বেহুলা কখনো বিধবা হয় না...

বাংলার বেহুলার বিশ্বাস ছিল, তার স্বামী একদিন বেঁচে উঠবে। রোমান পুরাণের সাইকি আস্থা রাখতে পারেনি স্বামীর ওপর। আস্থা আর বিশ্বাসের সংকটে পড়ে, প্রবাসের পরিকল্পিত সংসার থেকে সুখপরি উড়ে যাচ্ছে। কল্পনাকে আঁকড়ে ধরে অনেকে বিলাপ করে। সংসার ভাঙার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে কেউ দাঁড়াতে পারে। আবার অনেকে হৃদয় ভাঙার নিষ্ঠুর আঘাতের ধকলে নিজেকে নিঃস্ব করে দিতে দ্বিধা করে না। সম্প্রতি প্রথম আলোর উত্তর আমেরিকা সংস্করণে দেখা গেল, ‘গৃহবিবাদ বাড়ছে, ভাঙছে সংসার’ শিরোনামের খবর। এ রকম প্রতিদিন কত খবর আসে পরিবার ভাঙার। এ রকম অমানবিক ঘটনার অনেক খবর আমাদের সমাজের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। সরস্বতীর সাম্রাজ্যে থেকেও দেশি স্বামীর মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে যায়। তবু সংসারে রাজা হতে পারে না। সুখের আশায় স্বপ্নের দেশে আসা বালিকাদের স্বপ্ন হয়ে ওঠে দুঃস্বপ্ন। ভারতীয় সিরিয়ালগুলোর অনেক দৃশ্যও যেন হার মানায়। প্রবাসে এমন কিছু আত্মমর্যাদাহীন পুরুষ আছেন, যাঁরা স্ত্রীর উপার্জনে খেয়েপরে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন, নিজেরা কিছু করতে চান না। বিদেশের সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা তরুণ-তরুণীরা দেশের সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধের ওপর শ্রদ্ধা রেখে বা পরিবারের অভিভাবকদের খুশি রাখার জন্য বাংলাদেশি পাত্র-পাত্রীকে বিয়ে করে প্রবাসে নিয়ে আসেন। প্রবাসের সংসার দেশের পাত্র-পাত্রীদের জন্য কতটা সুখের, কতটা বেদনার, তা তাঁদের আর্তনাদ যাঁরা শুনেছেন বা দেখেছেন, কেবল তাঁরাই ভালো বলতে পারেন। বিদেশি অনেক বধূ স্বামীর সংসারে যতটা আর্থিক জোগান দেন, তার চেয়ে বেশি উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের সুযোগ আদায় করে নিতে দ্বিধা করেন না। দেশি স্বামী লাখপতি না হলেও আছে সোনাদানা, হীরা আর জহরতের আবদার। গাড়ি-বাড়ি-শাড়ি সবকিছু তাঁর দামি হওয়া চাই। স্ত্রীর ভোগবিলাসের বায়নার কাছে দেশি স্বামীকে নতজানু হতে হয়। এমন সত্যের সন্ধান কতজন রাখেন? বিদেশি বধূর অযৌক্তিক মনোবাসনা পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতায় স্ত্রীর ওপর অধিকার হারাতে হয়েছে—এমন কিচ্ছা-কাহিনি অনেকের জানা আছে। নিজের মতো করে চলা স্ত্রীকে ভালোমন্দ বলার সাহস হারিয়ে অনেক স্বামীর সংসারে রাজা হওয়া তো দূরের কথা, প্রজা হয়েও প্রাণ বাঁচে না!
এমন অনেকে আছেন, যাঁরা নিউইয়র্কে নগর কুতুব হিসেবে সভা-সমিতির অগ্রভাগে থাকেন, নীতির বয়ান করেন, আড়ালে অনৈতিক আমোদে-ফুর্তিতে লিপ্ত থাকেন। নিজের লালসা চরিতার্থ করতে গিয়ে সুখের সংসারে বিচ্ছেদ-বিরহ ও অশান্তির আগুন জ্বলার খবর অনেকেই জানেন। নিউইয়র্কের বাঙালি কমিউনিটতে এ খবর তো আর অজানা নেই। নারী কেলেঙ্কারি, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ বাঙালি কমিউনিটিতে কম দেখা যায় না। এমন বেশ কয়েকটি ঘটনায় অনেক বাংলাদেশিকে নিউইয়র্ক সিটি পুলিশের গ্রেপ্তার করার নজির আছে। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে এমন খবরের শিরোনাম প্রায়ই চোখে পড়ে।
বাংলার বেহুলা স্বামী লখিন্দরের সঙ্গে বাসর রাত কাটাতে না পারলেও মৃত স্বামীর ভালোবাসার বন্ধন ত্যাগ করে কোথাও যায়নি। সর্প দংশনে মারা যাওয়া লখিন্দরকে নিয়ে অজানার উদ্দেশে সাগরে ভেলা ভাসাতে দ্বিধা করেনি। রোমান পুরাণের রাজকুমারী সাইকি স্বামীর সোনার রাজপ্রাসাদে থেকেও স্বামীর ভালোবাসার মূল্য দিতে পারেনি। বোনদের কথায় স্বামীর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে চাকু চালাতেও দ্বিধা করেনি। বাংলার বেহুলা নারী আর রোমান পুরাণের সাইকি এক হয় না। মনসা দেবীর প্রতিহিংসার দংশনে বাসর রাতে মারা যাওয়া স্বামী লখিন্দরের দেহ একা ভেলায় না ভাসিয়ে জীবন-মরণের সঙ্গী হয়েছিল বেহুলা। এখানে ওপার বাংলার প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কবির সুমনের গাওয়া গানের একটি লাইন খুবই প্রাসঙ্গিক, ‘বেহুলা কখনো বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি।’ উল্টো দিকে রোমান পুরাণের কেন্দ্রীয় চরিত্রের নায়িকা অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমারী সাইকি বোনদের কথায় প্রেমের দেবতা ঘুমন্ত স্বামী কিউপিডের বুকে চাকু ধরে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে দ্বিধা করেনি। অদৃশ্য স্বামী লাভের আশায় মৃত্যুর কাছাকাছি যেতে পারলেও বোনদের কথায় সাইকি স্বামীর ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেনি। অবিশ্বাসী স্ত্রী সাইকিকে উদ্দেশ করে স্বামী কিউপিড শোনালেন, ‘যেখানে বিশ্বাস নেই, সেখানে ভালোবাসা থাকতে পারে না।’

লেখক: সাংবাদিক, নিউইয়র্ক।