বুবুর সঙ্গে সারা দুপুর

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বড়বোনের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর মজাই অন্যরকম। তা সে ছোট বোনের বয়স দশ হোক কী চল্লিশ! প্রবাসজীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হচ্ছে, বড়বোনদের সঙ্গে আমার কদাচিৎ দেখা হওয়া। একসঙ্গে বেড়ানোর সুযোগ তো অনেক দূরের কথা। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, এই চর্মচক্ষুর দেখা না হওয়া আমাদের কঠিন ভালোবাসাকে এতটুকুও হালকা করতে পারে না। প্রতিবার আমাদের দেখা হয়, যখন আমি প্রাণভরে ওই ভালোবাসাটুকুর রং-রূপ-স্পর্শ অনুভব করি। টক-ঝাল-মিষ্টি আচারের মতো শেষ বিন্দু পর্যন্ত আমি খুঁটে খুঁটে আমি স্বাদ নেই ওই ভালোবাসার।

এইবার দেখা হলো দীর্ঘ পাঁচ বছর পর। অল্প সময়ে অসংখ্য কর্মসূচির মধ্যে ওপরের দিকে বরাবরই থাকে বইমেলায় যাওয়া (বইমেলাকে মাথায় রেখেই আমি দেশে যাওয়ার চেষ্টা করি)। আমার ধৈর্য ভীষণ কম। দেশে যাওয়ার পর থেকেই বোনকে বারবার তাগাদা দিতে থাকি। অতঃপর বইমেলা ভালো করে জমে ওঠার আগেই এক দুপুরে আমি আর আমার বোন টুক টুক করে হাজির হই বইমেলায়। আমি আনন্দ চেপে রাখতে পারি না। প্রায় আল জিহ্বা বের করে হাসতে থাকি।
বোন আমাকে ছোটবেলার মতো হুঁশিয়ারি দেয়, ‘দেখে হাঁটো’।
আমি বাধ্য মেয়ের মতো রাস্তা, ড্রেন, ম্যানহোল ইত্যাদির দিকে একটু নজর দিই। কার্জন হলের উল্টো দিকে ঢোকার মুখে ফুলের ব্যান্ড বিক্রি করছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। বোন দুটি ব্যান্ড কেনে আমাদের জন্য। আমাদের সেই ঝকঝকে তারুণ্যের দিন আর নেই। তারপরও আমরা দুই মাঝবয়সী নারী মাথায় ফুলের ব্যান্ড পরে হাঁটতে থাকি। একটুও সংকোচ হয় না। মনে হয়, এরচেয়ে স্বাভাবিক আর কী হতে পারে!

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বইমেলাকে বড় আপন লাগে। ছোটবেলা থেকেই এখানে আনাগোনা আমাদের। শুরুটা আব্বা আম্মার হাত ধরে। তারপর নিজেরা নিজেরাই। কলাভবনে পড়তাম যখন, প্রায়দিনই ক্লাস শেষে এক আধবার ঢুঁ মারা তো হতোই। কিন্তু বোনদের সঙ্গে একবার না আসলে যেন বইমেলার আমেজটা পুরোপুরি পাওয়া যেত না। বহুদিন পর সেই সময়গুলো উঁকি দিতে থাকে অনেক অনেক বছরের ওপার থেকে।
বইমেলায় ঢুকে রাশি রাশি বইয়ের মুখোমুখি হয়ে কেমন দিশেহারা লাগে মুহূর্তের জন্য। আমার হাতে সময় বড় কম। আমি গা ঝাড়া দিয়ে প্রস্তুতি নিই ঝাঁপিয়ে পড়ার। বোনের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার চোখ চকচক করছে, হাত মুষ্টিবদ্ধ। আমরা দুই বোন এক স্টল থেকে আরেক স্টলে নিরলস হাঁটতে থাকি। ছোটবেলার মতো বিনা বাক্যব্যয়ে আমি বোনকে অনুসরণ করি। আমাদের মধ্যে কথা হয় কম। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি আমরা কী কিনতে চাই, কী খুঁজছি।
বোনের চোখের ভাষা বুঝতে ভুল হয় না আমার। বোনও আমার হাতে নির্ভুলভাবে তুলে দেয় আমার কাঙ্ক্ষিত বইগুলো। আমরা হাসতে থাকি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে। আমি আমার কৈশোর, তারুণ্যের দিনগুলোর কথা মনে করি। আর মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হই, একজন মাঝবয়সী নারীকে তার বোনের চেয়ে ভালো করে আর কেউ বুঝতে পারে না। সেই বোন, জীবনের অনেকগুলো বছর যার সঙ্গে কেটেছে।
বরাবরের মতো আমাদের ব্যাগগুলো ভরে উঠতে থাকে। আগের জীবনের সঙ্গে শুধু পার্থক্য এই যে, আগে একটা বই একটাই কেনা হতো বাসার জন্য। এখন আমি আর বোন প্রতিটা বই দুটি করে কিনি। একটা আমার সঙ্গে চলে আসবে দেশ ছেড়ে, আরেকটা থাকবে আমার বোনের শেলফে।
দুপুরের রোদে আমার গলা শুকিয়ে ওঠে। একটা স্টলের ভেতর বসে সবাই পেয়ারা আর বড়ই খাচ্ছে। চিরকালের পেটুক আমি বোনের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকি, ‘আমি পেয়ারা খাব, প্লিজ চল পেয়ারা খাই’।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

বোন তখন বই কেনার ঘোরে আছে। গম্ভীর গলায় আমাকে থামানোর চেষ্টা করে—‘কাজের সময় বিরক্ত কোরো নাতো। তোমাকে পরে পেয়ারা খাওয়াব’।
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলি ফিক করে। আমি এখন একটা সংসারের কর্ত্রী। এভাবে কত দিন কেউ ধমক দেয় না আমাকে! আমার লোভ বেড়ে যায়। পেয়ারা খাওয়ার লোভ না, ধমক খাওয়ার লোভ। আমি ক্রমাগত গুনগুন করতে থাকি, ‘পেয়ারা...পেয়ারা...প্লিজ’।
বোন কোনো কথা না বলে খপ করে আমার হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে আসে অন্য স্টলে। আমরা আবার মনোনিবেশ করি বই কেনায়। বেলা গড়াতে থাকে বিকেলের দিকে। মেলায় লোকজন বাড়তে থাকে। এদিক-ওদিক টিভি ক্যামেরা হাতে কিছু ছেলেমেয়েদের ব্যস্ত পায়ে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়। হঠাৎই একজন এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। বোনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, ‘আপু, আপনাকে একটু প্রশ্ন করি?’
বোনও আত্মবিশ্বাসী গলায় বলল, ‘করুন’।
‘আপু, আপনি তো অনেক বই কিনেছেন দেখতে পাচ্ছি, নতুন লেখকদের মধ্যে কার কার বই কিনেছেন?’
বোন ইতস্তত করতে থাকে উত্তরের জন্য।
একটু বিরতিতে প্রশ্নকর্তা আবারও প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘নতুন লেখকদের লেখা আপনার কেমন লাগে?’
বোন এবার স্পষ্টতই নিরুত্তর থাকে।
টিভি চ্যানেলের ধৈর্যশীল ছেলেটি এবার বেপরোয়া হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার পছন্দের কয়েকজন নতুন লেখকের নাম বলবেন?’
আমি পেছনে দাঁড়িয়ে পড়া না পারা ছাত্রের মতো মাথা নিচু করে হাসতে থাকি। আমার বোন কী উত্তর দেয় আমার শোনা হয় না। আমি জানি না সে কী উত্তর দেবে। আমি শুধু জানি, আজকে মেলায় এসে আমরা কোনো নতুন বই খুঁজিনি, কোনো বেস্টসেলার, কোনো পাঠকপ্রিয় গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কোনো নতুন লেখকের বই...কিচ্ছু না। আমি আর বোন শুধু পুরোনো সময় খুঁজে খুঁজে বেরিয়েছি। দুজনে মিলে পাগলের মতো ওই সব বইগুলি খুঁজে বের করেছি, যেগুলো একসময় আমরা কিনে কিনে আমাদের নিজেদের বাসার বুকশেলফে রেখেছিলাম। যে বইগুলি আমরা একসঙ্গে ভাগাভাগি করে, কাড়াকাড়ি করে পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আমাদের তিন বোনের কথায়, গল্পে, হাসিতে, বেদনায় এখনো যে বইগুলোর কথা ফিরে ফিরে আসে বারবার। আমি আর বোন মিলে শুধু সেই বইগুলোই কিনেছি।
জীবন তার প্রয়োজনে কত দূরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে আমাদের। বছরের পর বছর একবারের জন্য দেখা হয় না। তবু বুকের ভেতর সেই যৌথ জীবনের মুহূর্তগুলো ফিরে পাওয়ার কী অসম্ভব ইচ্ছা! এ যেন অনেক আগে পেছনে ফেলে আসা, এক ছাদের নিচে কাটানো একটা জীবনকে ছুঁয়ে দেখার একটা করুন চেষ্টা মাত্র।
বুঝতে পারি, সারাটা দুপুর ধরে আমি আর বোন বইমেলা নয়, শুধু স্মৃতির রাস্তায় নিরলস হাঁটাহাঁটি করেছি। দুই হাতে ভারী ব্যাগ নিয়ে আমরা আবার কার্জন হলের দিকে হাঁটতে থাকি। বোন ঈষৎ ক্ষিপ্ত টিভির লোকদের ওপর। আবার একটু চিন্তিতও।
তাই তো! আমরা সব পুরোনো বই কিনলাম কেন আজকে! আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি নিঃশব্দে। হয়তো ঠিক পরিষ্কার নয়, তারপরও আমরা দুজনই মনে মনে জানি, কেন আমরা ব্যাগ ভরে শুধু আগের পড়া বইগুলোই কিনেছি। বিকেলের আলোতে আমরা দুই মধ্যবয়সী নারী দুই হাতে ব্যাগভর্তি স্মৃতি নিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরতে থাকি।
পুনশ্চ: বইমেলায় ধৈর্য ধরার পুরস্কার হিসেবে ফেরার পথে বোন আমাকে অনেক পেয়ারা কিনে দিল বাজার থেকে। আর সঙ্গে ফাউ পেলাম দারুণ মজার স্ট্রবেরি।

* শিরোনামটি খালেদা এদিব চৌধুরীর ‘বুবুর জন্য সারাদুপুর’ ছোটগল্প থেকে নেওয়া।