ভিনদেশে বাংলাদেশির বিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রে আন্তর্দেশীয় ও আন্তধর্মীয় বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি যুব প্রজন্মের মাঝেও এখন এমন বিয়ের সংখ্যা বাড়ছে। একবিংশ শতকে এসে অনেকেই জীবন সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আন্তজাতীয় বা আন্তধর্মীয় ব্যাপারটাকে তেমন মুখ্য কোনো বাধা হিসেবে দেখছেন না। কারণ তাঁরা জীবন সঙ্গী হিসেবে একজন মানুষকেই প্রাধান্য দিতে চান। মানুষটি কোন ধর্মের, কোন বর্ণের, কোন জাতের সেটা কোনো বড় সমস্যা বলে মনে করেন না। বলাই বাহুল্য যে, এ ধরনের বিয়ে হচ্ছে উদারপন্থী মানুষের প্রেম-ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব থেকে।
ভিন্ন ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির কারণে বিয়ের আগে এবং পরে তাঁদের অনেককেই কিছু বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। তারপরও ভালোবাসার মানুষ বলে কথা! তাই কঠিন বাস্তবতাও প্রেমিক যুগলের কাছে হয়ে ওঠে লঙ্ঘনীয় ব্যাপার। ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বর্ণের ছেলে-মেয়ের মধ্যে বিয়ের ঘটনা তাই ক্রমশ বাড়ছে।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষের যাতায়াত এবং যোগাযোগ বাড়ার কারণেই বাড়ছে ভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের বিয়ে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অতীতে এ ধরনের আন্তজাতীয় বা আন্তধর্মীয় মিশ্র-বিয়ের কারণে অনেক যুগলকেই জীবননাশের হুমকি, প্রবল বাধা বা কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তা সে বিখ্যাত বা অখ্যাত যেই হোন না কেন। আমাদের সামনে স্বদেশের এবং বিদেশের এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
তবে আশার কথা হলো, এখন পৃথিবী বদলে গেছে। এসব ক্ষেত্রে আগের তুলনায় আমরা অনেক বেশি সহনশীল, অনেক বেশি সমঝোতাপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন করতে শিখেছি।
এমনি একজন সাহসী ও উদারপন্থী বাঙালি নারী হলেন নুসরাত শারমিন তিসাম। বর্তমানে তিনি ‘নুসরাত পুলিও’ নামে পরিচিত।
নুসরাতের নামের শেষ অংশের মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে, তিনি মি. পুলিওর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। আগে আসা যাওয়া করলেও নুসরাত ২০১৫ সালে নিউইয়র্কে আসেন বসবাসের উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেক আগে থেকেই নানা রকম কর্ম তৎপরতার মধ্য দিয়ে নুসরাত তাঁর জীবনের ভীত গড়ে তুলেছিলেন। মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন নাটক ও শর্টফিল্মে। কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে ফ্যাশন হাউস ‘জারা’ এবং এইচএনএমের সঙ্গেও কাজ করেছেন নুসরাত।
এরপর তিনি কুইন্সের একটি ল’ ফার্মে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে কাজ করছেন একটি ক্রেডিট রিপেয়ার কোম্পানির সঙ্গে। গত বছরের ডিসেম্বরে কাজের কারণেই নুসরাতের পরিচয় ঘটে কার মডিফায়ার পেশার একজন শ্বেতাঙ্গ তরুণের সঙ্গে। তাঁর নাম ফিলিপ পুলিও। বাবা স্যার জন অ্যান্ড্রু পুলিও। যিনি ১৯৬৯ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অ্যান্ড্রু তিন কন্যা ও দুই মেয়ের বাবা। ফিলিপ হলেন অ্যান্ড্রুর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান।
পরিবারটি নিউজার্সির সাগর তীরবর্তী একটি শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত শান্ত সুন্দর প্রান্তিক শহরে বসবাস করছেন অনেক দিন থেকে। ফিলিপের জন্ম ওহাইওতে হলেও তিনি বড় হয়েছেন নিউজার্সিতে। কাজের সূত্রে পরিচিত হয়ে নুসরাত এবং ফিলিপের পরস্পর সম্পর্কে জানার গণ্ডি একসময় বন্ধুত্বকেও ছাপিয়ে যায়। বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও গল্পে, কথাবার্তায় ফিলিপ বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। নুসরাতও জানতে পারেন, বেশ কয়েক বছর আগে ফিলিপ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ফিলিপ একজন মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। ছয় মাসের সম্পর্কে তাঁরা পরস্পরের আরও কাছাকাছি হন। শেষে বিয়ের মধ্য দিয়ে একটি যৌথ জীবন শুরুর সিদ্ধান্তে আসেন।
চলতি বছরের ১১ জুন নুসরাত-ফিলিপ আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেছেন। নুসরাত জানান, তাঁদের বিয়ে হয়েছে দুই দেশের সংস্কৃতি মাথায় রেখে। নুসরাতের পরিবার তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানের দেশি পর্বে বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির প্রতিটি বিষয় সুন্দরভাবে উদ্যাপনের চেষ্টা করেছেন।
নুসরাত জানান, তিনি আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির কাছে নিজের দেশ, দেশের সংস্কৃতি, সৌন্দর্য এবং মানুষের গল্প করতে নিজেদের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতে ভালোবাসেন।
ভবিষ্যতে তিনি নিজের কাজের মধ্য দিয়ে নিজের দেশকে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে চান। এসব নিয়ে তাঁর মাথায় অনেক পরিকল্পনা আছে বলে তিনি জানালেন।
নুসরাত তাঁর হবু সন্তানদেরও নিজের মাতৃভাষা শেখানোর ইচ্ছা রাখেন। প্রবাসে থেকে একজন শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানকে বিয়ে করে নতুন জীবন গড়ে তুললেও, নুসরাত তাঁর বুকের গভীরে লালন করে চলেছেন বাংলাদেশের জন্য গভীর ভালোবাসা।
সুতরাং নিঃসন্দেহেই বলা যায়, আমরা যারা জীবন এবং জীবিকার প্রয়োজনে প্রবাসী হই, তাঁরা কখনোই স্বদেশ, সংস্কৃতি, মাতৃভাষাকে ভুলি না। নুসরাতও প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাকে এমন প্রতিক্রিয়াই জানালেন। তিনি তাঁর জীবনের নতুন এ সময়ে নিউজার্সির সাগর পার থেকে বললেন, আমরা তো আমাদের বুকের গহিনে একটি ছোট্ট স্বদেশ, দেশের জন্য প্রবল মায়া এবং এক ধরনের নস্টালজিয়া নিয়েই বেঁচে থাকি।