ভালোবাসার সংসার বা অন্য কিছু?

ফাইল ছবি

খুব বেশি চাওয়া ছিল না আমার
তোমার আমার লাল-নীল সংসার!
সেটুকুও বিধাতা রাখেনি কপালে
দোষ কেন দিই তোমার?
ঘুম ভেঙে তোমার চাঁদমুখ দেখা
বা ভয় পেলে তোমার বুকে লুকিয়ে থাকা
ভাগ্যে নেই আমার
দোষ কেন দিই তোমার?
দিন শেষে সব খুনসুটি আর ভালোবাসা ভাগাভাগি
কপালে নেই তোমার
দোষ কেন দাও আমার?
সুবর্ণার আজ খুব মন খারাপ। হয় মাঝেমধ্যে। জানে, পরিত্রাণ নেই এ থেকে। চাইলেই তুড়ি মেরে সব পাল্টে দিয়ে নিজের পছন্দমতো জীবনযাপন সে করতে পারে না। তার সঙ্গে হাজারো লোকের জীবন জড়িত! আচ্ছা বাবা, না হয় বাড়িয়েই বলেছে! শ খানেক বা তার বেশি তো বটেই বর্তমানে এ ইকুয়েশনে! প্রিয় মানুষজন।
একসময়ের ভীষণ ভালোবাসা হয়তো!

ভাবছে সুবর্ণা, আসলেই ভালোবাসা ছিল? থাকলে কী করে অত পর হয়ে গেল? নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত ছিল। ভালোবাসলে কেউ অমন করতে পারে? স্বেচ্ছায় ছেড়ে যায়, ভুল বুঝে—শুধু শাস্তি দিতে? তা-ই হয়? ভালোবাসা কেন এত ঠুনকো হয়? ভালোবাসা ছিল? নাকি কমফোর্ট জোন ছিল? ইগো ছিল এত? ভালোবাসায় ইগো থাকে?

ওই সে–ই তো সংসার করা কারও না কারও সঙ্গে। কারও না কারও বুকে ভালোবাসারা কী নিশ্চিন্তে ভালোবাসাহীনভাবে ভালোবেসে যায়! সেও তো ভালোবাসাই হয়! নয়?
অত কাছের মানুষ, কী করে অন্যের হয়ে যায়? নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় না একবারও?
সুবর্ণা হাসছে! কী আবোলতাবোল ভাবছে। ভালোবাসা যত সহজ। ভালো না বাসা তার থেকেও সহজ হয়ে যায় একটা সময়। অভ্যাসে ভালোবাসা। অভ্যাসে ছেড়ে থাকতে শেখাও। অভ্যাস! বিচিত্র মানবমন! জীবন যে কী অকরুণ!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এই যে সে সুমনকে এতগুলো বছর ভালোবেসে গেছে, নিঃস্বার্থভাবে। কী লাভ হলো? সুমন এখন ঘুমোয় অন্য কারও বুকে! কখনো কি ঘুম ভেঙেও মনে পড়ে তার...একদিন ভালোবাসারা ছিল অন্য কোথাও, অন্য কারও সঙ্গে? সংসার গড়েছিল তারা—দুটো ফুটফুটে বাচ্চা, ছোট্ট একটা ঘর আর ভালোবাসাভরা জীবন কাটাবে বলে। বাচ্চারা বড় হচ্ছে, তবে তারা সুমন আর সুবর্ণার বাচ্চা নয়। সংসার তারা করে যাচ্ছে আজ ভিন্ন ভিন্ন জনের সঙ্গে। ভিন্ন শহরে, ভিন্ন ভালোবাসায় স্নাত তারা। অসুখী বুঝি কেউ?

ফের হাসে সুবর্ণা। অসুখী? না তো। সে তো অসুখী নয়। প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, খুনসুটির সংসার আছে—তবে তা অন্য কারও সঙ্গে। সুখেই আছে সুবর্ণা।
জানে, সুমনও সুখেই আছে। তার মতো করেই। সংসারই তো। একটা সংসারই তো চেয়েছিল তারা। হয়েছে তো সংসার দুজনেরই। হলোইবা ভিন্ন, অন্য কারও সঙ্গে!
বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে ভালোবাসায়। নর-নারীর ভালোবাসা, অভ্যাস, দায়, নিরুপায়—যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, থাকে তো সবাই কারও না কারও সঙ্গে, থাকতে হয় বলে। ভালোওবাসে নতুন করে।
তোমার-আমার লাল নীল সংসার!

সংসার! সংসার যে কী? তারপর? তারপর একদিন সব শেষ হয়। মৃত্যুতেও কেউ কারও ছায়াও মাড়ায় না। পৃথিবীও মনে রাখে না কে কাকে, কখন, কীভাবে, কতটা ভালোবেসেছিল একদিন!
ভালোবাসা?

সত্যিই ভালোবাসা বলে কিছু আছে? না সবই শুধু বেঁচে থাকার নিমিত্তে যুগের পর যুগ একসঙ্গে থেকে যাওয়া?

অলংকরণ: আরাফাত করিম

সুবর্ণা একফালি বারান্দা থেকে বাইরের পৃথিবী দেখে। গভীর রাত এখন। দু-একটা রিকশার টুংটাং ছাড়া নিয়নের আলোয় আর কিছু দেখা যায় না। জীবনও এমনই—একসময় সব শব্দ নিস্তব্ধতায় পর্যবসিত হয়। মাঝরাত। ঘুম নেই! দুঃখবোধ তার আর নেই। ম্যাচুরিটি, সংসার, দায়িত্ব—এত কিছুর ভিড়ে সত্যিই কি তার সময় আছে দুঃখবিলাসের?

সুমনের সঙ্গে সংসারটা টেকেনি। তার দায়ভার কি শুধুই তার ছিল?
এ ভাবনাটা আরেক দিন ভাববে সে। কিছুই করার থাকে না, যখন প্রিয়জন ভালোবাসবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে। ভালোবাসা ছাড়া এক ছাদের নিচে কী করে থাকত দুজনে? এই ভালো। সুখ? সুখ তো একটা অনুভূতি, ভালো থাকার জন্য। সুখ তো মিলেই যায় কোনো না কোনোভাবে। দুঃখবোধেরাও একসময় ফিকে হয়ে যায়।
আজানের শব্দ আসছে। সুবর্ণা ঘুমাবে এবার।

মাথায় ঘুরছে...লাল-নীল সংসার। লাল-নীল সংসার!
সংসার যা-ই হোক—হয়েই যায়। সংসার টিকিয়ে রাখার দায় দুজনেরই হয়। একক উদ্যোগে কিছুই হয় না। বিছানায় শুয়ে পড়তেই অনন্তের দিকে চোখ যায় সুবর্ণার। ভালোবাসা। ভালোবাসা একটা লাইফস্টাইল। লাইফস্টাইল মেইনটেইন করা। সুবর্ণার চোখে এখন রাজ্যের ঘুম।
*লেখক: শারমীন বানু আনাম