ভরা জ্যোৎস্নায় লুকোচুরি

খোলা জানালায় তাকিয়ে পূর্ণিমার রাত দেখে ইলোরা। রুপার থালার মতো চাঁদটা ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। নীলের বুকে ঝলমলে মায়াবী চাঁদ। বসন্তে জ্যোৎস্নার রাত যেন অন্য রাতের চেয়ে আলাদা মনে হয় তার কাছে। শুরুতেই বসন্ত প্রকৃতিকে তার রূপ–লাবণ্য জানান দিচ্ছে, আমিই ঋতুরাজ, আমিই শ্রেষ্ঠ।

দীর্ঘদিন লকডাউনে বন্দী থেকে একদম হাঁপিয়ে উঠেছে ইলোরা। পূর্ণিমা রাতে আজ যেন অন্য মানুষে পরিণত হয়েছে সে। তার ভেতরে আজ অন্য ধরনের আনন্দ কাজ করছে। মনে হচ্ছে, সারা রাত চাঁদ দেখে কাটিয়ে দিলেও মোটেই ক্লান্তি আসবে না তার। বড় কোনো আঘাতও তাকে কাবু করতে পারবে না। কারণ, ঋতুরাজ বসন্ত আজই তার দুয়ারে জাগ্রত।

বেশ কিছু দিন ধরে ইলোরার মনে যে ঝড় বয়ে গেছে, সেই ঝড় দমবন্ধ করা অবস্থায় পার করতে হয়েছে বেশ কয়েকটা দিন। সাব্বির যখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হল, তারপর থেকে অনেক দ্বিধা–দ্বন্দ্ব আর গুমরে মরা যন্ত্রণা নিয়ে তাকে কাটাতে হয়েছে। অনেক নির্ঘুম রাত কেটেছে চোখের জল ফেলতে ফেলতে। তার ভেতরে কত যে ঝড় বয়ে গেছে, তা কেউ জানতে পারেনি। দীর্ঘ তিন সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে আজ বাড়ি ফিরেছে সাব্বির। তাই ইলোরা আজ চাঁদের আলো গায়ে মেখে আনন্দে লাফায়। তার বিষণ্ন মনটা চাঙা হয়ে উঠে।

সাব্বিরের অসুস্থতার খবরে একেবারে ভেঙে পড়েছিল সে। কত দোয়া–দরূদ করেছে তার সুস্থতার জন্য।

শহরের বহুল পরিচিত ডাক্তার হাসানের একমাত্র ছেলে সাব্বির। পড়াশোনা শেষ করে বাবার ফার্মেসি আশালতায় নিয়মিত বসে সে।

আশালতা নামক ফার্মেসি ডা. হাসান সাহেবের ফার্মেসি হিসেবে সবার পরিচিত এবং প্রচুর নাম ডাক। ইলোরার কলেজে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা আশালতা ফার্মেসির সামনে দিয়ে চলে গেছে। প্রত্যহ চোখাচোখি হয় দুজনার, তারপর পরিচয়। পরে মোবাইল ফোনে নিয়মিত আলাপে রূপ নেয়।

হাসপাতাল থেকে ফিরে সাব্বির ফোন করেছে ইলোরাকে। অনেক অব্যক্ত কথা বলা হয়েছে দুজনের মধ্যে। লকডাউন শিথিল হলেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে সাব্বির। মা–হারা একমাত্র ছেলের আকর্ষিক অসুস্থতায় হাসান সাহেব খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন, বাপ হিসেবে তাঁর কী যে আকুতি, তা ভুক্তভোগী পিতাই জানেন।

ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরে আসায় তাঁর যে কী আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। হাসান সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন, লকডাউন শিথিল হলেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছেলের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। তার এক বন্ধুর মেয়ে কনে হিসেবে ঠিক করে রেখেছেন অনেক আগেই।

মফস্বল শহরের একটা কলোনিতে ইলোরাদের বাসা, ঘর থেকে বের হলেই বিরাট মাঠ। মাঠ পেরিয়ে সবুজ–শস্য খেত। মাঠের ভেতর সরু রাস্তা ধরে কলেজে যায় ইলোরা। তার বোন দিলারা যায় গার্লস স্কুলে। বাবা মফিজ সাহেব কারখানায় চাকরি হওয়ার পর থেকে এই কলোনিতে পরিবার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন। মেয়ে দুটোর স্কুল–কলেজ কাছে থাকায় এই কলোনির বাসাটা তার খুবই পছন্দের আবাস। তাই, এই বাসা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে।

ইলোরা আর দিলারা, দুই মেয়ে মফিজ সাহেবের স্ত্রীসহ তারা চারজনের পরিবার। ফ্যাক্টরি আর বাসা, মধ্যে নিজের সংসারের বাজার–সদাই ছাড়া আর কোনো কিছু ভাবার ফুরসত নেই মফিজ সাহেবের। বিনোদন কী জিনিস, তা কখনো ভাবেননি তিনি।

এরপরও একটা শখ ছিল তাঁর, অফিস ফেরার পথে গোধূলি বেলার শেষ ট্রেনটা তাঁর দেখা চাই–ই চাই।

স্ত্রী সকিনা বেগম মাঝেমধ্যে কথা তোলেন ইলোরার বিয়ের ব্যাপারে। মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়েছে, সে দিকে কি খেয়াল আছে! মফিজ সাহেব যে ভাবেন না, তা বলা যাবে না। কিন্তু আজকাল পছন্দসই ছেলে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? এই তো সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দেখেন, পাশের বাসার প্রাচীরের ওপর বসে কিছু বখাটে ছেলে সামাজিক দূরত্বের তোয়াক্কা না করেই আড্ডা দিচ্ছে। তাঁকে দেখেও পাত্তা দেয়নি, তাকে না দেখার ভান করে সিগারেট টানছে।

মফিজ সাহেব বাসায় এসে সকিনা বেগমকে ডেকে বলেন, মেয়ে দুটি কোথায়। কেন, এই তো কিছুক্ষণ আগে দিলারাকে নিয়ে ইলোরার বান্ধবীর বাসায় বই আনতে গেছে।

বখাটে ছেলেদের কথা তুলে মফিজ বললেন, মেয়ে দুটোকে সাবধানে থাকতে বলো। পরদিন একটু সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরে আসেন মফিজ সাহেব। স্ত্রী সকিনা কিছুটা অবাক হলেন, জিজ্ঞেস করলেন, তাড়াতাড়ি ফিরলে যে!

গ্রামের বাড়ি থেকে বড় ভাই খবর পাঠিয়েছেন, ইলোরার জন্য পাত্র দেখেছেন, আমাকে এখনই যেতে হবে। শুনে সকিনা বেগম মনে মনে খুশি হলেন। লকডাউনের জন্য বড় যানবাহন বন্ধ থাকায় বিকল্প রাস্তা দেখতে হল মফিজ সাহেবকে, বাড়ির ১৫ কিলোমিটার রাস্তা যেতে মফিজ সাহেবের প্রায় তিন ঘণ্টা লাগল।

বড় ভাই আর ভাবি হাইস্কুলের মাস্টার ছেলের সঙ্গে বিয়ে পাকা করেছেন ইলোরার। এখন শুধু মফিজ সাহেব এবং তাঁর বউ সকিনা বেগমের মতামতের অপেক্ষায়। ভাই–ভাবির ওপর আস্থা রেখে এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলেন তারা। বিষয়টা জানতে পেরে ইলোরার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মায়ের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করে সে। কিন্তু বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার না করে তার রক্তক্ষরণ আড়াল করে দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে ইলোরা। পরদিন সাব্বিরের সঙ্গে পুরো বিষয় নিয়ে আলাপ করে সে।

এদিকে সাব্বির বিশেষ কোয়ারেন্টিনে থেকে তার বাবার সিদ্ধান্তের কথা জেনে ফেলে। তার ভাইরাস আক্রান্ত মস্তিষ্ক যেন মেসেজ দিয়ে বলছে, সাব্বির তুই ইলোরাকে নিয়ে পালা। সাব্বির তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে ইলোরাকে টেক্সট করে তার মতামতের অপেক্ষায় রইল। ইলোরা সাব্বিরের টেক্সট মেসেজ পেয়েই সরাসরি ফোনে কথা বলতে চাইল। রাত তখন গভীর।

ইলোরার পরিবারের সবাই ঘুমাচ্ছে। সাব্বির আর ইলোরার ফোনালাপ চলে পুরো রাতভর। তারা সিদ্ধান্ত নেয় পালিয়ে যাওয়ার। লকডাউনের অপেক্ষায় বসে থাকবে না। ঢাকায় সাব্বিরের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আছে অনেক। নিশ্চয়ই কেউ না কেউ তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিরাট দখল গেছে সাব্বিরের ওপর দিয়ে। প্রায়শই তার মাথা ঝিমঝিম করে। ডাক্তার বলেছেন, পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। তবুও তাদের ভালোবাসায় চির ধরাতে চায় না সে।

প্রেমিক যুগল সব পরিকল্পনার সমাধান করে এখন শুধু সময়ের অপেক্ষায়। মফিজ সাহেবের ফ্যাক্টরি এখন লকডাউনে। পূর্ণ অবসরে এখন সবাইকে নিয়ে গৃহবন্দী তিনি। ভাবছেন, এই সুযোগে হবু পাত্রকে একটু দেখে নিলে মন্দ হয় না। এ ব্যাপারে স্ত্রী সকিনা বেগমের মতামত চাইলেন। স্ত্রী বললেন, খুবই ভালো হবে, তুমি বড় ভাইয়ের সঙ্গে আজই যোগাযোগ করে কাল ভোরে রওনা হও।

মা–বাবার এমন পরিকল্পনার কথা শুনে ইলোরা ভাবে, এটিই হবে মোক্ষম সময়। সাব্বিরের সঙ্গে আলাপ করে জানতে চায় তার মতামত।

একটু ভেবে সাব্বির জানায়, ঠিক আছে। আগামীকাল সন্ধ্যার পর তৈরি থেকো, আমরা এ সুযোগ হাতছাড়া করব না।

পরদিন সকালে মফিজ সাহেব চা–নাশতা সেরে বের হলেন গ্রামের উদ্দেশ্যে। বাড়ি যখন পৌঁছলেন বেলা দুপুর। দেখেন ভাই, ভাবি তাঁর অপেক্ষায়। কুশলাদি সেরে ভাবি বলেন, হাত–মুখ ধুয়ে আসো আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি। পুঁই শাকের সঙ্গে চিংড়ি মাছের চড়চড়ি ভাবির হাতের সুস্বাদু খাবার খেতে খেতে মফিজ সাহেব বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করেন, জামাই কিছু চাইবে নাকি!

–না, তেমন কিছু না। তবে একটা মোটরবাইক দিতে হবে, বললেন বড়ভাই।

–ঠিক আছে, তোমরা যা ভালো মনে কর।

খাওয়া শেষ করে একটা পান চিবোতে চিবোতে ভাই, ভাবির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন রাস্তায় নামলেন তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয় হয়।

লেগুনা, সিএনজি, একটার পর একটা ছোট যানবাহন বদলিয়ে বাসায় পৌঁছলেন রাত সাড়ে বারোটায়। নীরব–নিঃশব্দ চারিদিক। রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতিগুলো স্বল্প আলোতে জ্বলছে। দরজার কড়ায় হাত দিতেই দেখেন দরজা খোলা। অবাক বিস্ময়ে ঘরে ঢুকেই দেখেন, সকিনা বেগম অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। দিলারা তার বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু ইলোরার বিছানা খালি পড়ে আছে।

আস্তে আওয়াজ করে স্ত্রীকে ডাকলেন, তারপর ইলোরার ব্যাপারে জানতে চাইলেন। সকিনা বেগম ভাবলেন হয়তো মেয়েটা বাথরুমে গেছে, কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও মেয়ে বাথরুম থেকে ফিরছে না দেখে স্বামী–স্ত্রী দুজনই বিরাট চিন্তায় পড়ে গেলেন। লোক জানাজানি হওয়ার আগে বিষয়টা কীভাবে সুরাহা করা যায়, সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।

মফিজ সাহেব হঠাৎ স্ত্রীর ওপর রেগে গেলেন। বললেন, তোমার বুদ্ধি–শুদ্ধি যে কবে হবে, সেয়ানা মেয়েটা কখন কোথায় যায়, কী করে, তুমি তার একটু খোঁজখবর রাখতে পার না।

সিএনজি অটোরিকশার আরোহী দুজন—ইলোরা ও সাব্বির। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বসার চেষ্টা করছে। এক সময় সাব্বির এগোয় ইলোরার দিকে, ইঙ্গিতে বলে চুমু খেতে। ইলোরা মৃদু হাসে লজ্জায় মুখ সরিয়ে নেয়। জীবনের এই প্রথম কি-না! আবার সাব্বির এগোয়, তখন ইলোরা আর মানা করে না।

সাব্বিরের পরিকল্পনা ছিল ঢাকায় যাওয়ার। কিন্তু যানবাহন সংকটে ঢাকার চিন্তা বাদ দিয়ে লোকাল কাজির শরণাপন্ন হল। ইতিমধ্যে তার দুই বন্ধুকে দায়িত্ব দিল, কাজি সাহেবকে ম্যানেজ করার। লকডাউনে কাজি অফিস বন্ধ। তারপর রাত। সাব্বিরের বন্ধু দুজন কাজির বাসায় গিয়ে সব ব্যবস্থা করে নিল।

সব আনুষ্ঠানিকতার পর এক বন্ধুর বাসায় যেতে উদ্যত হল। সিএনজি রাস্তায় মোড় নিতেই টহল পুলিশ সন্দেহবশত সিএনজি অটোরিকশা আটকে তল্লাশি করতেই আসল ঘটনার বাস্তবতা খুঁজে পেল পুলিশ।

তারপর থানায় সোপর্দ করা হল সাব্বির–ইলোরা দম্পতিকে। পরদিন ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায় হল, লকডাউন আইনভঙ্গ করে পরিণয়ে আবদ্ধ হওয়ায় তাদের দুজনকে বিশেষ কোয়ারেন্টিনে আলাদা হয়ে থাকতে হবে। পরদিন ছোট্ট মফস্বল শহরে ঘটনাটি চাউর হয়ে গেল।

দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টিন শেষে তাদের মুক্ত হওয়ার দিন। খবর পেয়ে সাব্বিরের বাবা হাসান সাহেব দ্রুত ছুটে গেলেন মফিজ সাহেবের বাসায়। তারপর বেয়াই সম্বোধন করে গলায় জড়িয়ে ধরলেন। ইলোরার মা সকিনা বেগম দরজার আড়ালে থেকে একটু অবাক হলেন। হাসান সাহেব বললেন, আর দেরি করা যাবে না, চলেন বর–কনেকে বরণ করি।