ভালোবাসা কারে কয়

প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ভালোবাসাকে তীব্র করে
প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ভালোবাসাকে তীব্র করে

বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এলেই মনে প্রশ্ন জাগে, ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়!’ ভালোবাসার সংজ্ঞা আসলে কী? 

আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে, নর-নারীর মধ্যে যখন সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ ও পরস্পর শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্ক থাকে, যার প্রতি নির্ভর করা যায় নিশ্চিন্তে, পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, দুজন দুজনকে আঁকড়ে থাকতে চায়, একে অন্যের জন্য প্রতীক্ষা করে, দেখার আকুতি থাকে, কাছে পাওয়ার আনন্দে পাগল হয়ে যায়, দুজনে দুজনাতে মুগ্ধ...এরই নাম প্রেম বা ভালোবাসা। যে অনুভূতির জন্য সব সুখ, শান্তি, ঐশ্বর্য, বৈভব, পরিচিতি, সমাজ, সংসার সব ত্যাগ করা যায়। সম্মান-অসম্মানের পরোয়া থাকে না।
দুজনার মধ্যে যদি কখনো ভুল-বোঝাবুঝি হয় বা দূরে থাকতে হয়, তখন খুব কষ্ট হয়। বিরহ ছাড়া ভালোবাসা অনুভব করা যায় না। মনে হয় যেন তাকে ছাড়া আর বাঁচব না। এই যন্ত্রণার নামই ‘ভালোবাসা’! বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে থাকে। যে কখনো এই যাতনা সয়নি, সে ভালোবাসার মর্ম বোঝেনি। তাই তো রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন,
“তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালবাসা’—/ সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলি যাতনাময়।”
রোমান্টিক প্রেমের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হয় উনিশ শতকের সাহিত্যর মাধ্যমে। বঙ্কিমবাবু আমাদের প্রেমের গুরু। আর রবিবাবু আমাদের সবাইকে প্রেমে পড়তে শিখিয়েছেন। তাঁরই ভাষা দিয়ে আমরা প্রেম করি, তাঁরই ভাব দিয়ে প্রেম করি!
মধ্যযুগের সাহিত্যের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ, লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ প্রভৃতি। প্রেমাস্পদকে পাওয়ার জন্য কী ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি কাহিনিতে। দেহহীন প্রেমের কথা তারা ভাবেনি। দেহাতীত প্রেমের বিশুদ্ধ রূপটি বাস্তবে কতখানি সত্য, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেক লেখকই বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত প্রেম দেহাতীত। আকর্ষণের মধ্য দিয়ে যার জন্ম, বিকর্ষণের মধ্য দিয়ে তাকে চিরন্তন করে রাখতে হয়। শেষের কবিতায় দেহাতীত প্রেমের স্বতন্ত্র অবস্থান রবীন্দ্র-জীবনদর্শনের প্রকাশ। লাবণ্যের সঙ্গে অমিতের যে প্রেম, সেটি শাশ্বত অপরিবর্তিত রাখতে চেয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের হিসাব-নিকাশ সেখানে আনতে চায়নি।
আজকে প্রেম করে বিয়ে করাটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় অধিকাংশ পরিবার। কিন্তু দেড় শ বা দু শ বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। পাশ্চাত্য শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রভাবে তখন আধুনিক বাঙালি পুরুষেরা প্রেম করে বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর ছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ভালোবেসে রেবেকাকে বিয়ে করার জন্য গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেম করে বিয়ে করতে পারেননি, কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করেই দাম্পত্য সম্পর্কে প্রবেশ করেন। এই দম্পতি পরবর্তী সময়ে রোল মডেলে পরিণত হন।

ভালোবাসা ঘুচিয়ে দেয় দেশ ও জাতির ব্যবধান। বাঙালি মেয়ে মাম্পি ঘোষ ভালোবেসে বিয়ে করেছেন নেপালি ছেলে ত্রিবলকে
ভালোবাসা ঘুচিয়ে দেয় দেশ ও জাতির ব্যবধান। বাঙালি মেয়ে মাম্পি ঘোষ ভালোবেসে বিয়ে করেছেন নেপালি ছেলে ত্রিবলকে

দাম্পত্য জীবনে প্রেম-ভালোবাসা না থাকলে, সে সংসারে সুখ-শান্তি কোনোটাই থাকে না। দাম্পত্য সুখের জন্য উভয়কেই যত্নশীল হতে হয়। এখন নারী-পুরুষ সবাই সংসারে বন্ধুত্বপূর্ণ, সম্মানজনক সহাবস্থান আশা করে। অবশ্য এখনো কিছু পুরুষ স্ত্রীর কাছে অধীনতা আশা করে! পরস্পর বোঝাপড়াটা থাকা খুব জরুরি। সঙ্গীর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়। সম্পর্কের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হয়। অবজ্ঞা বা অবহেলা ভালোবাসার সম্পর্ককে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। একজন মানুষ আরেকজনের পুরোপুরি মনের মতো না-ই হতে পারে। একসঙ্গে ভালো থাকতে হলে দুজনকেই মানিয়ে নেওয়া ও মেনে নিতে হয়। চেষ্টা করতে হয় ভালো থাকার জন্য। সম্মান না করলে সম্মান পাওয়া যায় না।
সন্দেহ ভালোবাসাকে নিঃশেষ করে দেয়। ভালোবাসার সম্পর্ককে সব সময় সুন্দর রাখার অন্যতম শর্ত হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে ভালোবাসার সম্পর্কে সব সময় একটা সন্দেহ কাজ করে, যা তাল-লয়-ছন্দ ছাড়া একটা গানের মতো বেসুরো হয়ে যায়। তাই প্রেম বা দাম্পত্য ভালোবাসায় ‘বিশ্বাস’ ভঙ্গ করা কখনো উচিত না। প্রতারণা করা কখনো উচিত না। মানুষের মন একটা অদ্ভুত রকমের। প্রেম কখনো বলে-কয়ে আসে না। প্রেম মানে না সমাজ সংসার, লোকলজ্জা, চক্ষুলজ্জা! তাই সম্পর্কের ক্ষেত্রে সৎ থাকতে হবে। প্রতারণা নয়, সম্পর্ককে সম্মান করতে হবে। আমাদের বাঙালি সমাজে প্রতারণা কেন যেন একটু বেশি। দাম্পত্য সম্পর্ক রেখেও গোপনে আরেকটি প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে, যা আসলে প্রতারণা। যেকোনো একটি সম্পর্কে সৎ থাকা উচিত।
নারী-পুরুষ সম্পর্ককে কোনো ছাঁচে ফেলা যায় না। এত বেশি পরিবর্তন হয়, মানুষের মনের তা নিয়ন্ত্রণ করাও অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, কষ্ট, যন্ত্রণার অনুভূতিগুলো দেখানো যায় না, অনুভব করা যায়। তাই, ভালোবাসার মানুষটির যত্ন নিতে হয়। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে গুরুত্ব দিতে হয়। যেকোনো মূল্যে বিশ্বাস বা আস্থার জায়গাটা ঠিক রাখতে হবে। নৈতিকতাবোধ ভালোবাসায় থাকাটা খুব জরুরি। সম্পর্কের প্রতি সৎ থাকতে হবে। তাহলেই দাম্পত্যজীবন মধুর হয়।
কদিন আগে হঠাৎ খেয়াল হলো, ফেসবুকে লিখলাম—ভালোবাসার আসলে সংজ্ঞা কী? প্রত্যেকে নিজের মতো করে উত্তর দিল। যেমন কলকাতা থেকে শুভ্রা সেনগুপ্ত বসাক লিখেছেন,
‘ভালোবাসা এমন একটা অনুভূতি, যা থাকলে মনে হয় বড় বালাই। একে কোথায় রাখি আর যার অভাবে মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন। যার গভীরতা মাপতে গেলে খেই হারাতে হয়। যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা মাপতে গিয়ে দিশেহারা গণিতজ্ঞ। তার সুলুক সন্ধান করতে পারে রক্তকরবীর নন্দিনী আর বিশুপাগল। রাজা জানে, যাকে পাওয়া যায় না তাকে ভাঙাও এক রকম করে পাওয়া। অথচ রঞ্জনের কাছে শিখতে হয় ভালোবাসার জন্য মরে যাওয়াও যায়। কিংবা উত্তীয় যখন বলে “ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে জানিনে শুধু তোমারে জানি” এও ভালোবাসা। কিংবা বনলতা সেনের মিস্টিক অ্যাপিয়ারেন্স পরাবাস্তবতা, সেও এক ভালোবাসার প্রকাশ। সবশেষে ভালোবাসা হলো এক জঙ্গম শিল্পকলা, যার নির্মাণ আছে কিন্তু ক্ষয় নেই।’
আরিফা রুমার কাছে, ‘ভালোবাসা হচ্ছে রাতদিন তার জন্য বুঁদ হয়ে থাকা।’
আহকামউল্লাহ বলল, ‘ভালোবাসার অনুভূতিগুলো বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হতে থাকে। একসময় “তুজে কই ওর দেখে, তো জ্বলতাহে দিল” তার কাছে ভালোবাসা হচ্ছে এখন “দায়িত্বপালন”! ভালোবাসার মানুষকে ভালো রাখার দায়িত্ব—এই দায়িত্ববোধ অনেক কিছুর...।’
কবি কাজী জহিরুল ইসলাম ও মুক্তি, জহিরের ভালোবেসে বিয়ে, ২২ বছরের দাম্পত্য জীবন, সন্তানদের নিয়ে সুখের সংসার। মুক্তি জহির বলেন,
‘ভালোবাসার বাগানে সম্পর্কগুলো হলো এক একটি জীবন্ত গাছ আর সেই বাগানের মালী হিসেবে নিজেকে বসিয়ে দিয়ে গাছগুলোর পরিচর্যা করলেই ভালোবাসা সুগন্ধ ছড়াতে থাকবে আপনার চারপাশে।’
তাই ভালোবাসার যত্ন নিতে হয়। গাছে পানি না দিলে যেমন গাছটি মরে যায়, ভালোবাসার যত্ন না নিলে ভালোবাসাও মরে যায়!