বৃক্ষ আমায় করো ক্ষমা

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

গাছপালা আমার ভালো লাগত। কিন্তু সেটা নিয়ে বাড়াবাড়ি ধরনের কোনো উচ্ছ্বাস আমার কোনকালেই ছিল না। আর বাগান করার কোনো কারণ কখনই ঘটেনি। ছোটবেলাতে মাকে দেখতাম বাগান করতে। শাকসবজি আর ফুলের বাগান। আমাদের বিরাট উঠান ছিল। মা তার বেশির ভাগেই নানা ধরনের গাছপালা লাগাতেন। রান্নাঘরের চালের ওপর লকলক করে বেড়ে ওঠা লাউ-কুমড়া, ফলের ভারে নুয়ে পড়া সজনে আর পেঁপে গাছ, আর বাগান ভর্তি ফলফুলের সমাহার দেখে কখনো মনে হয়নি যে, এগুলোর পেছনে একজন মানুষের কতটা শ্রম আর মমতা থাকতে পারে। আমার মাকে দেখতাম প্রতিদিন সকাল আর বিকেলবেলাতে বাগানে কাজ করছেন। তাঁর নিজের সন্তানদের যেমন পরম যত্নে মানুষ করেছেন হয়তো তার চেয়েও হয়তো বেশি মমতায় বাগানের গাছগুলোর পেছনে সময় দিয়েছেন। মাঝে মাঝে দেখতাম তিনি গাছগুলোর কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন, পরম স্নেহে গাছে হাত বুলাচ্ছেন। আমরা ভাইবোনেরা হাসতাম। মাকে রাগানোর জন্য লাঠি দিয়ে গাছে আঘাত করতাম, গাছের ডাল ভেঙে ফেলতাম, কচি ফল ছিঁড়ে ফেলতাম। মা খুব কষ্ট পেতেন। শিশুরা অনেক সময় হাসিমুখে অনেক নিষ্ঠুর আচরণ করে ফেলে।
বিয়ের পর আমার স্ত্রীকে দেখি ফ্ল্যাট বাড়ির ব্যালকনি নানা ধরনের ফুলের গাছের টব দিয়ে ভর্তি করে ফেলেছে। তাঁর প্রিয় ফুল বেলি। ছুটির দিনে আমাকে নিয়ে ঢাকা শহরের নার্সারিগুলো ঘুরে বেড়ায়। খামার বাড়ি থেকে মাটি আনায়। আমি বিরক্ত হই। একদিন তার সঙ্গে রাগারাগি করে গভীর রাতে কৌশলে তার সবচেয়ে প্রিয় বেলি ফুলের গাছটির শিকড় কেটে দিলাম। স্ত্রীরা স্বামীদের যেকোনো ধরনের চালাকি ধরে ফেলে চোখের নিমেষেই। আমার প্রখর বুদ্ধিমতী স্ত্রীও আমার অপকর্ম উদ্‌ঘাটন করে ফেলল সকালবেলাতেই। ফলাফল হলো বাপের বাড়ি গমন। তার পিত্রালয়ে অবস্থানকালে আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যালকনির গাছগুলোতে পানি দিলাম না। দুই সপ্তাহ পর যখন আমার স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে আরেকটা বেলি ফুলের চারা নিয়ে ফিরে আসল তখন দেখা গেল সবগুলো গাছই মরে গেছে, শুধু একটা ক্যাকটাস গাছ বেঁচে আছে। আমার স্ত্রী আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন আমি ভয়ংকর কোনো ক্রিমিনাল। আমাকে এখনই রিমান্ডে নেওয়া দরকার। আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে উদাস মুখে সিগারেট টানতে থাকলাম।
অস্ট্রেলিয়াতে আসার পরে ভাবলাম আমার স্ত্রীর গাছ লাগানোর শখের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সে দেখি কেমন উসখুস করা শুরু করল। আমাকে নানাভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে দেশে ফেলে আসা গাছগুলোর কথা করুণ ভাবে উপস্থাপন করতে লাগল। বিশেষ করে তার প্রিয় বেলিগাছের কথা। শেষ পর্যন্ত আমি ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে তাকে ১২ ডলার দিয়ে বানিংস থেকে একটা বেলি ফুলের চারা কিনে দিলাম। আমার কাছে মনে হলো পুরো টাকাটাই পানিতে গেল। সে মহা উৎসাহে বেলি ফুলের গাছ বড় করার কাজে উঠে পড়ে লাগল। চাল ধোয়া পানি, ব্যবহৃত চায়ের পাতি, আরও কীসব কীসব দিয়ে সে গাছটাকে বেশ বড়সড় করে ফেলল। এখন এটাকে হয় বড় টবে নাহয় মাটিতে লাগাতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে বাগান করা বাংলাদেশের মতো না। উঠানের কোণে বিচি ফেললাম আর ধাই ধাই করে গাছ হয়ে গেল, ব্যাপারটা এত সহজ না, বেশ কঠিন। এখানকার মাটি ঊষর। স্থানীয় গাছগাছড়া ছাড়া অন্য গাছ করা পর্বত সমান কাজ। তবে উন্নত দেশ, সব ব্যবস্থা করা আছে। বিশাল বিশাল স্টোরে বাগান করার জন্য গাছের চারা, মাটি, সার থেকে শুরু করে সব ধরনের জিনিস কিনতে পাওয়া যায়।

এ দেশে কেবল এসেছি। এখনো ডলারে অভ্যস্ত হতে পারিনি। যেকোনো জিনিসের দাম বাংলাদেশি টাকাতে হিসাব করি। এক বস্তা মাটি আট ডলার, একটা টব ছয় ডলার, সার পাঁচ ডলার, অন্যান্য টুকিটাকি ১০ ডলার—সব মিলিয়ে ২৯ ডলার, মানে দুই হাজার টাকারও বেশি। একটা বেলি গাছের জন্য দুই হাজার টাকা! আমি আঁতকে উঠি। শুধু একটা টব কিনে দিই আমার স্ত্রীকে। আর বিরস মুখে বলি, বাগানের এক কোণ থেকে মাটি নিয়ে নাও। আমার স্ত্রীও এত খরচান্তি দেখে আর কোনো চাপাচাপি করল না।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অফিস থেকে বাসাতে ফিরে আমার একটা পছন্দের কাজ হলো পেছনের বাগানে বসে চা খাওয়া। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করি। মাঝে মাঝে কোনাতে রাখা বেলি ফুলের গাছটাকে অন্যমনস্ক ভাবে খেয়াল করি। কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে গাছটার অবস্থা ভালো না, পাতাগুলো সব মরে যাচ্ছে। কয়েকটা ফুলের কুঁড়ি অতি কষ্টে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। বেলি ফুলের গাছের পাতা মরে যাচ্ছে, এটা আমার কাছে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। কাজেই এটা নিয়ে আমি আর মাথা ঘামালাম না। কিছুদিন পর দেখি গাছটার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। আমি নিছক কৌতূহলে গাছটার পাশে একটু বসলাম। গাছপালা সম্পর্কে আমার জ্ঞান শূন্যের কাছে। নিতান্তই করুণাবশতঃ গাছটার মৃতপ্রায় পাতাগুলো হাত দিয়ে ছোঁয়ালাম। হঠাৎ করেই আমার মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। আমার কাছে মনে হলো আমি কোনো গাছ না, একজন মুমূর্ষু মানুষের হাত ধরে আছি, মানুষটির দৃষ্টি অত্যন্ত বিষণ্ন। আমি অনেক রাত পর্যন্ত বাগানে ভূতগ্রস্থের মতো বসে থাকলাম সেদিন। পরদিন আমরা স্টোর থেকে সবকিছু কিনে নিয়ে আসলাম। তার পরের দুই সপ্তাহ আমি আর আমার স্ত্রী দুজনে মিলে চেষ্টা করলাম গাছটাকে বাঁচিয়ে তুলতে। আমার স্ত্রী মনে হয় দুই রাকাত নফল নামাজও পড়ে ফেলল।
বেলি ফুলের গাছটাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। তবে গাছটি আমার মধ্যে গাছপালার জন্য অসীম মমতার বীজ বুনে দিয়ে গেছে। ‘গাছের প্রাণ আছে’ এটা শুধুমাত্র একটা বৈজ্ঞানিক তথ্যই নয়, এটা উপলব্ধির ব্যাপার। আমাদের পেছনের বাগানে এখন আমরা অনেক গাছ লাগিয়েছি। আমি সারা দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি কখন অফিস থেকে ফিরে বাগানে যাব। আমার মাকে ফোনে আমার বাগানের কথা বলি। তিনি খুব খুশি হন। বিকেলে এখনো আমি বাগানে বসে চা খাই, পাশে আমার স্ত্রী বসে থাকে। আমাদের চারপাশে থাকে আমাদের লাগানো গাছগুলো। আমার দুই ছেলে ছোটাছুটি করে খেলে। আর কেউ না দেখুক, আমি ঠিকই দেখতে পাই আমাদের গাছগুলো হাসিমুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কখনো কখনো হঠাৎ করেই বেলি ফুলের একটা তীব্র গন্ধ বাতাসে ভেসে আসে।