বৈশাখী আড্ডা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা

বাংলা নববর্ষে বৈশাখের রঙে রেঙেছিল বাংলার প্রকৃতি। রেঙেছিল সারা দেশ ও জাতি। বৈশাখের রঙের রূপের ছটা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে, এই জনপদ থেকে ওই জনপদে। যেখানেই বাঙালি, সেখানেই রঙের ফোয়ারা ছুটেছে। সেই রঙিন ফোয়ারার ঝরনাজলে অবগাহন করতে কে না চায়? বাস্তবতার নির্মম কশাঘাতে দেশের নববর্ষের সেই রঙের রেণু গায়ে মাখা থেকে প্রবাসী যারা বঞ্চিত, তারা যে আজ কী বুভুক্ষু, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। তাই উপলক্ষ পেলেই এই বুভুক্ষু মন তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো ছটফট করে, চেটেপুটে লুটেপুটে গায়ে মাখতে চায় সেই রঙের রেণু। এমনই এক উপলক্ষের সুযোগ করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের সাউথ জার্সির প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রাণপ্রিয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব আটলান্টিক কাউন্টি’। তাদের উদ্যোগে বাংলা নববর্ষের দিন সাউথ জার্সির এবসিকনে আয়োজন করা হয়েছিল ‘বৈশাখী আড্ডা ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা’।

১৪ এপ্রিল দিবাকর পাটে বসতেই বৈশাখের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে প্রবাসীরা মিলনায়তনে সমবেত হতে থাকে। মিলনায়তনের প্রবেশপথের মুখেই আয়োজকদের সহাস্য অভিবাদনে জুড়িয়ে যায় মনপ্রাণ। ভেতরে ঢুকতেই নিরন্তর চলতে থাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ভিড়। একসময় তা কাদা থিক থিক ভিড়ে পরিণত হয়। ইথারে তখন ভেসে আসতে থাকে নববর্ষের সেই কালজয়ী গানের সুর, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো......’। এরই ফাঁকে সবাই মেতে ওঠে জম্পেশ বৈশাখী আড্ডায়। দীর্ঘদিন পর প্রবাসীরা নিজেদের কাছে পেয়ে ব্যক্তিগত আলাপনে মেতে ওঠে। এরই ফাঁকে সঞ্চালক আবদুর রবের আহ্বানে একে একে নববর্ষের শুভেচ্ছার ডালি মেলে ধরেন সোহেল আহমেদ, মনির হোসেন, বোরহানউদ্দিন, শহীদ খান, শিল্পী এম এ হামিদ, শিল্পী নীনা হামিদ প্রমুখ।
শুভেচ্ছা বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে সমবেত লোকজনের উদ্দেশে পরিবেশিত হতে থাকে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা পুলি, মুড়ি মুড়কি, চনা পিঁয়াজুসহ নানা রকম উপাদেয় খাবার। আর তা গলাধঃকরণ করতে করতে তারা উপভোগ করতে থাকে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

শুরুতেই এই প্রজন্মের একঝাক শিশু-কিশোরের সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হয় পয়লা বৈশাখের সেই কালজয়ী গান, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো,এসো’। আর তাতেই নস্টালজিক হয়ে পড়ে উপস্থিত দর্শকেরা। তারাও শিশুশিল্পীদের গানের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সান্ত্বনা রায় চৌধুরীর নির্দেশনা ও পরিচালনায় শিশুশিল্পীদের কণ্ঠে আরও একখানা সমবেত সংগীত পরিবেশন শেষে মঞ্চে আসেন শিল্পী দম্পতি নুরুল আবসার ও নূরুন নাহার। তাদের কণ্ঠে একক ও যুগল পরিবেশনা শেষে মঞ্চে আসেন রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী সান্ত্বনা রায় চৌধুরী। তিনি পরপর দুটি রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করে দর্শকদের বিমোহিত করেন। এরপর কবিতার ডালা মেলে ধরেন আবৃত্তিশিল্পী সুব্রত চৌধুরি। তাঁর কণ্ঠনিঃসৃত আবৃত্তিকে নাচের মুদ্রায় তুলে ধরে তিন শিশু নৃত্যশিল্পী পার্বতী, ভূমি ও অনামিকা। তাদের মনোজ্ঞ নৃত্যটির কোরিওগ্রাফিতে ছিলেন সাউথ জার্সির জনপ্রিয় কোরিওগ্রাফার নিবেদিতা ভট্টাচার্য। এরই মাঝে সময় হয়ে যায় নৈশভোজের। টেবিলে থরে থরে সাজানো বাঙালিয়ানা খাবার যেমন-হরেক পদের ভর্তা, ভাজি, ইলিশ মাছ ভাজা, কোর্মা-পোলাও, বিরিয়ানি, মিষ্টান্ন, ফল-ফলাদিসহ হরেক রকমের খাবার। এসব উপাদেয় খাবার গলাধঃকরণ করতে করতে দর্শকেরা উপভোগ করতে থাকে নিউইয়র্ক থেকে আসা স্টার সার্চ ইউএসএ-২০১২ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকারী শিল্পী দেলোয়ার হোসেনের মনোজ্ঞ সংগীত পরিবেশনা। তাঁর কণ্ঠে একে একে পরিবেশিত হয় বাউল, লালনসহ আধুনিক ও হারানো দিনের বাংলা গান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিল্পীদেরকে তবলায় সহযোগিতা করেন তপু। পুরো অনুষ্ঠানের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সেলিম সুলতান, শহীদ খান, সোহেল আহমেদ, মিরাজ খান, আবদুর রব, সোহাগ করিম, লিটন চৌধুরী, সফিকুল আলম জিন্নাহ, শেখ সেলিম, জয়ন্ত সিনহা, মো. ইসমাইল হোসেন প্রমুখ।
ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাত বাড়তে থাকে। মিলনায়তনের গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকটা ঢং ঢং করে জানান দেয় রাত নিশুতির, সেই ঘণ্টাধ্বনির রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই ভাঙে মিলনমেলা।