মননশীলতা ও দুটো সাবধানবাণী

ছবি: সংগৃহীত

মাইন্ডফুলনেস (Mindfulness) শব্দটি ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় যে পরিমাণ জনপ্রিয়, বাংলাদেশে আমি সেভাবে শুনিনি বললেই চলে। কীভাবে শুনব? আমাদের দেশে মন শব্দটি তো কেবল কিছু বছর ধরে আলোচনার বিষয় হতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সামান্য লেখালেখি করে মানসিক স্বাস্থ্যকে মাত্রই আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম দিতে চেষ্টা করছি। এ অবস্থায় মাইন্ডফুলনেস নিয়ে লেখাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কি না, বুঝতে পারছি না। মাইন্ডফুলনেসের বাংলা অর্থ ‘মননশীলতা’।

বাংলা মানে দূরে থাক, আমি যখন ইংরেজিতে প্রথম এই শব্দের মানে শিখেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম, মনের মধ্যে যখন নানান হাবিজাবি জিনিস দিয়ে ভর্তি হয়ে যায়, তারপর আমাদের যে অস্থির অস্থির লাগে—মাইন্ডফুলনেস মনে হয় সে রকমই কিছু একটা।

মাইন্ড-ফুল-নেস!
পাঁচ বছর বা কিছু আগে অস্ট্রেলিয়ার মেন্টাল হেলথ উইকে এক ভদ্রলোক আমাদের অফিসে এসেছিলেন মাইন্ডফুলনেস টেকনিক শেখাতে। ভদ্রলোক অস্ট্রেলিয়ার প্রথম সারির একজন মাইন্ডফুলনেস কোচ। প্রথম সারি, কারণ, উনি এক ঘণ্টার একটা গ্রুপ সেশনের জন্য সাড়ে সাত হাজার ডলার চার্জ করেন। আমি প্রাথমিকভাবে তাঁর সেশনে যাই, কারণ, এত টাকা দিয়ে অফিস কী জিনিস অর্গানাইজ করছে, সেটা দেখার জন্য। ঘরভর্তি ২০-৩০ জন লোক। সামনের সারিতে বসে আমি অধীর আগ্রহে সাড়ে সাত হাজার দামের টেকনিক শেখার জন্য অপেক্ষা করছি!

তিনি সেশনের প্রায় প্রথম দিকেই ঘরের সব লাইট বন্ধ করে দিলেন। যদিও বাইরে থেকে দিনের আলো আসছে এবং সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তবু কারেন্ট না যাওয়া এই দেশের একটা অফিসে যখন হুট করে দিনদুপুরে লাইট বন্ধ হয়ে যায়, তখন একটা অস্বস্তি হয়।

লাইট বন্ধ করে তিনি সবাইকে বললেন, ‘সবাই চোখ বন্ধ করো।’ এ কথা শুনে সবাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুধু আমি চোখ পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলাম ঘটনা কী? ইয়োগা ফিওগা কিছু নাকি? কে জানে ইয়োগার অফিশিয়াল নাম মনে হয় মাইন্ডফুলনেস। মন বিক্ষিপ্ত থাকলে ইয়োগা কাজে দেয় শুনেছি, এইটা বোধ হয় তেমনি কিছু।

আমি চোখ পিটপিট করে দেখছি কী হয়। এমন সময় তিনি হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মাই ডিয়ার লেডি, মাইন্ডফুলনেস থেরাপি হচ্ছে একদম নিজের জন্য, নিজে কী করছি, কী ভাবছি সে জন্য। অন্যেরা কী করছে, অন্যেরা কী ভাবছে, অন্যেরাও চোখ বন্ধ করছে কি না, এই তথ্য খুঁজে বের করার জন্য নয়! যেদিন তুমি নিজেকে এই জায়গা থেকে বের করতে পারবে, সেদিনই তুমি মাইন্ডফুলনেসের প্রথম চ্যাপ্টার শেষ করে ফেলতে পারবে।’

আমি যে চোখ পিটপিট করে সবার সামনে ধরা খেয়েছি, এইটা একটা বিশাল লজ্জার বিষয়। এ বয়সে বাচ্চাদের মতো ক্লাসে বসে দুষ্টুমি-ফাজলামো আসলে মানায় না। তো আমার উচিত এখন একটু লজ্জা পাওয়া। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, আমার লজ্জা হলো না। কারণ, আমি এবার সত্যিকার অর্থে আমার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। আমি এবার সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করলাম যে এই লোক যা বলছে, যাদের জন্য বলছে, তাদের মধ্যে আমিও একজন। কে কী করল, সেটা আমার বিবেচ্য নয়। আমার বিবেচ্য হলো আমি ঠিক করছি তো?

এক ঘণ্টার ওই সেশনের পর আমার জীবন যে আমূল পাল্টে গেল, তা নয়। জীবন আমার ডালভাত টাইপই রয়ে গেল। এই ডালভাতওয়ালা জীবন নিয়ে আমি মাইন্ডফুলনেস প্র্যাকটিস করা শুরু করলাম। ৫ মিনিটের ব্যাপার। ঘুমানোর আগে করাই যায়। তা ছাড়া সেই সাড়ে সাত হাজারওয়ালা ভদ্রলোকও বলেছেন, প্রথম প্রথম ৫ মিনিট, তারপর ১০ মিনিট, তারপর ১৫ মিনিট। বিশ্বাস করো, এর বেশি দরকার নেই।
পাঁচ মিনিট আমি কী এমন করতাম। তেমন কিছুই না। চোখ বন্ধ করে দিনের যেকোনো একটা কাজের কথা ভাবতাম। যেই কাজটাতে শুধু আমি আছি আর কেউ নেই। ধরুন আজকে এই পোস্টটা লিখছি। এইটা পোস্ট করব। তারপর রাতে মনে মনে ফেসবুক স্ক্রিনে আমার পোস্টটা আমিই আবার পড়ব। এই তো।

তবে এখানে একটা ক্যাচ আছে, যখন আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে পোস্ট পড়ব, তখন আপনাদের করা কোনো কমেন্টের কথাই ভাবব না। এই লেখা নিয়ে ভালো-মন্দ যা-ই বলেন না কেন, আমি ভাবব না। লাইক, লাভ কয়টা পেলাম ভাবব না। কে শেয়ার করল আর কে মুখ ভেংচে চলে গেল, ভাবব না। আমি শুধু আমার এ সাধারণ লেখাটার কথা ভাবব। লিখতে লিখতে আমি কতবার মুচকি হেসেছি, কয়বার দাঁড়ি-কমা ঠিক করেছি, সেটাও ভাবব। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আপনি এ লেখার প্রেমে পড়ে গেলেও আপনার কথা ভাবব না...(পরে অবশ্য ভাবব, সেইটা অন্য প্যাঁচাল) কিন্তু আমার সেই ৫ বা ১০ মিনিটের চিন্তাতে ভাবব না।

এইটাই মাইন্ডফুলনেস।

Stop judging yourself! কে কী ভাবল, কে কী করল, আপনাকে নিয়ে আড়ালে কে কী বলল, সামনেই-বা কী বলল—এগুলো থেকে বের হওয়ার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো এই মাইন্ডফুলনেস টেকনিক।

কী ভাববেন? ডাজন্ট ম্যাটার। যেকোনো কাজ, যেমন আজ আপনি হয়তো পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি রান্না করেছেন। সেটা নিয়েই ভাবেন। জাস্ট মনে রাখবেন, সেটা খাওয়ার সময় আপনার সন্তান কতবার ইয়াম ইয়াম করেছে বা জামাই কেন লবণের বাটিটা খুঁজেছে। এগুলো ভাবা যাবে না। বরং পুঁইশাক যখন বেসিনে ধুচ্ছিলেন, কতক্ষণ সময় লেগেছিল কিংবা শাক দেওয়ার আগে চিংড়িটা কষানোর সময় যে মসলার একটা লোভনীয় রং হয়েছিল, সেই রংটা ভাবেন। প্রথম প্রথম কঠিন। নিজেকে ঘাড় ধরে চারপাশের মানুষের রিঅ্যাকশন, কমেন্ট, কপাল কুঁচকানো—এগুলো থেকে বের করে আনতে হবে। এই বের করার পদ্ধতির সময়ই আপনি লক্ষ করবেন আমরা, এ মানব প্রজাতি কী লেভেলের, অন্য মানুষ কী ভাবছে, এটা ভাবি এবং ভাবতেই থাকি।
মাইন্ডফুলনেস আপনাকে সেলফ জাজমেন্ট থেকে দূরে রাখবে। যেহেতু এইটা কোনো ট্যাবলেট নয় যে টুপ করে খেয়ে ফেললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কাজ করবে, অতএব প্র্যাকটিস উইল মেক ইউ পারফেক্ট।

মাইন্ডফুলনেস আপনার এবং আপনার চারপাশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য দেখেশুনে রাখতে সাহায্য করবে। যেমন ‘ওর তো সব আছে, ওর আবার ডিপ্রেশন কিসের?’ এ-জাতীয় ফাতরা কমেন্ট করা থেকে আপনাকে যেমন দূরে রাখবে, আবার ‘কেউ কেন আপনার ডিপ্রেশনের জায়গাটা আজও বুঝল না’, এই হাহুতাশ থেকেও দূরে রাখবে।
মাইন্ডফুলনেস ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, ওসিডি, অকারণে পেটব্যথা, মাথাব্যথা, পিরিয়ড পেইন, কানের ভেতর হঠাৎ ফরফর শব্দ, বুক ধড়ফড়ানি ইত্যাদি ছোট-বড় অনেক সমস্যা থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে।

আমাদের মস্তিষ্কের ‘গ্রে ম্যাটার’ মানে মস্তিষ্কের যেই অংশ আমাদের স্বাদ, গন্ধ, দেখা, শোনা, সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি অংশ কন্ট্রোল করে, সেই অংশ বয়সের সঙ্গে ক্ষয় হয়ে যায়। মাইন্ডফুলনেস সেই ক্ষয় হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। শুধু এই কারণটা বিবেচনা করে অস্ট্রেলিয়ার অনেক স্কুলের কারিকুলামে মাইন্ডফুলনেস থেরাপি ঢোকানো হয়েছে। তার মধ্যে আমার কন্যার স্কুলও অন্তর্ভুক্ত।

মাইন্ড ইয়োর ওউন বিজনেস। এইটা অন্য কাউকে বলার আগে বা ভাবার আগে আপনি মাইন্ডফুলনেস পাঁচ বা দশ মিনিটের নিয়মিত চর্চা করছেন তো? মনে আছে কী করতে হবে?

আপনার বারান্দা বা বাড়িরই পেছনের যে বাগানটা আছে, সেই বাগানটার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথা ভাবতে হবে। কিংবা আজ আলুভর্তা আর ডিমভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে কী আরামটা লেগেছিল, সেটা ভাবেন। কেক বেকিং করে তার ওপর অতি যত্নে যে গোলাপি ফুলটা বসিয়েছিলেন, সেই ফুলটার কথা ভাবেন। সদ্য গিটারে তোলা বেসুরো সুর, ফেসবুকে ‘অনলি মি’ দেওয়া ছন্দ হারানো যে কবিতা আজ পোস্ট করেছেন, সেটা ভাবেন। এইটাই মাইন্ডফুলনেস। আর এই বিষয়ে অ্যাডভান্সড লেভেলে কিছু জানতে হলে গুগল তো আছেই।

দুটো সাবধানবাণী

১.
বাইপোলার বা সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন, এমন কেউ মননশীলতার চর্চা ঘরে বসে করার আগে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেবেন। খুব সম্ভবত আপনার জন্য এটা ভালো নয়।
২.
আমার মতো নির্বিকার মানুষ না হতে চাইলে মাইন্ডফুলনেস চর্চা না করাটাই ভালো। কে কয়টা শাড়ি কিনছে, বাড়ি কিনছে, কী রান্না করছে, অমুকের বাচ্চা কোন স্কুলে পড়ছে, আমার বিচ্ছেদ নিয়ে কে কী ভাবছে, আমার সিঙ্গেল মাদারহুড নিয়ে কার খুব কষ্ট হচ্ছে বা মজা লাগছে। এ-জাতীয় অর্থহীন টপিক পাশে সরিয়ে, কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় ঝাল চানাচুর মাখানো খেতে খেতে, সোফায় কম্বলমুড়ি দিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’, যদি নির্ঝঞ্ঝাটভাবে দেখতে না চান, তাহলে মমনশীল থাকুক। এই জিনিস আপনার জন্য না! সবাই সুস্থ থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিরাপদে থাকুন।

*লেখক: শাহিদা আরবী ছুটি, সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া