বুঝলাম, কোনো কাজই ছোট নয়

আমেরিকায় আসার পর কাজের জন্য একজনের বাসার সামনে সকাল ৭টায় ঠান্ডার মধ্য বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। ওই সময় ১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা ছিল। অবশ্য ওই কষ্ট মোটামুটি কাজে লেগেছিল। ৮ ডলার ঘণ্টায় একটা কাজ পেয়েছিলাম। যে জায়গায় কাজ পাই, সেটি মোটামুটি ভালো ছিল! খুবই ভালো ছিল!!
কাজের একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। কাজ শুরু রাত ১১টায়। শেষ সকাল ৭টায়। সারা রাত বালিশের কাভার ভাঁজ করে রাখা আর সঙ্গে ছিল একটা ওয়াকিটকি। ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে কল আসে মাঝে মাঝে, ১০২, কাম টু দ্য ফ্রন্ট ডেস্ক প্লিজ।
কী বলে, প্রথমে একেবারে বুঝতাম না। এ জন্য ফ্রন্ট ডেস্ক কল দিয়ে নিত আর ভালোভাবে বুঝিয়ে বলত। পরে ওয়াকিটকিতে বলে দিত ফ্রন্ট ডেস্ক: রুম নম্বর ৬০৬ নিড আ টুথপেস্ট।
আমি: ওকে নো প্রবলেম
ফ্রন্ট ডেস্ক: ধন্যাবাদ
আমার দারুণ মজা লাগত। একটি পাঁচ তারকা হোটেলের লন্ড্রি রুমে আমি কাজ করতাম। আসলে আমার কাজ ছিল ওয়াকিটকিতে।
ওয়াকিটকিতে সব সময় তো আর কল আসবে না। তাই লন্ড্রি রুমে তাড়া দিয়ে যেত। আর বলে যেতো, আমি যত পারি যেন ভাঁজ করে রাখি। না পারলেও কোনো সমস্যা নাই । তবে ওয়াকিটকি যেন সব সময় সঙ্গে রাখি।
বিশাল বড় মেশিনে লাইনে সকাল ৬টার দিকে ডিটারজেন্ট গুড়া ও ধোয়ার সুগন্ধীর লাইন সংযুক্ত করে যেতে হবে।
আমি কোনোদিনও করতে পারিনি, জিনিসটা আসলেই খুব ঝামেলার। সব মেশিনের পুরোনো বাস্কেটগুলো খুলে সঙ্গে সঙ্গে নতুনটা লাগাতে হবে। আবার সেই সময় ওয়াকিটকিতে সবচেয়ে বেশি কল আসত। অনেক সময় ৭টার পরও কাজ করতে হতো মানুষ কম থাকার জন্য।
একবার দেখি লন্ড্রি সুপারভাইজার আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি খুব অবাক আশ্চর্য, সে আমার নাম ধরে ডাকছে। তাও আবার শেষের নাম (এখানে সবাই প্রথম নাম ধরে ডাকে সচরাচর)। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি আমাকে ডেকেছ, সে বলে না। কিছু সময় পর আবার ডাকে, আমি আবার যাই, সে বিরক্ত হয়ে বলে ‘না’।
আমার সামনে সে আবার বলল, ‘মিরা’। আমি বুঝলাম, আসলে আমার ডাকেনি, আমার নামতো হীরা। সে মিরাকে ডাকছে। (পরে জেনেছি, মিরা স্প্যানিশ শব্দ যার বাংলা অর্থ তাকাও)
প্রথমে কাজে যোগ দেওয়ার আগে আমার প্রশিক্ষণ হলো চার দিন।
প্রথম দিনের প্রশিক্ষণ। একটি গাড়িতে বাস্কেট। পানি মোছার জন্য গ্লাস ক্লিনার, তোয়ালে, টিস্যু আর অনেক কিছু এই গাড়ির মধ্যে! আমার কাজ হচ্ছে, হোটেল লবিতে যতগুলো বাথরুম আছে, সবগুলোর টিস্যু পরিবর্তন করা আর গ্লাস ক্লিন করা! আর যদি অপরিষ্কার থাকে, তা পরিষ্কার করা! আমি এটি শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমি জীবনেও এটি করব না! আমাকে বলা হয়েছে লন্ড্রিতে কাজ! যে আংকেল আমাকে এগুলো বললেন, উনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন, তোমার কাজ রাতে। এখন সকাল, তোমাকে সব করতে হবে। কারণ কোন কক্ষে কি প্রয়োজন হবে কে জানে? তাই তোমাকে সব শিখতে হবে। আর এখন তোমাকে প্রশিক্ষণ করতেই হবে। আমি বললাম, না আমি করব না। আংকেল বললেন, আচ্ছা বাবা তুমি নজরুল ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা কর, উনি আসলে তাঁকে বলবে।
ওনার নাম ছিল আবু। আবু আংকেল খুব ভালো মনের মানুষ। আর হ্যাঁ, এই হোটেলে সকাল আর বিকেলের শিফট মিলিয়ে তখন ৩৬ জন বাংলাদেশি কাজ করতেন। আমিই ছিলাম রাতের শিফটে একমাত্র বাংলাদেশি।
নজরুল ভাই আসলেন সকাল ৮টায়। তাঁর পুরো নাম মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম। সবাই তাঁকে মোহাম্মদ বলে ডাকে। শুধু আমরা যারা বাংলাদেশি তারা নজরুল ভাই বলি! হোটেলের হাউজকিপিং ডিপার্টমেন্টের প্রধান তিনি। এই হোটেলে যত বাংলাদেশি কর্মচারী আছেন, প্রায় সবাই তাঁর মাধ্যমে এখানে যোগ দিয়েছেন। আমি নিজেও।
আমি নজরুল ভাইকে কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, আমার সঙ্গে আসো, দরজা কড়া নেড়ে তিনি একটা রুম ঢুকলেন। হোটেলের ব্যবস্থাপকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন! ব্যবস্থাপক একজন নারী। নাম কিম। নজরুল ভাই তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। এরপর কিম আমাকে বললেন, আজ তোমার প্রশিক্ষণ। প্রথমে তোমাকে একজন দেখিয়ে দেবে, কীভাবে কি করতে হয়। পরে বাকি সব তোমাকে একা একা করতে হবে। তোমার শুরু স্টাফ বাথরুম থেকে। একথা শুনে আমি শেষ।
ব্যবস্থাপক নারী বললেন, এসো আমার সঙ্গে। নজরুল ভাই আর আমি কিমের পেছনে পেছনে। তিনি সুন্দর করে গাড়ি নিয়ে স্টাফ বাথরুমের পাশে গিয়ে সতর্কতা সংক্রান্ত চিহ্ন দিলেন আর আমাকে বলতে লাগলেন, এভাবে শুরু করবে। কিম বললেন, তিনি নারীদের বাথরুম দেখাবেন আর মোহাম্মদ পুরুষ বাথরুম। কিম প্রতিটি কমোডের টিস্যু পরিবর্তন করছেন আর আমাকে খুব সুন্দর করে বোঝাচ্ছে।
কিম গ্লাস ক্লিন করছেন আর বলছেন, কোন তোয়ালে দিয়ে গ্লাস ক্লিন করব। প্রতিটা জিনিস কি ও কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, আমাকে কিম দেখিয়ে দিচ্ছেন আর আমি অবাক হয়ে দেখছি। সর্বশেষ কিম ফ্লোর পরিষ্কার করলেন। কীভাবে মপ দিতে হয়, তা পর্যন্ত কিম আমাকে নিজে করে দেখালেন। নজরুল ভাইও একই কাজ করলেন আর আমি দেখলাম। কিম যখন কাজ করছিলেন তখন আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম তাঁকে সাহায্য করার জন্য। তখন তিনি বলেছিলেন, তুমি শুধু দেখবে, বাকি যেসব বাথরুম আছে সেগুলো তুমি পরিষ্কার করবে। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ।
হোটেলে স্টাফ লবিসহ মিলিয়ে মোট বাথরুম আছে ১১টি। আমি বাকি ১০টি বাথরুম তাঁদের মতো পরিষ্কার করব। নজরুল ভাই সবকিছু শেষ করার পর আমাকে বললেন, ‘হীরা, এই পৃথিবীতে কোনো কাজ ছোট না। নিজের কাজকে সব সময় অন্তর থেকে ভালোবাস, দেখবে যেকোনো কাজ করে আনন্দ পাবে। তারপর তিনি বললেন, বিকেলে খান নামে একজন আসবেন, ওনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে বাসায় যেও।
বিকেলে খান আংকেল আসলেন। তিনি আমাকে বললেন, তুমি নতুন? আমি বললাম, হ্যাঁ।
ভালো-মন্দ সব জিজ্ঞাসা করে খান আংকেল বললেন, তিনি এই কাজ করেন বিকেলের শিফটে। তিনি আর আরেকজন। অন্যজনের নাম হারুন। সকালে আবু আংকেল আর স্প্যানিশ আরেকজন করেন। খান আংকেলকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কত দিন এখানে কাজ করেন। তিনি বললেন, এক মাস। তাঁর ভার্সিটির কিসের জন্য যেন অপেক্ষা করছেন। পরে অন্য কাজ এ যাবেন। আমি জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি বললেন, শেরপুরের একটি কলেজের ইংরেজির শিক্ষক তিনি। ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স।
প্রবাস জীবনের প্রথম দিন কাজ শেষ করে বের হয়েছি হোটেল থেকে। দেখি আবু আংকেল আমার সামনে। তিনি বললেন, আমার গাড়ি আছে, চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিই। তিনি কথা বলে যাচ্ছেন, আমার কোনো মনোযোগ নাই। আমার শুধু কিমের কাজ করার দৃশ্য, নজরুল ভাই আর খান আংকেলের কথা বারবার মনে হচ্ছিল।
আবু আংকেল বললেন, বুঝলা হীরা, গাড়ি চালাতে ভালো লাগে না। আমি সারা জীবন গাড়ি শুধু চড়েছি, আমাদের ড্রাইভার ছিল, গাড়ি ছিল...।
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, আংকেল আপনিও কি কোনো কলেজের প্রফেসর? আবু আংকেল বললেন, তুমি কি সিলেট শহরে বড় হয়েছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কাজির বাজার চিনো?
আমি বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই।
কাজির বাজারের জনতা ব্যাংকের শাখার আমি ম্যানেজার ছিলাম। এখন অবসর নিয়ে আমেরিকায়।
আমি অন্য কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বাসার সামনে চলে এসেছি। তাঁকে সালাম দিয়ে বাসায় গেলাম।
সারা রাত চিন্তা করলাম আর মনে মনে বললাম, আমি এই কাজই করব, আমার কোনো সমস্যা নেই।
লোকের অভাব ছিল বলে পরদিনই আমাকে লন্ড্রিতে দেওয়া হয়েছে।