বৃষ্টির রাতে স্মৃতির সাগরে
রাত্রি দ্বিপ্রহর। রাত যত গভীর হয়, সুস্থির মন অকারণে অস্থির হয়ে ওঠে একাকিত্ব, বিষণ্নতা, বিরহ কাতরতা তত পেয়ে বসে। ঘরের আবছা নীল আলোয় প্রিয় ইন্দ্রাণী সেনের কণ্ঠে ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার’ গানটা ইউটিউবে বেজে যাচ্ছে আর বুকের গহিনে ঘুমিয়ে পড়া বেদনাগুলো মাথা ছাড়া দিয়ে উঠেছে। বাইরে ধুম বৃষ্টির সঙ্গে হালকা তুষারপাত। গায়ে শীতের কাপড় জড়িয়ে জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। জানালার পর্দা ফাঁক করে বিধ্বস্ত প্রকৃতির দিকে অপলক চেয়ে থাকি। রাস্তার নিয়নবাতির আলো আকাশ থেকে কিশোরীর মতো হেলেদুলে পড়া তুষারপাতকে বর্ণময় করে তুলেছে। জানালার পাশে নির্বাক আমি আপনমনে দাঁড়িয়ে থাকি। পুরো প্রকৃতিজুড়ে এক বিস্ময়কর চেনা সুর যেন আমাকে নস্টালজিক করে তুলেছে এই রাত নিশীথে। স্মৃতির মহাসাগরে ডুবে যেতে থাকি।
বৃষ্টির শব্দ যত ভারী হচ্ছে, ততই যেন আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, আম্মা আমাকে নাম ধরে ডাকছেন। তাড়া দিচ্ছেন উঠোনের দক্ষিণ কোণে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো তাড়াতাড়ি ঘরে নিয়ে আসতে! মুরগির বাচ্চাগুলোকে শুকনো জায়গায় এনে রাখতে। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরের এই শহরের বাতাসের পরতে পরতে বয়ে যাওয়া চেনা গন্ধে আমি দিশেহারা! নানার বাড়ি থেকে চালের গুঁড়ো, খেজুরের রস পাঠানো হতো শীতকালে। মায়ের হাতে বানানো খেজুরের রসের পায়েস সঙ্গে ভাঁপা পিঠার সুঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারপাশ! মাটির উনুনের আঁচে দাদার সঙ্গে কাঠের পিঁড়িতে বসে বেশ আয়েশ করে গোগ্রাসে শীতকালীন পিঠা, পায়েস গিলছি।
ভাবনার কোনো স্বরলিপি নেই। মনে হচ্ছে স্মৃতিভর্তি একটা হিলিয়াম বেলুনে ভর করে এই ভিনদেশের আকাশে আমি উড়ছি তো উড়ছি। নিউইয়র্ক শহরের পিচঢালা ছাইরঙা রাস্তার ওপরে পড়ে থাকা শুভ্র তুষারপাত মনে করিয়ে দিল দেশের শিউলি ঝরা পথের কথা। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিউলি তলায় গিয়ে আঁজলা ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনা অতঃপর সুই-সুতা দিয়ে নিজ হাতে মালা গেঁথে সে মালা দাদার গলায় পরিয়ে দেওয়া! উদ্দেশ্য একটাই উপঢৌকন হিসেবে দাদার কাছ থেকে টাকা পাওয়া। সে টাকা দিয়ে দিনভর মালাই আইসক্রিম, চালতার আচার, কটকটি, লজেন্স, চানাচুর খাওয়া। দাদার দেওয়া পাঁচ টাকা দিয়ে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তৃপ্তিভরে খেয়েও সে টাকা শেষ হতো না। দিন শেষে কিছু আধুলি থেকে যেত। জীবনের বড় বেলায় এসে ব্যাগভর্তি ডলার চোখের নিমেষেই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু সাধ মেটে না। বিদেশের ফুলে গন্ধ নেই বলে এ দেশের ফুলগুলোকে কাগজের ফুল মনে হয় আমার কাছে। তাই ফুলগুলো কখনো ধরেও দেখি না, মালাও গাঁথি না আর। ফুলে ঘ্রাণ নেই, ডলারেও তৃপ্তি নেই। আহা! কত মধুর ছিল ফেলে আসা শৈশব!
শেষ রাতের বৃষ্টি নিঃসঙ্গ মানুষের মতন একা। শেষ রাতের বৃষ্টি একাই লুটিয়ে পড়ছে নীরবে মাটির বুকে। শেষ রাতের বৃষ্টিতে কেউ ভেজে না। ভীষণ মনে পড়ছে সবুজের মায়ায় আবৃত আমার ছোট্ট সোনাঝরা সে গ্রামের কথা। হাড় কাঁপানো শীত। মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। পুবের আকাশে তখনো সূর্য উঁকি দেয়নি। আম্মা ঘুম ভেঙে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য উঠতে চাইলে ঘুমের ভান ধরে আম্মার বুকের ওমে কাদা মাটির মতো আরও বেশি লেপ্টে থাকতাম। সে কত বছর আগের কৈশোরে ফেলে আসা স্মৃতি! আজ এত বছর পরে যখন জানালার ফাঁক দিয়ে হু হু করে জানুয়ারি মাসের ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরে; আমি তখন মায়ের বুকের ওম অনুভব করছি দুচোখ বন্ধ করে! শীতের তীব্রতা যত বাড়ছে, মা যেন আমাকে তাঁর বুকের ওমে ততটাই শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। রুমের শীতাতপ যন্ত্রের ওপর ঝরে পড়া বৃষ্টির টুপটাপ ছন্দ আমাকে নিয়ে যায় কৈশোরের টিনের চালের বৃষ্টির ছন্দের কাছে। যদিও এ দেশের বৃষ্টিকে আমার কাছে কৃপণ, অলস মনে হয়। কোনো তাল, লয়, ছন্দ নেই। আমার ছোটবেলার সেই ঘরটি আজ আর নেই। সে ঘরে যাঁরা জন্মেছে, বড় হয়েছে তারাও নেই। জীবনের প্রয়োজন তাঁদের উড়িয়ে নিয়ে গেছে ভিন্ন জনপদে। সে ঘর, বাড়িজুড়ে বাবা–মা নেই। কোথায়ও কোনো কোলাহল নেই। বৃষ্টির দিনে শুকনো কাপড় ঘরে আনার তাড়া নেই। সুরে সুরে হাঁস, মুরগি ডাকার শব্দ নেই। রাত নেমে এলে হারিকেন, কুপি জ্বালাবার তাড়া নেই। উঠানে দাদার মুখে গল্প শোনার হইচই নেই। বাতাসে মায়ের হাতে বানানো শীতকালীন পিঠা, পুলির সুঘ্রাণ নেই। পাখির চেয়েও মানুষ বড় পরিযায়ী। স্মৃতি বুকে নিয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায় পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এমন বৃষ্টির রাতে স্মৃতি হাতড়ে আমার সে শূন্য ভিটেমাটিও কি কাঁদে আমার মতো রাত নিশীথে খুব নীরবে! জানি না!
ছোটবেলায় সবচেয়ে প্রিয় মাস ছিল ডিসেম্বর, স্কুল বন্ধ। লেখাপড়া নেই। ভোরে ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। জানুয়ারি ছিল আনন্দের মাস। বছরের নতুন মাস শুরু হওয়া মানেই কত সহস্র আবদার, অজুহাতের কথা যে মনে পড়ে। নতুন জামা, নতুন বইয়ের মিষ্টি ঘ্রাণ এখনো নাকে এসে লাগে। হঠাৎ আকাশে বজ্রপাতের বিকট শব্দকে মনে হলো ছোটবেলায় মায়ের মাটির ব্যাংক ধপাস করে ভেঙে ফেলার শব্দের মতো। মায়ের মাটির ব্যাংকে জমানো টাকায় নতুন জামা, জুতা, স্কুলব্যাগ কেনার আনন্দ, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস স্মৃতি হয়ে আজ বৃষ্টির মতো চোখে ঝরছে। সুখ স্মৃতিগুলো মানুষকে বেশি কাঁদায়। মানুষ হয়ে জন্মানোর অন্যতম বড় কষ্ট হলো স্মৃতির আঘাতে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হওয়া। আমাদের গ্রামের মানুষগুলো তখনো আভিজাত্যের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়নি। গ্রামগুলো সহজ সরল গ্রাম-ই ছিল; ইট-কাঠের শহর হয়ে ওঠেনি। মাটিতে ভেজা গন্ধ ছিল। মানুষগুলোর মনও মাটির মতো নরম ছিল। তখনকার দিনে এ বাড়ি ও বাড়ির মানুষ অবসর কাটাত একে অন্যের সঙ্গে গল্প করে, আড্ডা দিয়ে। ফেরার পথে একে অপরকে এগিয়ে দিত সদর দরজা পর্যন্ত।
জীবনের এই বেলায় এসে এখন এই শহরটাকে আমার কাছে যন্ত্র মনে হয়। তেমন কোথায়ও কোনো আন্তরিকতা নেই; বেশির ভাগ বিষয়গুলো লোক দেখানো। বিশেষ কোনো দিন ছাড়া কেউ কারও বাড়িতে যায় না, খোঁজ নেয় না। সত্যিকারের স্পর্শের আনন্দ পাওয়া এই শহরে দুষ্কর। সর্বত্র কেমন কবর কবর লাগে। আমি যেন এক অপরিচিত এই শহরে। কারও কেউ নয়, কেউ কারও নয়। দেশ ছেড়েছি বহু বছর আগে। আজও দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরায় শুধু দেশের সুর বাজে। এমন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে এলে স্মৃতির ভারে মনটা খুব নুয়ে পড়ে। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া আপন মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে। মন আপন মানুষদের মমতা খোঁজে।