‘বোকা বাবা আমাদের কাছে আসে না’
‘বাবা, তুমি আসবে আসবে বলো, কিন্তু আসো না। বোকা বাবা আমাদের কাছে আসো না। তুমি কত দিন ধরে বলছ। কই? তুমি তো আসছ না।’
প্রবাসী বাবার একমাত্র কন্যা চার বছর বয়সী মুনতাহা তার বাবাকে কাছে পেয়েছে মাত্র দুই মাস। তা-ও তখন, যখন তার বুঝতে পারারও সময় হয়নি।
কথা বলতে শিখে গেছে পুরোপুরি। বাবার প্রতি অনুযোগ-ক্ষোভও আছে। কেন বাবাকে কাছে পায় না? তাই বাবার এ দূরত্ব প্রকোপ হয়েছে শূন্যতার অনুভূতি। প্রবাসে এসে দেখছি, নব পিতা বা কয়েক সন্তানের জনকদেরও। আমি অবিবাহিত হলেও প্রবাসী যুবক বাবাদের তাঁদের শিশুসন্তানের অভিযোগগুলো কাছ থেকে দেখছি দীর্ঘদিন ধরে।
মেয়েদের বাবার প্রতি ভালোবাসা অন্য রকম। বাবার সঙ্গে কন্যার জমেও। বাবাকে শাসনও করে এই শিশুকন্যারা। কাছে না পেলেও মুঠোফোনে তাদের ছবি চলে আসছে। মাঝেমধ্যে ছুঁয়ে দেখার আকুতি কঠিন পরিস্থিতি দাঁড় করায়, কান্নাকাটি পর্যন্ত গড়ায়। বাবার কাছে আবদার তো থাকেই—যত রঙের লিপস্টিক ও মেকআপ বক্স আছে, সব কটি তার লাগবে।
কাছে না পাওয়ার অভিযোগে মুঠোফোনে ভিডিও কলে ঝড় তুললেও বাচ্চারা একসময় ভুলে যে কাল সে তার বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য কী ব্যাকুলতাই না দেখিয়েছিল। কিন্তু তার শিশুমন সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু ভুলতে পারে। তবে সেই বাবা কি ভুলতে পারেন তাঁর কলিজার টুকরাকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট; কোলে তুলে আদর করতে না পারার শূন্যতা, বুকের মধ্যে চলা হাহাকার? সব ভালোবাসা থাকে মুঠোফোনের স্ক্রিনে ছুঁয়ে সন্তানকে অনুভব করে তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করেন সেই বাবা।
শিশুদের বাড়ি ফেরার প্রশ্নে প্রত্যেক বাবাই অপ্রস্তুত হয়ে যান। ‘আসব, আসব’ বলে উত্তর দিতে থাকেন। সন্তানের কষ্টটা তিনি বুঝতে পারেন। কিছু একটা বলে বুঝ দিতে চান। বাবার মনের ভেতর তুফান ছুটে যায়; কিন্তু কী করার, বাবা তো আর সাকিব আল হাসান নন; ভিআইপি বা নেতা–এমপি নন যে জন্মের সময় এক দেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে তাঁর পরির জন্য হাসপাতালে ইমারজেন্সির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। বাবা তাঁর সন্তানের কপালে প্রথম চুমুটা দেবেন।
বিদেশে কাজ করে একটা সীমিত গণ্ডির মধ্যে বাস করা হাজারো বাবার একজন। এর মধ্যে তো করোনার কারণে দেশে দেশে বিমান চলাচল বন্ধ। এক দেশে চলছে, তো আরেক দেশে বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে দূতাবাসের সুপারিশে কিছু প্রবাসী বিমানে উড়তে পারেন। কিন্তু সেখানেও ঘুষ দিতে হয়। সীমিত আয়ের মানুষের পক্ষে ঘুষ মিটিয়ে সুপারিশ নেওয়া সম্ভব নয়। তাই করোনার সময়ে হাজারো বাবা তাঁদের শিশুদের ‘আসব, আসব’ বলেই সময় সামনে নিয়ে যাচ্ছেন। এর বাইরে কত জটিলতার মধ্যে আছেন প্রবাসীরা—ভিসা জটিলতা, কাজ করে চাহিদামতো আয় করতে না পারা। কতই না সমস্যার মধ্যে প্রবাসীরা জীবন টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।
তারপরও মুনতাহা, জারিনারা বাবার জন্য পথ চেয়ে আছে। তারা বাবার কোলে ছুটে যাবে। কপালে চুমু দিয়ে বাবার প্রতি সব অভিযোগ স্থগিত হয়ে যাবে। বাবাকে কাছে পাওয়ার চেয়ে বড় বিষয় আর কিছু হতে পারে না।