই নিজেকে কষ্ট দিয়েছি? একটু ভাবলেই উত্তর মিলে, নিজের চিন্তাভাবনাই এ কষ্টের কারণ। আমি যদি যেতে যেতে মনে মনে স্ক্রিপ্ট না লিখতাম, তাহলে আমার মনে কোনো চাহিদা তৈরি হতো না এবং চাহিদা তৈরি না থাকলে সেখানে যা হচ্ছে, তা গ্রহণ করতে পারতাম। কিন্তু চাহিদার বিপরীতে গিয়ে আমি তা গ্রহণ করতে পারিনি বলে সে কী করেছে, সেটা আসলে দেখতেই পারিনি।

এভাবে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে মানুষ ক্রিপ্ট রাইটিং করছে। কখনোবা একজনের মন অন্যজনের মনের সঙ্গে সব সময় একটা ইন্টার লিংক তৈরি করছে। কোনো কোনো ইন্টার লিংক মিলে যাচ্ছে। কোনো কোনো স্ক্রিপ্ট সঠিক হয়ে যাচ্ছে। তবে সে সঠিক স্ক্রিপ্টগুলো যদি নিজের সঙ্গীকে সন্দেহ বা অবিশ্বাস দিয়ে তৈরি হয়, তবে তা মারাত্মক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। মন থেকে মনে পৌঁছানো খুব সহজ এবং তার ওপর ভিত্তি করে যখন কথা তৈরি হয়, তা ইন্টারলিংক পায়। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহ সত্য হয়ে যায়, যা আপনার নিজেকেই আঘাত দেয় বেশি। মন যতক্ষণ সে চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে, সে আঘাতপ্রাপ্ত হতে থাকবে।

এখন এখানে থামুন এবং চেক করুন, সে আপনাকে আঘাত করেছে না কী আপনার চিন্তাভাবনা আপনাকে আঘাত পেতে সাহায্য করছে? আপনি বলবেন, সে করছে। কারণ, সে অবিশ্বাস–সন্দেহ তৈরির মতন কাজ করছে। সে যে কাজ করছে, তা তার একান্ত নিজের স্ট্যাটাস অব মাইন্ড বা নিজের মনের পরিস্থিতিতে করছে। কিন্তু আপনার কাছে পাওয়ার বা ক্ষমতা আছে, তাকে অন্য রকম চিন্তার ভেতরে দেওয়ার। কিন্তু আপনি তা না করে সন্দেহ করছেন এবং একটা সময় তা আপনার নিজের আত্মশক্তি কমিয়ে আপনাকে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত রোগী বানিয়ে ফেলছে। অনেক ক্ষেত্রে লেখাটি যদি চাহিদার বিপরীত হয়, তবে মন প্রফুল্ল হয়। আমরা বলি, এ রকম ব্যবহার আশা করিনি। এ জন্য কোথাও কোনো আশা তৈরি না করাই ভালো।

আঘাত যাতে না আসে, সে জন্য যখন স্ক্রিপ্ট রাইটিং করেন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মনকে বিরামহীন ভাবনা থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। চিন্তাভাবনায় পজ বাটন ইনস্টল করতে হবে। চাহিদা কমিয়ে আনতে হবে। নিজের মনের চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই এ লেখা চলতে থাকে। এ জন্য প্রথমে চাহিদা কমাতে হবে। মনকে একমুখী করতে হবে, অনেকটা বৈদ্যুতিক তারের নিষ্ক্রিয় তারের মতন, যাতে আপনার মন অন্য কারও সঙ্গে ইন্টার লিংক স্ক্রিপ্ট তৈরি না করে।

মানুষের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি নালিশ কমাতে হবে। গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। নিজের ক্ষমতা, পছন্দ–অপছন্দ দিয়ে অন্যকে বিচার কমাতে হবে। যদি কাউকে একান্ত বিচার করতে হয়, তবে জ্ঞানের ভিত্তিতে করেন। সে যেমন, তাকে সেভাবে দেখার চেষ্টা করুন। তখন যে পরিবর্তন ঘটবে তা হবে সুন্দর ও কোমল। নতুবা নিজের মনকে নিজেই ক্ষতবিক্ষত করতে থাকবেন।