বীরাঙ্গনা কাব্য

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

তবুও তুমি চলেই গেলে। আমার কী সাধ্য তোমাকে আটকাব। আমার সৌন্দর্য, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা, অপরিসীম মমত্ববোধ, আমার পেটে তোমার সারা জীবনের আরাধ্য সম্পদ আমাদের সন্তান, কোনো কিছুই তোমাকে আটকাতে পারেনি সেদিন। দেশের প্রতি তোমার ভালোবাসা, এ সবকিছুর ঊর্ধ্বে ছিল। তাই তুমি সবকিছু উপেক্ষা করে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য চলেই গেলে। জুলাই মাসের কোনো এক রোদ্রকরোজ্জ্বল বিকেলে তুমি বাইরে থেকে এলে, উস্কশুস্ক মাথার চুল, আমার সমানে এসে দাঁড়ালে। অপলক চেয়েছিলে আমার মুখের পানে। তোমার বলিষ্ঠ হাত আমার মাথায় রাখলে, তুমি বললে, ‘বাবুই, আমি চলে যাচ্ছি, আমাকে যেতেই হবে, তোমাকে রেখে যাচ্ছি একা। তোমার নিরাপত্তা তোমাকেই নিতে হবে। যদি ফিরে আসি, তুমি আমি আর আমাদের সন্তান মিলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মাটিতে মনের সুখে ঘুরে বেড়াব। আর যদি না আসি, আমার অনাগত সন্তানের দায়িত্ব তোমার। তুমি ওকে তোমার মতো করেই মানুষ কোরো। ও যেন গর্ব করে বলতে পারে, ওর বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, যে এই দেশকে মুক্ত করার জন্য প্রাণ দিয়েছে।’ তুমি মাটি স্পর্শ করলে, সেই মাটি নিজের কপালে মাখালে, আমার কপালেও মাখিয়ে দিলে আবার সেই হাত আমার পেটের ওপরে রাখলে। বিড়বিড় করে কী যেন সব বললে। তুমি চলে গেলে। আমার সব কথা আমার কণ্ঠের কাছে এসে আটকে গেল। হতবিহ্বল আমি কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু তোমার চলে যাওয়ার পথে নিঃশব্দ তাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ তোমাকে দেখা যায়। ফিসফিস করে এইটুকু বললাম, ‘ভালোবাসি তোমাকে, অনেক বেশি ভালোবাসি, তুমি ছাড়া এই জীবন অর্থহীন। তুমি ফিরে আসো যত তাড়াতাড়ি পারো। কিন্তু তুমি চলেই গেলে।

আমি অপেক্ষা করেছি প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন, মাস, বছর। আজ ৪৪ বছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। তুমি যাওয়ার মাত্র সাত মাস পরই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি জানি না তোমার কী হয়েছে? তুমি কোথায় আছো? কেমন আছো? তোমার সহযোদ্ধারা অনেকেই ফিরে এসেছে, তারা কেউ বলেতে পারেনি তুমি কোথায় আছো, শহীদ হয়েছ নাকি? তোমার ফিরে আসার বিশ্বাস নিয়েই আমি কাটিয়েছি ৪৪ বছর। আমি অপেক্ষা করেছি ঠিক তেমনি করে, যেমন করে অপেক্ষা করতাম তোমার জন্য ৪৪ বছর আগে। তুমি এখন দেখতে কেমন হতে? তোমার সব দাড়িগুলো কি পাকা থাকত? তোমার পছন্দের খাবার কতবার রান্না করেছি। ভেবেছি, এই বুঝি তুমি এলে। বাবুই বাবুই করে সারা উঠোন তোলপাড় করলে। তোমার অপেক্ষার প্রহরে কান্নায় নিমগ্ন আমি। তুমি আর ফিরে আসনি। সেই তুমি চলেই গেলে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত


তুমি যাওয়ার মাত্র কদিন পরই গ্রামের রাজাকার তার দলবল নিয়ে এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে। সেদিন ওই রাজাকারের পা জড়িয়ে ধরে কতবার কেঁদেছি। বলেছি আমার পেটে তোমার সন্তান। আমার কোনো আকুতি তার কর্ণকুহরে পৌঁছেনি। পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে আমার গল্পটি আর সব গল্পের মতো না। সেনাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য, তোমার আমানত রক্ষার জন্য কত কিই না করেছি। নিজের জীবনের মূল্যবাদ সম্পদ রক্ষা করতে পেরেছি। তোমার আমানত রক্ষা করেছি। বিনিময়ে হারিয়েছি আমার একটি চোখ, আমার মুখাবয়ব। যেই সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে তুমি একদিন বলেছিলে, আমি তোমার বাবুই পাখি। পাকিস্তানি সেনার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে আমি মেজরের ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসি। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি দৌড়াতে থাকি। পেছনে পাকিস্তানি আর্মিরা। অনেক বড় একটা কড়াইয়ে কিছু একটা রান্না হচ্ছিল। কোনো উপায় না দেখে আমি ওই ফুটন্ত কড়াইয়ের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বাস এইটুকুই মনে আছে, আর কিছু মনে নেই। যখন আমার জ্ঞান ফেরে, আমি নিজেকে আবিষ্কার করি হাসপাতালের বিছানায়। আমার একটি চোখ অন্ধ আর আমার মুখের একটা পাশ পুরোপুরি অগ্নিদগ্ধ। আমি জানি না কে কীভাবে আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল।
সুদীর্ঘ ৪৪ বছরে আমি কী করেছি, কী পেয়েছি শুনতে চাও? না, বলব না তোমাকে। এসব কথা শুনে তোমার পবিত্র ইচ্ছার আর প্রত্যাশার অবমাননা করতে চাই না। কখনো ভাবি, ভালোই হয়েছে। তুমি ফিরে আসনি। আসলে কী হতো? কী পেতে তুমি স্বাধীন দেশে? লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান? ওসব তুমি সইতে পারতে না। যা সহ্য করার আমিই করেছি। আমি কী পেয়েছি শুনবে? একটি অন্ধ চোখ, আগুনে ঝলসানো মুখ, অর্ধাহার অনাহারের নিঃসঙ্গ সুদীর্ঘ একটা জীবন। সেই সঙ্গে পেয়েছি অনেক বড় কিছু একটা। বীরাঙ্গনা খেতাব। আমি আজও জানি না বীরাঙ্গনা আসলে কাকে বলে? তবে আমি জানি, ওরা বীরাঙ্গনা বলতে যা বোঝায় আমি সেই বীরাঙ্গনা নই। আমার সমাজ আমাকে বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত করেছে। কেন করেছে, সেই কথা আর না-ই বা বললাম। কতটা অসহায়ের জীবন আমি যাপন করেছি একমাত্র মহান আল্লাহ সেটা জানেন। আমার সব কষ্ট, দুঃখকে ছাপিয়ে আমি সবকিছু ভুলে বেঁচে আছি একটা কারণে, সে তোমার সন্তান। তোমার সন্তান ঠিক তোমারই মতো। একই মুখাবয়ব, সেই হাসি, সেই চাহনি। ও যদি বড় হতে হতে তোমার মতো দেখতে না হতো, তাহলে ওকেও জীবনে অনেক বড় একটা কলঙ্ক বয়ে বেড়াতে হতো। সেটা কী, তুমি হয়তো বুঝবে না। কিন্তু আমার এই সমাজের মানুষ সেটা খুব ভালো করেই বোঝে। বলতে পারো, তোমার সন্তানই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

আমি তোমার কথা রেখেছি। নিজের নিরাপত্তা নিজেই দিয়েছি, সেটা অনেক বড় কিছুর বিনিময়ে হলেও। তোমার সন্তানকে বড় করেছি তোমার আদর্শে। সে আজ বুক ফুলিয়েই বলে, তার বাবা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। কিন্তু তুমি? তুমি তোমার কথা রাখনি। তুমি ফিরে আসনি। জানি, আর আসবেও না কোনো দিন। না আসো। তোমার অর্জিত স্বাধীন দেশে তোমার পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানেরা স্বাধীনমতো ঘুরে বেড়াবে, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে। খুব কষ্ট হয়, ঘৃণা হয়, যখন দেখি তোমার অর্জিত পতাকা কোনো রাজাকারের গাড়িতে ওড়ে। কষ্টে মরে যেতে ইচ্ছে করে, যখন দেখি তোমার বুকের রক্তে মুক্ত করা স্বাধীন দেশে শকুনেরা তোমার দেশকেই ব্যবচ্ছেদ করতে চায়। তখন মনে হয়, বিধাতা কেন আমার দুটো চোখই নিয়ে নেননি। জানি, জীবনে কোনো কিছুই অর্থহীন নয়। আমি বিশ্বাস করি, তোমার জন্য আমার এই অপেক্ষাও অর্থহীন নয়। তুমি ফিরে আসবেই একদিন। তোমার সেই ফিরে আসা যেভাবেই হোক। আমি অপেক্ষায় ছিলাম, আছি, থাকব।
(লেখক অণুজীব বিজ্ঞানী ও গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব সাস্কাচেওয়ান, সাস্কাতুন, কানাডা)